তীব্র গরমে সাতক্ষীরায় মানুষের হাঁসফাঁস অবস্থা। গত এক সপ্তাহ ধরে তাপমাত্রা ৩৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে সবোর্চ্চ তাপমাত্রা ৪০.৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছে। ফলে তীব্র গরমে সাতক্ষীরা সদর হাসপাতাল, শিশু হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোতে বাড়ছে জ্বর, ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া, টাইফয়েড, পেটের পীড়া, ঠান্ডা জ্বর, সর্দি, কাশি, হিটস্ট্রোক, পানি শূন্যতা, খিচুনি, শ্বাসকষ্টসহ গরমজনিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। অতিরিক্ত রোগীর চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
সব বয়সের মানুষের কষ্ট হলেও এই গরম সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে শিশু ও বয়স্করা। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতেও ভর্তি রোগীর অধিকাংশই শিশু। এদের বেশির ভাগই ডায়রিয়া রোগী। হাসপাতালগুলোতে রোগীর চাপ বেড়ে যাওয়ায় দেখা দিয়েছে শয্যা সংকট। এছাড়া হাসপাতালের ফ্যানগুলো অকেজো হয়ে পড়ে থাকায় রোগীরা চিকিৎসা নিতে এসে চরম ভাবে দুর্ভোগ ও হিমশিম খাচ্ছেন। এগুলো যেন দেখার কেউ নেই। হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা কমিটির ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন অনেকেই।
বুধবার সাতক্ষীরা সদর হাসপাতাল ও বহির্বিভাগে গিয়ে দেখা গেছে, শত শত রোগীর চাপে মানুষ হাঁসফাঁস করছে। ১০০ শয্যার এ হাসপাতালে রোগীর দ্বিগুণ ভিড় বেড়েছে। শয্যা (বেড) না পেয়ে হাসপাতালের মেঝেতে আশ্রয় নিয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন। আর বহির্বিভাগে চিকিৎসা নেওয়ার জন্য বাইরে দাঁড়িয়ে আছে সব বয়সের শত শত রোগী। তবে এদের মধ্যে অধিকাংশ মা ও বাবাদের কোলে রয়েছে অসুস্থ্য শিশু। বেশিরভাগই ডায়রিয়ায় আক্রান্ত, সর্দি ও কাশি। অন্য শিশুরা জ্বর, নিউমোনিয়া, টাইফয়েড ও শ্বাসকষ্টজনিত রোগে আক্রান্ত।
এসময় স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষ থেকে সাতক্ষীরা সিভিল সার্জন অফিসের জুনিয়র স্বাস্থ্য শিক্ষা অফিসার মোছা. শাহিনুল খাতুন বিভিন্ন স্বাস্থ্যকর্মীদের নিয়ে হ্যান্ড মাইকিং করে স্বাস্থ্য সুরক্ষা পরামর্শ ও লিফলেট বিতরণ করছেন। অতি গরমে ঘর থেকে অপ্রয়োজনীয় কাজে বের না হওয়া, বাইরে বের হলে ছাতা ব্যবহার করা, বেশি বেশি করে বিশুদ্ধ পানি পান করাসহ নানা ধরনে স্বাস্থ্য সুরক্ষা টিপস দিচ্ছেন।
অপরদিকে টিকিট কাউন্টারের সামনে প্রচুর ভিড়। টিকিট নিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে পড়ছেন বি-ব্লকের নিচের তলায় অবস্থিত মেডিকেল অফিসারদের রুমের সামনে। ডাক্তার দেখাবেন বলে। ওয়ার্ডে, শয্যা, মেঝে, বারান্দা সবখানেই রোগী ও রোগীর স্বজনদের ভিড়। হাসপাতালের ফ্যানগুলো অধিকাংশ অকেজো থাকায় চিকিৎসা নিতে এসে রোগীরা আরও অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। অধিকাশ বিভাগে ডাক্তার নেই। দরজার সামনেই রোগীদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা। শিশুদের মায়েরা ও বিভিন্ন রোগীর আল্টাসনোর জন্য রুমের সামনে বারান্দায় বসে ডাক্তারের অপেক্ষার প্রহর গুণচ্ছেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। কখন আসবেন কাঙ্ক্ষিত ডাক্তার। সকাল ৯টা থেকে ডা. তামিমের জন্য বেলা ১২টা পর্যন্ত অপেক্ষা। তখনও ডাক্তার আসেননি।
সদর উপজেলা ছাতিয়ানতলা থেকে চিকিৎসা নিতে আসা শারজাত আলী জানান, স্ত্রী ছাবিনা খাতুনকে আল্টাসনো করতে হবে। কোলে ৩ মাসের শিশুকে নিয়ে সকাল থেকে টানা ৪ ঘণ্টা অপেক্ষা করছেন তিনি। কিন্তু এখনো ডাক্তার আসেননি। দায়িত্বরত নার্স বলছেন, এখনি ডাক্তার আসবেন অধাঘণ্টা থাকবেন এর মধ্যে যদি আপনারটা হয় তাহলে হবে না হলে বাড়ি ফিরে যেতে হবে। এভাবে আমরা হয়রানি ও দুর্ভোগের শিকার হচ্ছি।
৪৫ কিলোমিটার দূর কালিগঞ্জ উপজেলা থেকে এসেছেন কাজী সিরাজুল ইসলাম। গত তিন দিন ধরে হাসপাতালের ১ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি তার ছেলে কাজী নূর আলী। পেঠে ব্যাথাজনিত সমস্যা। তিনি জানান, হাসপাতাল থেকে কোন ওষুধ তাকে দেওয়া হয় না, সব বাইরে থেকে কিনতে হচ্ছে। আল্টাসনোর জন্য ৩ ঘণ্টা ডাক্তার ও টেকনিশিয়ানের জন্য অপেক্ষা।
দুর্ঘটনায় আহত বৈকারি গ্রাম থেকে আসা অসুস্থ মেহেদি হাসানের সাথে দেখা। চিৎকার করে বলছে, 'এটি কি? সরকারি হাসপাতাল না অন্য কিছু। ওষুধ পাতি কিছুই নেই। ডা. ব্যবস্থাপত্র দিয়ে বলছে, বাইরে থেকে ওষুধ কিনতে হবে। দুটি ট্যাবলেটের নাম একটি চিরকুটে লিখে দিয়ে ফার্মিসিতে যেতে বললেন। সেখানে গেলে ওষুধ নেই বরে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিল।'
সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ( আরএমও) ডা. ফয়সাল আহম্মেদ জানান, অতিগরমজনিত কারণে প্রতিদিন হাসপাতালের জরুরি ও বর্হিবিভাগে ৫৫০ থেকে ৬০০ রোগীর ভিড় হচ্ছে। আজ বুধবার শুধু মাত্র বর্হিবিভাগে ৫৮২ জন রোগীর চিকিৎসা নিতে আসেন। আমাদের জরুরি ও বর্হিবিভাগে বিভাগে ৩ জন মেডিকেল অফিসার সংকট রয়েছে।
অতিগরমের কারণে ১০০ শয্যা এ হাসপাতালে বর্তমানে প্রতিদিন ১৬০ থেকে ১৭০ জন রোগী চিকিৎসা নিচ্ছেন। শয্যা সংকটে তাদের বাধ্য হয়ে বারান্দায় ও মেঝেতে বিছানা করে চিকিৎসা নিতে হচ্ছে। রোগীর চাপে চিকিৎসা দিতে হিমশিম খাচ্ছে ডাক্তার ও নার্স। বেশির ভাগ রোগী ডায়রিয়া ও নিউমোনিয়া আক্রান্ত শিশু।
অতিগরমে সাতক্ষীরা ৫০০ শয্যা বিশিষ্ট মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও শিশু হাসপাতালে দ্বিগুণ আকারে রোগীর সংখ্যা বৃদ্বি পেয়েছে। গত তিন দিনে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রায় ৪০০ রোগী ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন। আর শিশু হাসপাতালে এই মুহূর্তে ভর্তি হয়ে ৩৫ জন চিকিৎসা নিচ্ছেন। এদের মধ্যে অধিকাংশ ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগী।
সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. শামছুর রহমান জানান, শিশু ওয়ার্ডে প্রতিদিন ৬৫ থেকে ৭০ জন শিশু রোগী ভর্তি হচ্ছেন। এদের মধ্যে বেশিরভাগ ডায়রিয়া ও নিউমোনিয়া আক্রান্ত। এছাড়া রয়েছে সর্দি, কাশি ও পানি শূন্যতা, খিচুনি, শ্বাসকষ্টসহ গরমজনিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত রোগী। প্রচুর ওষুধ ও খাওয়ার স্যালাইন রয়েছে। এই সময় ঘরে থাকা, পানি বেশি খাওয়া, পচা-বাসি খাবার সম্পূর্ণ পরিহার করা। দুধজনিত বাসি খাবার শিশুদের না খাওয়ায়ে ফেলে দেওয়া। বাইরে বের হলে প্রচণ্ড রোদ ও তাপ থেকে রক্ষা পেতে ছাতা ব্যবহার করা অতি জরুরি।
সাতক্ষীরা আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জুলফিক্কার আলী জানান, গত কয়েক দিন ধরে সাতক্ষীরার উপর দিয়ে প্রচণ্ড আকারে তাপদাহ বয়ে যাচ্ছে। বুধবার ৩৯.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। এর তিন দিন আগে সাতক্ষীরায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৪০.৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এ অঞ্চলে আপাতত বৃষ্টির কোন সম্ভাবনা নেই।
বিডি প্রতিদিন/আরাফাত