ঢাকা, রবিবার, ২৮ জুলাই, ২০২৪

আজকের পত্রিকা

বগুড়ায় বেড়েই চলছে খুনের ঘটনা
আবদুর রহমান টুলু, বগুড়া
প্রতীকী ছবি

আধিপত্য বিস্তার, টেন্ডারবাজি, মাদকের টাকা জোগাড় ও মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করে বগুড়ায় বেড়েই চলছে খুনের ঘটনা। প্রতিনিয়ত রক্তে লাল হচ্ছে বগুড়ার রাজপথ। একটি খুনের রেশ না কাটতেই, আরেকটি খুনের ঘটনা ঘটছে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ৬ মাসে ৩১টি খুন হয়েছে। এর মধ্যে স্বামীর হাতে স্ত্রী খুন, বন্ধুর হাতে বন্ধু খুন, সর্বশেষ পেস্টিজ ইস্যুতেই জোড়া খুনের ঘটনা ঘটেছে।

জানা যায়, একসময়ের শান্তির শহর বগুড়া এখন অনেকটা অশান্তির শহরে পরিণত হয়ে উঠেছে। সামান্য ঘটনায় যে কাউকে খুন করা সাধারণ ব্যাপার। এমনকি হাসি-ঠাট্টা করলেও খুন করা হয়। শহরের বাইরেও রয়েছে আরও খুনের ঘটনা। আর এসব খুনের শিকার শুধু সাধারণ মানুষই নয়, রাজনৈতিক ব্যক্তি, জনপ্রতিনিধিসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ। এ ছাড়া স্কুল-কলেজ পড়ুয়া ছাত্রদের ব্যাগ থেকেও চাকু উদ্ধার করেছে পুলিশ। যত্রতত্র চাইনিজ চাকু অবাধে বিক্রি হওয়ায় ব্যবহারও বেড়েছে দ্বিগুণ।

বগুড়া জেলা পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে খুনের ঘটনা ঘটেছে ৮২টি। ২০২২ সালে সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৮৯টি। ২০২৩ সালের ২৪ শে অক্টোবর পর্যন্ত খুন হয়েছে ৮০ জনের উপরে। ফেব্রুয়ারি ২০২৪ পর্যন্ত এ সংখ্যা ১০০ ছাড়িয়ে গেছে। শুধু যে সাধারণ মানুষ কিংবা সন্ত্রাসীরা খুন হচ্ছে, তা নয়। খুনের তালিকায় যোগ হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, কারারক্ষী, আনসার সদস্যও। চলতি বছরে এ পর্যন্ত ৩১টি খুনের ঘটনা ঘটেছে।

এসব খুনের বেশির ভাগ হয়েছে চিহ্নিত সন্ত্রাসী এবং কিশোর গ্যাংদের দ্বারা। কোনোভাবেই পুলিশ থামাতে পারছেন না চিহ্নিত সন্ত্রাসী এবং কিশোর গ্যাংদের। মাদকের টাকা না পেলে বাবা ও মাও ছাড় পাচ্ছেন না কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের হাত থেকে।

বগুড়া জেলাজুড়ে একের পর এক খুনের ঘটনা ঘটছে। এতে নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন সাধারণ মানুষ। পুলিশ বেশির ভাগ হত্যা মামলার আসামি গ্রেফতার, অস্ত্র উদ্ধার এবং রহস্য উদঘাটনের দাবি করলেও খুন কোনোভাবেই থামছে না।

একসময় বগুড়া শহর থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে ফুলতলায় নিয়মিত ঘটতো মারাত্মক খুনের ঘটনা। দিনে-রাতে খুনের ঘটনা ঘটতো এখানে। কোনো অবস্থাতেই ফুলতলার অপরাধ নিয়ন্ত্রণে নিতে পারছিল না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ওই এলাকায় দেদারছে হতো খুনের বদলে খুন। একজন খুন হলেই বদলা নিতে খুনের ঘটনায় মরিয়া হয়ে উঠতো অন্য সন্ত্রাসীরা। খুনের আতঙ্কে থাকতো এলাকাবাসী। ফুলতলায় পেশাদার খুনি আমিনুর রহমান শাহীন ও মজনু মিয়ার আলাদা সন্ত্রাসী বাহিনী ছিল। শাহীন ও মজনু দুজনই প্রতিপক্ষের হাতে খুন হয়েছিলেন। কিন্তু বর্তমানে খুনের ঘটনা শুধুমাত্র ফুলতলাই সীমাবদ্ধ নেই, ছড়িয়ে পড়েছে জেলাজুড়ে।

সর্বশেষ গত ১৭ জুন বগুড়ায় ঈদুল আজহার দিন রাতে জোড়া খুনের ঘটনা ঘটেছে। এদিন রাতে শহরের নিশিন্দারা চকরপাড়ায় মোহাম্মদ শরীফ ও তার মামাতো ভাই মোহাম্মদ রোমানকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। শরীফ পেশায় এলপি গ্যাসের ব্যবসায়ী এবং রোমান শহরের সাতমাথায় ফুটপাতে ভ্যানে করে কাপড়ের ব্যবসা করতেন। পরে এ ঘটনায় শরীফের মা হেনা বেগম বাদী হয়ে সদর থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন।

মামলার প্রধান আসামি বগুড়া জেলা মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ কবির আহম্মেদ মিঠু। অন্য আসামিরা হলেন-মিঠুর ভাই ১ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বগুড়া জেলা পরিষদের সদস্য ও প্যানেল চেয়ারম্যান সৈয়দ সার্জিল আহম্মেদ টিপু, টিপুর ভায়রা ১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক সভাপতি শাহ মেহেদী হাসান হিমু, শেখ সৌরভ, নাঈম হোসেন এবং আজমিন রিফাতসহ ১৩ জন নামীয় ও অজ্ঞাতনামা ১৪ থেকে ১৫ জন।

পরে এ ঘটনায় প্রধান আসামি সৈয়দ কবির আহম্মেদ মিঠুকে (৬০) গ্রেফতার করেছে র‌্যাব। গত মঙ্গলবার শহরের বাদুরতলা থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়। একইদিন নিশিন্দারা খাঁপাড়ার শেখ সৌরভ, নিশিন্দারা পূর্বপাড়ার নাঈম হোসেন এবং সুলতানগঞ্জপাড়ার আজবিন রিফাতকে গ্রেফতার করে পুলিশ।

ঈদের দিন বিকালে বগুড়া শহরের নিশিন্দারায় সড়কের পাশে সৈয়দ সার্জিল আহম্মেদ টিপুর গাড়ি দাঁড় করানো ছিল। এমন সময় রোমান মোটরসাইকেল নিয়ে চকরপাড়া ফিরছিলেন। রাস্তা পার হতে অসুবিধা হওয়ায় টিপুর গাড়ি চালকের সঙ্গে রোমানের বাকবিতণ্ডা হয়। এর জেরে দিবাগত রাত সাড়ে ১২টার দিকে মোটর শ্রমিক নেতা সৈয়দ কবির আহম্মেদ মিঠু, তার ভাই সৈয়দ সার্জিল আহম্মেদ টিপু, সার্জিলের ভায়রা ১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক সভাপতি শাহ মেহেদী হাসান হিমুর নেতৃত্বে ১৫ থেকে ২০ জন চকরপাড়ায় আসেন। তারা রোমানকে খুঁজতে থাকেন। পরে রোমান শরীফকে ডেকে নেয়। বাকবিতণ্ডার একপর্যায়ে রোমানকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।

এর আগে ৮ জুন পুলিশের খাতায় তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী ও ২৯টি মামলার আসামি বিরাজুল ইসলাম ব্রাজিলকে হত্যা করা হয়। রাজনৈতিক কলহ ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ব্রাজিলকে হত্যা করা হয়। এ ছাড়াও গত ২ জুন বগুড়া শহরের বনানী এলাকায় শুভেচ্ছা নামের একটি আবাসিক হোটেলে স্ত্রী আশামনি (২০) ও এক বছর বয়সী শিশু সন্তান আব্দুল্লাহ আল রাফিকে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে আজিজুল হক।

বগুড়া থিয়েটারের সাধারণ সম্পাদক তৌফিক হাসান ময়না বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, খুন-খারাপির কারণে বগুড়া এখন অসুস্থ নগরীতে পরিণত হয়েছে। এর প্রভাব আমাদের মধ্যে যেমন পড়ছে, ঠিক পরবর্তী প্রজন্মের ওপরও পড়বে। তাই আমাদের সন্তানদের পারিবারিক শিক্ষায় শিক্ষিত করতে হবে।

র‌্যাব-১২ বগুড়ার কোম্পানি কমান্ডার (পুলিশ সুপার) মীর মনির হোসেন জানান, সামাজিক অবক্ষয় থেকে বগুড়ায় খুনের ঘটনা বেড়েই চলছে। এসব খুনের ঘটনা থেকে বগুড়াবাসীকে পরিত্রাণ পেতে হলে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। পারিবারিক শিক্ষা থেকে শিক্ষা নিয়ে সমাজে পরিবর্তন ঘটাতে পারলেই খুনের ঘটনা কমে আসবে।

বিডি প্রতিদিন/এমআই



এই পাতার আরো খবর