ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৮ জুলাই, ২০২৪

আজকের পত্রিকা

আর্থিক খাতের তারল্য সংকট সমাধানে যা করা যেতে পারে
অনলাইন ডেস্ক
প্রতীকী ছবি

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এই মুহূর্তে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে তারল্য সংকট। কেননা, বর্তমানে দেশের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো যেসব সমস্যায় ভুগছে, তার মধ্যে অন্যতম এই তারল্য সংকট।  

কীভাবে এই তারল্য সংকটের সৃষ্টি ও তা সমাধানে করণীয় কী, এ বিষয়ে দেশের একটি ইংরেজি জাতীয় দৈনিকে মতামতধর্মী কলাম লিখেছেন বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) কমিশনার ড. মিজানুর রহমান।

মতামতধর্মী ওই কলামে তিনি লিখেছেন, এই তারল্য সংকট মৌলিকভাবে অর্থনৈতিক।

তার মতে, এই পরিস্থিতি সৃষ্টির পেছনে নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানের দুর্বল তদারকি এবং ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণমানের ব্যাপক অবনতিও বড় ভূমিকা পালন করেছে। কিন্তু নীতিনির্ধারকরা বিষয়টি স্বীকার করছেন না যা সামষ্টিক অর্থনীতিক ব্যাবস্থাপনার জন্য অন্তরায় হতে পারে।  

বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের এই কর্মকর্তা আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন, এই তারল্য সংকট শুধু অর্থনৈতিক সক্ষমতার ক্ষেত্রেই ঝুঁকি তৈরি করবে না, বরং এটা অর্থনৈতিক এজেন্টদের মনেও ভয় ধরিয়ে দিতে পারে এবং সামগ্রিকভাবে আর্থিক বাজারে সিস্টেমিক ঝুঁকি বাড়িয়ে দিতে পারে।

ড. মিজানুর রহমান লিখেছেন, বাংলাদেশ ব্যাংক অর্থনীতির ক্রমবর্ধমান চলতি হিসাবের ঘাটতি অর্থায়নে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর থেকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ (সঞ্চিতি) বিক্রি করেছে।

তিনি বলেন, ২০২১ সালের আগস্টে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল রেকর্ড ৪৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। অতিমূল্যায়িত টাকার বিনিময় হারকে সমর্থন দিতে গিয়ে রিজার্ভ বিক্রির ফলে তা থেকে কমে ২০২২ সালের অক্টোবরে ৩৫ বিলিয়নেরও নিচে নেমে যায়। মুদ্রাবাজারে ভারসাম্যহীনতা ও বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে একাধিক বিনিময় হারের অবনতির মাঝেই অর্থনীতির এই দ্রুত অবক্ষয় ঘটছে।   

অন্যভাবে বললে, অনেক অনিশ্চয়তার একটি পরিবেশের মধ্য থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কেবল সুদের হার ও বিনিময় হারকেই লক্ষ্য হিসেবে নিয়েছে। এ কারণে আমরা দুটি অস্থিতিশীল ফলাফল দেখতে পাচ্ছি।

প্রথমত, আমাদের আর্থিক ব্যবস্থায় তারল্য সংকট আরও ঘনীভূত হচ্ছে। কারণ কেন্দ্রীয় ব্যাংক যখনই খোলা বাজারে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বিক্রি করে, তখনই আর্থিক খাতে টাকার সরবরাহ হ্রাস পায় এবং মুদ্রা বাজারে তারল্য কমে যায়। যেহেতু মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় হারকে এখনও অতিমূল্যায়িত বলেই বিবেচনা করা হয়, তাই বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা ক্রমবর্ধমান হারে বাড়ছে। এটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভকে আরও অবক্ষয়ের দিকে ডাকছে। এর ফলে তারল্য সংকট আরও বাড়বে।

সরকার তার ব্যয় নিয়ন্ত্রণের জন্য কৃচ্ছতা সাধনের ওপর মাত্রারিক্ত গুরুত্ব আরোপ করেছে। অথচ এটিই বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদার একমাত্র উৎস নয়। আরও গুরুত্বপূর্ণ চালকগুলোর মধ্যে আছে গৃহস্থালির খরচ এবং করপোরেট বিনিয়োগ, যা উভয়ই সুদের হারের ওপর গভীরভাবে নির্ভরশীল। সুদের হার এখনও একক অঙ্কে থাকায়, আমদানি চাহিদার বৃহত্তর অংশ নিয়ন্ত্রণ করার একমাত্র উপায় হলো আমদানী বানিজ্য প্রতিবন্ধকতা (উদাহরণস্বরূপ, কোটা এবং ট্যারিফ) এবং অন্যান্য প্রশাসনিক নির্দেশিকা স্থাপন করা। আমার মতে, এটি একটি স্ব-পরাজিত কৌশল। আমার মতে এটি সংকটকালে কাজে আসে না।

দ্বিতীয়ত, করোনা ভাইরাস সংকটকালে বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে এবং ২০২১ সালের জুলাই থেকে সামগ্রিক মূল্যস্তর দ্রুত বৃদ্ধি পায়। জ্বালানি ও অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ক্রমবর্ধমান মূল্যবৃদ্ধি (ইউক্রেনে রুশ হামলার কারণে) এবং করোনা মহামারীর পর অর্থনীতি পুনরায় চালু হওয়ার সাথে সাথে সামষ্টিক চাহিদা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। এখন, ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতির কারনে সম পরিমান পণ্য ও পরিসেবার লেনদেনের জন্য মুদ্রাবাজারে ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি হয়। এর মানে হল যে, রিয়েল মানি ব্যালেন্সের (প্রকৃত মুদ্রার সরবরাহ) সরবরাহ গত ১২ মাসে দ্রুত সংকুচিত হয়েছে।

ড. মিজানুর রহমান বলেন, উল্লিখিত এই দুটি উপাদানই আমাদের আর্থিক খাতে ব্যাপক তারল্য সংকটের সৃষ্টি করছে। এর পেছনে নিয়ন্ত্রক সংস্থার দুর্বল ভূমিকা এবং সুশাসনের একটি সম্পর্ক হয়েছে। আমরা লক্ষ্য করছি যে, বিগত কয়েক বছর ধরে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সম্পদের মানের অবনতি হয়েছে। নন-পারফর্মিং লোনের (এনপিএল) ক্রমবর্ধমান পরিমাণ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিচালন নগদ প্রবাহ হ্রাস করেছে।

তাহলে বাংলাদেশ ব্যাংক কীভাবে এই তারল্য সংকট সমাধান করবে? 

মতামতধর্মী ওই লেখায় এ বিষয়ে কিছু পরামর্শও দিয়েছেন বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের কমিশনার ড. মিজানুর রহমান।

তিনি লিখেছেন, প্রথমত, কেন্দ্রীয় ব্যাংককে আর্থিক ব্যবস্থায় নতুন তারল্য প্রবেশ করাতে হবে। প্রাথমিকভাবে রেপো (Repurchase Aggrement)মার্কেটের মাধ্যমে। যদি এই শ্রেণির সম্পদের সরবরাহের ঘাটতি দেখা দেয়, তাহলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক পরবর্তী ভালো মানের আর্থিক সিকিউরিটিজ (যেমন ব্যাংক বন্ড) কেনার কথা বিবেচনা করতে। তবে অবশ্যই ন্যায্য মূল্যে হতে হবে। এর একটি নেতিবাচক ঝুঁকি হল-মুদ্রাস্ফীতি আরও বেড়ে যেতে পারে। তবে ক্রমবর্ধমান তারল্য সংকট কাটিয়ে উঠতে এটিকে স্বল্পমেয়াদে অগ্রাধিকার দেওয়া যেতে পারে।

দ্বিতীয়ত, অর্থ বাজারের ভারসাম্য আনতে রিয়েল মানি ব্যালেন্স (প্রকৃত অর্থের সরবরাহের) হ্রাস দ্রুত ক্রমবর্ধমান সুদের হার দাবি করে। এখানে স্থির সুদের হারের অস্থিতিশীল ভূমিকার কথা বলা হচ্ছে।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশ ব্যাংক ২০২০ সালের শুরুতে ঋণের সুদের হার ৯ শতাংশে স্থির করে, যা বেসরকারী খাতের ঋণের চাহিদাকে তরান্বিত করেছে। অন্যদিকে চলতি হিসেবের ১৮ বিলিয়ন ডলার ঘাটতি এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ব্যাপক অবক্ষয় মুদ্রার সরবরাহকে হ্রাস করেছে। মুদ্রা বাজারে যোগান ও চাহিদার ব্যাপক ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি হয়েছে। মুক্তবাজার হলে সুদের হার ১০ শতাংশের বেশি হবে। সুতরাং নীতিগত সমাধান হল, কেন্দ্রীয় ব্যাংক যদি মুদ্রাবাজারে সুদের হার অবাধে নির্ধারণ করতে দেয়, তাহলে এটি কার্ডিয়াক অ্যারেস্টের অধীনে একজন ব্যক্তির জন্য বাইপাস সার্জারির মতো কাজ করবে। বাজার ভিত্তিক সুদের হার ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঋণের ন্যায্য মূল্য নির্ধারণ করতে সাহায্য করবে এবং বেসরকারি খাতের ঋণের চাহিদা কমিয়ে দেবে। এতে অর্থ বাজার মৌলিক ভারসাম্য ফিরে আসবে।

ড. মিজানুর রহমান বলেন, মুদ্রাবাজার ও বৈদেশিক বিনিময় বাজার গভীরভাবে পরস্পর নির্ভরশীল। বাজার ভিত্তিক সুদের হার মুদ্রাবাজারে ভারসাম্য আনবে এবং সমগ্র অর্থনীতির ক্রেডিট চাহিদাকে হ্রাস করবে। তা আবার আমদানী চাহিদা হ্রাস করে চলতি হিসাবের ঘাটতির উন্নতি ঘটাবে।

ব্যালেন্স অব পেমেন্টের ভারসাম্যহীনতার আরও উন্নতি হবে যদি বেসরকারি খাতের করপোরেশনগুলোর বৈদেশিক ঋণের পরিশোধের বাধ্যবাধকতা স্বল্প মেয়াদে সৃষ্টি না হয়। বেসরকারি খাতের করপোরেশনগুলো যারা বিনিময় হার ঝুঁকির তোয়াক্কা না করে বিদেশি ঋণদাতাদের কাছ থেকে ঋণ নিয়েছে, তাদের কাজ হলো দায় পরিশোধের শর্তাবলী পুনর্গঠন করতে বাধ্য হবে। কিন্তু অসাধু ব্যক্তি খাতের ঋণগ্রহীতাদের শৃঙ্খলাবদ্ধ করার সর্বোত্তম উপায় হল ন্যায্য-মূল্যে টাকা-ডলারের বিনিময় হার নির্ধারণ করে দেওয়া। কোনোভাবেই  কৃত্রিমভাবে অতিমূল্যায়িত মুদ্রা বিনিময় হার দিয়ে অসাধু ব্যাক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রন করা যাবে না।  

চলতি হিসাব তথা ব্যালানস অব পেমেন্টের (বিওপি) স্থিতিশীলতার সবচেয়ে বড় বাধা হল অতিমূল্যায়িত টাকার একাধিক বিনিময় হার। আসলে মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার ২৫ শতাংশ অবমূল্যায়ন হলেও এটা দাবী করার কোনো কারন নেই যে টাকার মূল্য সুষমভাবে নির্ধারণ করা হয়েছে।

আইএমএফ’র বিওপি (ব্যালেন্স অব পেমেন্ট) সহায়তা স্বল্প থেকে মধ্যমেয়াদে বৈদেশিক মুদ্রা বাজারের অস্থিরতা কমিয়ে দেবে। আমি নিশ্চিত যে, সরকার দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকেও নতুন দীর্ঘমেয়াদী ঋণের সন্ধান করবে। উল্লেখ্য, সামগ্রিক জাতীয় বৈদেশিক ঋণ এখনও জিডিপির ২৫ শতাংশের নিচে রয়েছে।  

কিন্তু সরকারের পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জন্য অগ্নিপরীক্ষা হচ্ছে মুদ্রা বাজারে এবং ফরেক্স মার্কেট (বৈদেশিক মুদ্রা বাজার) উভয় ক্ষেত্রেই ভারসাম্য পুনরুদ্ধার করা। সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অভিন্ন লক্ষ্য হওয়া উচিত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ স্থিতিশীল করে টাকা-ডলারের একাধিক বিমিময় হারকে একীভূত করা। এটি অর্জনের একমাত্র উপায় হল- বাজার ভারসাম্যে না পৌঁছানো পর্যন্ত সুদের হার এবং মুদ্রা বিনিময় হারকে অবাধে সমন্বয় করার অনুমতি দেওয়া। এমন বিমিময় হার ও মুদ্রা নীতি বৈদেশিক মুদ্রার সরবরাহ ও চাহিদার পরিবর্তনের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ও টাকার বিনিময় হারকে স্থিতিশীল করবে।

(লেখায় প্রদত্ত মতামত তার একান্ত ব্যক্তিগত এবং কমিশনের বক্তব্য নয়)

বিডি প্রতিদিন/কালাম



এই পাতার আরো খবর