সরকারের আমদানি করা সার বন্দর থেকে গুদামে পৌঁছাতে ব্যর্থ হওয়া পরিবহন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান পোটন ট্রেডার্সের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে শিল্প মন্ত্রণালয়। নির্দেশ পাওয়ার পর প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে মামলা করার প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন (বিসিআইসি)।
পোটন ট্রেডার্সের বিরুদ্ধে গত দুই বছরে আমদানি হওয়া প্রায় আড়াই লাখ টন সার আত্মসাতের বিষয়টি বিসিআইসির তদন্তে উঠে এসেছে। এদিকে সরকারিভাবে আমদানি করা ৭২ হাজার টন রাসায়নিক সার আত্মসাতের অভিযোগ অনুসন্ধানে মাঠে নামছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
বিসিআইসি সূত্র জানায়, পোটন ট্রেডার্সের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার অনুমতি চেয়ে গত ২০ ডিসেম্বর শিল্প মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেয় বিসিআইসি। চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে চিঠি দিয়ে এ বিষয়ে যাবতীয় আইনি পদক্ষেপ নিতে বিসিআইসিকে নির্দেশ দেয় শিল্প মন্ত্রণালয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে শিল্প মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (রাষ্ট্রায়ত্ত করপোরেশন) এস এম আলম বলেন, বিসিআইসির চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে যাবতীয় বিষয়ে আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি কী পদক্ষেপ নিচ্ছে, সেটাও জানাতে বলা হয়েছে। তিনি আরো বলেন, স্বল্প সময়ের মধ্যে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব।
কী ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে, জানতে চাইলে শিল্প মন্ত্রণালয়ের সচিব জাকিয়া সুলতানা বলেন, ‘বিধি মোতাবেক জরিমানা বা মামলা করা হবে। সার পৌঁছে দেওয়ার জন্য তাদের (পোটন ট্রেডার্স) সময় দিয়েছিলাম, তারা ব্যর্থ হচ্ছে। এখন আমরা কঠোর অবস্থানে যাচ্ছি।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিসিআইসির শীর্ষ পর্যায়ের একজন কর্মকর্তা গতকাল বলেন, আইনি পদক্ষেপ হিসেবে পোটন ট্রেডার্সের বিরুদ্ধে মামলার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। তবে তার আগে প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে করা সার পরিবহন চুক্তির শর্তের দিকগুলো খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
শিল্প মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সরকারের আমদানি করা প্রায় দুই লাখ ৫১ হাজার টন সার পোটন ট্রেডার্স সরকারের নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কাছে পৌঁছে দিতে পারেনি। এর মধ্যে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ৮০ হাজার টন এবং মোংলা বন্দর থেকে পাঠানো ৯৮ হাজার টন সার বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনকে (বিএডিসি) বুঝিয়ে দিতে পারেনি। এ ছাড়া বিসিআইসিকে ৭২ হাজার টন সার পৌঁছে দেয়নি। এই পরিমাণ সারের ক্রয়মূল্য এক হাজার ৩৮২ কোটি টাকা। বিসিআইসির প্রাথমিক তদন্তে সার গায়েবের বিষয়টি উঠে আসায় বিসিআইসির যাবতীয় কার্যক্রম থেকে গত ১৫ ডিসেম্বর পোটন ট্রেডার্সকে নিষিদ্ধ করা হয়। এ ছাড়া মন্ত্রণালয়ের চিঠির নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে এ বিষয়ে কাজ শুরু করেছে বিসিআইসি। রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বিএডিসি কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীন বলে বাকি সারের বিষয়ে আলাদাভাবে ব্যবস্থা নিতে হবে।
সূত্র জানায়, বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সার আত্মসাতের বিষয়টি বিসিআইসিকে জানানোর পর গত ১০ নভেম্বর প্রথম তদন্ত কমিটি গঠন করা হয। সেই কমিটি গত ৭ ডিসেম্বর প্রতিবেদন দাখিল করে। সেই প্রতিবেদনে পোটন ট্রেডার্সের যাবতীয় সার আত্মসাতের তথ্য উঠে এসেছে। পোটন ট্রেডার্সের মালিক নরসিংদী-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য কামরুল আশরাফ খান পোটন। একই সঙ্গে তিনি সার ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএ) চেয়ারম্যান। গত ২৬ বছর সার ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছেন তিনি।
শিল্প ও কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ইউরিয়া সার আমদানি করে শিল্প মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বিসিআইসি। বাকি সার আমদানি করে কৃষি মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বিএডিসি। বিএডিসির সার পরিবহনের জন্য ঠিকাদারির কাজ করে আসছে পোটন ট্রেডার্স। কিন্তু ২০২০-২১ সালের এক লাখ ৭৮ হাজার ৭০০ টন সার সরবরাহ করতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি। এই সারের ক্রয়মূল্য ৮০০ কোটি টাকা। ২০২০-২১ সালে আমদানি করা এই সার গত বছর মে মাসের মধ্য বিএডিসির বিভিন্ন সার গুদামে পৌঁছানোর কথা ছিল। কিন্তু পোটন ট্রেডার্স সার না দিয়ে কালক্ষেপণ করছে। বিএডিসি কর্তৃপক্ষ আমদানি করা সার দ্রুত বুঝিয়ে দিতে বারবার চিঠি দিলেও কোনো সাড়া পায়নি।
জানা গেছে, বিদেশ থেকে আমদানির পর সারের জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দর ও মোংলা বন্দরে পৌঁছে। এরপর পোটন ট্রেডার্স সার বিভিন্ন পয়েন্টে নিয়ে গুদামে পাঠাত। গুদামে সার না পৌঁছা পর্যন্ত বিএডিসি জানত না পোটন ট্রেডার্স সার কোথায় মজুদ রাখে। এ সুযোগ নিয়ে পোটন ট্রেডার্স সার কালোবাজারে বিক্রি করে টাকা আত্মসাৎ করে। বিসিআইসির তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, ৭১ হাজার ৯১৬ টন ইউরিয়া সার আত্মসাৎ করেছে পোটন ট্রেডার্স।
এ বিষয়ে জানতে কামরুল আশরাফ খান পোটনের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তিনি ফোন ধরেননি। পরে ফোনে বার্তা পাঠালেও সাড়া দেননি তিনি।
মাঠে নামছে দুদক : এদিকে সরকারিভাবে আমদানি করা ৭২ হাজার টন রাসায়নিক সার আত্মসাতের অভিযোগ অনুসন্ধানে মাঠে নামছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। গত ৫ জানুয়ারি হাইকোর্ট অভিযোগটি অনুসন্ধান করে দুই মাসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে দুদককে নির্দেশ দিয়েছেন। এরই মধ্যে হাইকোর্টের আদেশের বিষয়ে দুদকে লিখিতভাবে অবহিত করা হয়েছে। শিগগিরই একটি কমিটি গঠন করে অনুসন্ধানকাজ শুরু হবে। দুদক সূত্র কালের কণ্ঠকে এসব তথ্য নিশ্চিত করেছে।
জানতে চাইলে দুদকের সচিব মো. মাহবুব হোসেন বলেন, ‘উচ্চ আদালত আমাদের যে নির্দেশনা দেবেন, আমরা সেই নির্দেশনা পালন করব। সার আত্মসাতের ঘটনায় অনুসন্ধানের যে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, তা আমরা জানতে পেরেছি। অভিযোগটির অনুসন্ধানের লক্ষ্যে শিগগিরই একটি কমিটি গঠন করা হবে।’
গত ৫ জানুয়ারি সার আত্মসাৎ নিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদন নজরে আনার পর বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি খিজির হায়াতের হাইকোর্ট বেঞ্চ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে রুলসহ আদেশ দেন। সরকারিভাবে আমদানি করা ৭২ হাজার টন রাসায়নিক সার আত্মসাতের অভিযোগটি দুই মাসের মধ্যে দুদককে অনুসন্ধান করে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আর অভিযোগের বিষয়ে বিসিআইসি চেয়ারম্যানকে দুই সপ্তাহের মধ্যে ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়েছে।
বিডি প্রতিদিন/হিমেল