ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয়ার জেরে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের হাতে নির্মম নির্যাতনে নিহত বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ছাত্র আবরারর ফাহাদকে একটি কবিতা লিখেছেন ও আবৃত্তি করেছেন বুয়েটের আরেক ছাত্র (১৬ ব্যাচ) আমির ফয়সাল। কবিতাটি বুয়েট শিক্ষার্থীদের ফেসবুক পেজ ‘বুয়েটিয়ান’ এ প্রকাশ করা হয়েছে। এরপরই কবিতাটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে।
পাঠকদের জন্য কবিতাটি তুলে ধরা হলো-
আমি আবরার ফাহাদ সাম্রাজ্যবাদীদের করাল থাবায় সয়েছি মৃত্যুর করাঘাত। মফস্বলের সরল জীবন যাপনে বেড়ে উঠা ছিল আকাশের মতো সুবিশাল স্বপ্ন আর জ্ঞানের প্রতি প্রগাঢ় আকুলতা, ইচ্ছে ছিল দেশের জন্য কিছু করার তাই সুযোগ থাকতেও রাখিনি পা বিদেশের মাটিতে দেশপ্রেমের যে ব্রতী গ্রহণ করেছিলাম তা নিয়ে এসেছে মোরে দেশসেরা বিদ্যাপীঠে। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস! জ্ঞানের এই ভূস্বর্গেই পড়ে রইলো মোর লাশ। ছোট্ট বেলা থেকে কত স্বপ্ন দেখতাম বড় হয়ে একদিন বুয়েটে পড়ব, দাপিয়ে বেড়াব দেশ-বিদেশ। কিন্তু আমার জানা ছিল না এখানে শুধু জ্ঞানই তৈরি হয় না, হয় কিছু শিক্ষিত সন্ত্রাস। জ্ঞানের চর্চা করতে চায় যারা, তাদের বানিয়ে রাখে দাস জনমনে সঞ্চার করে ত্রাস। আমি আবরার ফাহাদ দেশপ্রেমের জন্য সয়েছি মৃত্যুর করাঘাত প্রতিদিনের মতো এশার শেষে পড়তে বসেছি চিপস হাতে বাহির থেকে এলো ডাক ‘এই শালা আবরার ফাহাদ, চল ২০১১-তে’ চোখেমুখে মোর রাজ্যের আতঙ্ক, কী দোষ করিয়াছি ডেকেছে যে মোরে কুখ্যাত টর্চার সেলে, গিয়ে শুনি নরপিশাচ ড্রাকুলার মতো হায়েনার হর্ষ ধ্বনির মতো প্রকম্পিত হচ্ছে সেলের প্রতিটি ইটপাটকেল ব্যঙ্গাত্মক অট্টহাসিতে হায়েনারা উল্লাসে বলে- ‘আয় শালা তোর মনে নাকি অনেক জ্বালা, আজ মিটিয়ে দেব তোর দেহের শব তেল’ ক্ষুধার্ত হায়েনার দল ঝাঁপিয়ে পড়ে মোর শান্ত বিনয় দেহের উপর। স্ট্যাম্পের রোলার স্টিক দিয়ে ভেঙে গুড়ো করে দিল বক্ষ পাজর আমার করুণ আত্মচিৎকারে স্তব্ধ হয়ে পড়ে শেরে বাংলার প্রতিটি প্রাঙ্গন রঙিন গামছা দিয়ে মোর মুখটি বেঁধে চলে আরও দুঘণ্টা ঘাতকের প্রহরণ বুঝিতে পারিলাম, আজি হয়েছে মোর মৃত্যু পরোয়ানা জারি। শান্ত নিথর মোর দেহখানি লুটিয়ে পড়ে মেঝে, করে আহাজারি হুশ ফিরে দেখি আরও কিছু নতুন ঘাতক, মদের বোতল হাতে হেলান দিয়ে বসা হালকা খাবার আর ব্যথানাশক খাইয়ে শুরু হলো আবার পীড়ন সর্বনাশা। জীবন প্রদীপ নিভে যাচ্ছে মোর, নেই আর বোঝার বাকি মমতাময়ী মায়ের স্নেহভরা চুম্বন আর তার কোলে মাথা রেখে ঘুমানোর স্মৃতি দৃশ্যপটে আঁকি। আমি আবরার ফাহাদ ন্যায়ের পথে লড়ে সয়েছি মৃত্যুর করাঘাত সন্ধ্যা রাতে চিপস হাতে যে অঙ্ক কষতে বসেছিলাম সেটা যে আর শেষ করতে পারব না বুঝতে পারিনি, খোদা তায়ালার কাছে লাখো শুকরিয়া আমার এমন করুণ চাহনি, অসহায় গোঙানি মা তা দেখতে পায়নি। নিথর দেহ স্তব্ধ বক্ষ, গুনছি মৃত্যুর ক্ষণ বেদর মারছে এখনও গলেনি ঘাতকের মন, অভিনয় নাকি করছি আমি কমাতে মোর সাজা এখনও নাকি দুঘণ্টা যাবৎ মেরে নেয়া যাবে মজা! আমি আবরার ফাহাদ সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে বলে হয়েছি শাহাদাৎ হে দয়াময়, রহমান রহিম, হে অন্তর্যামী তোমার এই গোলামেরে দিও শাহাদাতবরণ, করো না বদনামি। যখন বুঝিল তারা মোর দেহে আর প্রাণবায়ু নেই সিঁড়ির রেলিংয়ে ফেলিয়া দিল মোরে সকলের অজান্তেই। হত্যার দায় কীভাবে ঢাকিবে, কীভাবে হবে পার গাঁজা, মদের বোতল রেখে দিত চাইলো মোর ঘরে এক দস্যু জানোয়ার রাত্রীরা অমানবিক রক্তিম চিহ্ন কিছুতেই যাবে না ঢাকা আর চর্মরোগের বাহানা জানালো এক জানোয়ার কুলাঙ্গার। কী অপরাধ ছিল মোর, কী দোষ করিয়াছি আমি বহিঃশত্রুর বিরুদ্ধে বলায় কি মোর এই বদনামি! স্বার্থের তরে বিবেক যারা শত্রুর কাছে করেছে বিক্রয় তারা মোর ফুলের কথায় ভুলের আভাস লুটায়ে লয়। আমি দেশদ্রোহী কিছু করি নাই ভাই, সত্য কথাটাই দেশপ্রেমে বলেছি। যারা আমার দেশকে চুষে খেতে চায়, মুজিবের মতো তাদের বিরুদ্ধে লড়েছি এ পথে যদি মোর মৃত্যু আসে ভয় পাই না তো, ভয় পাই না কবি আল মাহমুদের ভাষায় করে যাই ফরিয়াদ ‘মৃত্যুর ফেরেস্তা এসে যদি দেয় যাওয়ার তাকিদ; ভালোমন্দ যা ঘটুক মেনে নেবো এ আমার ঈদ’ আমি আবরার ফাহাদ দেশপ্রেমের জন্য সয়েছি মৃত্যুর করাঘাত আমি মরেছি ঠিকই কিন্তু মরে গিয়ে আমি প্রকৃত বেঁচে গেছি থাকতে হবে না আর এই পাপের রোষানলে। তোমরা যারা অন্যায় দেখে জুলুম সহে চুপটি করে আছো বসে একে কি বাঁচা বলে? অত্যাচার নির্যাতন নিপীড়ন নিষ্পেষণে আজ জর্জরিত বাংলার প্রতিটি জনপদ তিস্তা মহানন্দা ব্রহ্মপুত্র করোতোয়া ফেনী পদ্মা মেঘনা যমুনার অশান্ত টলটলে জলরাশি আজ দেশের মানুষের লোনা কান্নায় বিবর্ণ। হে বন্ধু, আমার অকাল মৃত্যুতে দ্রোহের তপ্ত আগুনে তোমার ফুল্কি চঞ্চল হয়ে উঠে না আমার মায়ের করুণ কান্নায় কি তোমার মায়ের কান্নার দৃশ্য চোখে ফুটে উঠে না? সীমান্তে আমার বোনের বস্ত্রহীনা ধর্ষিত ঝুলন্ত লাশ কি তোমাকে স্বজাতির চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে না? উপকূলে আমার দেশের মানুষের ওপর নজরদারির জন্য বসানো রাডার আর আমার দেশে শত্রুসেনার অবাধ চলাফেরা কি সাইমুম মরুঝড় তোলে না তোমার চেতনায়? যে জমিনের প্রতিটি ধূলিকনা, আমার পূর্ব পুরুষের সাহসী রক্তে কেনা- সেই মাটি রক্ষার দায়িত্ব কি তোমাকে দেশাত্ববোধের দুরন্ত চেতনায় উজ্জীবিত করে না? হে বন্ধু, আমার লোহিত রক্তের শপথ নিয়ে, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে, হাতে হাত রেখে স্বাধীনতার ঝঙ্কার তুলো, কাঁপিয়ে তোলো বহিঃশত্রু আর তাদের দালাল ঘাতকদের হৃৎপিন্ড। আমি আবরার ফাহাদ সাম্রাজ্যবাদীদের করাল থাবায় সয়েছি মৃত্যুর করাঘাত আমি মরেছি ঠিকই কিন্তু আমার আত্মা মরে নাই আমার আত্মা আজ ১৬ কোটি আবরার হয়ে ভেসে বেড়াচ্ছে বাংলার প্রতিটি পথে-প্রান্তরে মা, তোমার এক বুক খালি করে পাড়ি দিলাম অনন্ত মহাকালে আর এক বুকে ফাইয়াজকে (ছোট ভাই) জড়িয়ে ধরে রেখো চিরতরে। আমার বিজ্ঞান, রাজনীতি ধর্মীয় সকল বই আজ থেকে তার বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’টা তার হাতে দিয়ে বলবে- দেশপ্রেমের যে ব্রতী আমি গ্রহণ করেছিলাম, সেই আদর্শে যেন নিজেকে গড়ে তোলে মা, আমায় ক্ষমা করে দিও তোমায় ছেড়ে পার দিলাম অনন্ত মহাকালে অনন্ত মহাকালে মোর যাত্রা অসীম মহাকাশের অন্তে…
বিডি প্রতিদিন/এনায়েত করিম