ঢাকা, শুক্রবার, ৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

আজকের পত্রিকা

একজন রাজীব এর জীবনী (৩)
দেবী গাফ্ফার
অভিনেতা রাজীব ও দেবী গাফ্ফার

‌‌‘লেখকের কথা’

অনেকেই জানতে চান, এই গল্প সত্যি কি-না। জ্বি, শতভাগ সত্যি। এটাকে গল্প না বলে ঘটনা বলা যায়। রাজীব সাহেব মাঝে মাঝে বলতেন, আমার এই ঘটনা তুমি একদিন লিখো। এই ব্যথাতুর কাহিনী, দুমকির কিছু মানুষ আর আমি ছাড়া তেমন কেও জানে না। ক’দিন আগে প্রচণ্ড শরীর খারাপ অনুভব করি। তাতেই মনে হলো, এই কাহিনী আমি না বললে আর কোনদিন কারও জানা হবে না। ‘দেবী গাফ্ফার’

শুরু... এটা ৬৬ সালের দিকে। আজমদের বৈঠক খানায় বিচার বসে। বেচারা বারেক, একা দাঁড়িয়ে, মাথা নিচু করে চরম অপমানজনক কথাবার্তা হজম করতে থাকে। শেষ কথা ছিলো, কুকুর এর পেটে ঘি হজম হয়? সেদিন এই প্রশ্নের কোন উত্তর ছিলো না। একবারও বলতে পারেননি, আমি আপনাদের মেয়েকে ভালো রাখবো।

যন্ত্রণায় ছটফট করে নদীর পাড়ে সারা রাত কেটে যায়। এ ছিলো অপমানের যাতনা। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিতে থাকে, এখানে আর নয়। এখানকার মানুষ, বাচ্চা-বুড়া সারাক্ষণ মনে করিয়ে দেয়, বারেক কে? জন্ম একঘরে, লালন-পালন অন্য ঘরে। পালা বারেক নাম হয়ে গেলো। নিজের নামের প্রতি ঘৃণা জন্ম নেয়। যে রাস্তা দিয়ে আসা-যাওয়া সেই রাস্তাও বার বার মনে মনে করিয়ে দেয়, তুমি রাস্তার সন্তান। মেট্রিক পরীক্ষা দিয়ে ঢাকা চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।

মেট্রিক এর রেজাল্ট আসে, একা একা পড়ে সেকেন্ড ডিভিশনে পাস। ঐ গ্রাম এর প্রথম মেট্রিক পাস ছেলে বারেক। দলে দলে লোক দেখতে আসে। কথা কম বলা বারেক আশার আলো দেখতে পায়। সম্পর্কে চাচাত ভাই, রাজ্জাক। রাজ্জাক ভাই ঢাকায় চাকরি করেন। উনার কাছে গিয়ে বলেন, ভাই আমাকে আপনার সাথে ঢাকা নিয়ে চলেন। যা কাজ দিবেন আমি করবো।

মা-বাবা ফেলে রাজ্জাক ভাই এর হাত ধরে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন। রাজহংস জাহাজে চড়ে। এ যেন এক ধরনের পালানো। আর কেও অপমান করবে না।

সিদ্ধান্ত হয় মাসে পচাত্তর টাকা বাড়ি থেকে পাঠানো হবে। পচাত্তর টাকা সম্বল নিয়ে অজানা-অচেনা ঢাকা শহরে নামলেন।

এটা ৬৯ সন। পরের দিন সকালে রাজ্জাক ভাই বলেন, তৈরি হয়ে নাও। কেরামত চাচার বাসায় তোমাকে নিয়ে যাবো, যদি কোন চাকরি হয়। তাড়াতাড়ি করে সাদা পায়জামা ও কুর্তা পরে চুলে ভালো করে তেল দিয়ে দেব আনন্দ স্টাইলে চুল আঁচড়িয়ে রওয়ানা হয়। যার কাছে যাওয়া হচ্ছে উনি সি.এস.পি. মোহাম্মদ কেরামত আলী। পরবর্তীতে ধর্মমন্ত্রী ও বাণিজ্যমন্ত্রী ছিলেন। সম্পর্কে বারেক এর চাচা হন।

রাজ্জাক ভাই পরিচয় করিয়ে দেন। কাসেম কাকার পালক সন্তান, বারেক। যদি কোন চাকরি দেন বেচারা খেয়েপরে বেঁচে থাকবে। কেরামত চাচা আপাদমস্তক দেখে বলেন, ও কি কাজ করবে ওর পোশাক দেখে মনে হচ্ছে নায়ক হতে চায়। সাথে সাথে মাথা ঝিমঝিম করে। কানে বাজতে থাকে- নায়ক হতে চায়, নায়ক হতে চায়। বার বার একই কথা ঘুরে ফিরে কানে বাজে। চাকরি হলো। তিতাস গ্যাস কোম্পানি গ্যাস সংযোগ দেওয়ার সময় রাস্তা কাটা হচ্ছে, পাইপ বসছে। বারেক এর কাজ হলো,পাইপ টেনে আনা-নেওয়া। ডেইলি লেবার। এটাও অস্থায়ী চাকরি।

এখানেও পচাত্তর টাকা বেতন। মাস শেষ হওয়ার আগেই টাকা শেষ হয়ে যায়। আসা-যাওয়া, ঘরভাড়া ও খাওয়া। বিড়ি কেনার টাকা থাকে না। কাজের ফাঁকে রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকে, কোন পথচারী যদি তার খাওয়া বিড়ি বা সিগারেটের শেষটুকু ফেলে যায়। আহ একটা পড়লো, তাড়াতাড়ি কুড়িয়ে নিয়ে দুই টান। টি অ্যান্ড টি কলেজে ভর্তি হলো। পাউরুটি ও কলা হয়ে গেল জীবনের একটা অংশ। মেস এ থাকা। একাত্তরে ঢাকা ছেড়ে আবার বাড়ি ফিরে মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়ে পড়লো। নিয়তির অপার লীলা, কে খণ্ডন করবে। বাবা আশ্চর্য রকমের সিদ্ধান্ত নিলেন। মিনতি করে বসলেন। বারেক ভাবতে থাকে, এই বাবা না থাকলে আজকে জীবন কি হতো? আবার মনের ওপর শুরু হলো নতুন ঝড়। ইচ্ছা-অনিচ্ছা কাকে জানাবে। কার কাছে যাবে। বাবার আদেশ না শুনলে বেইমানি হবে। অসহায় বারেক কৃতজ্ঞতার খাতিরে বাবার আদেশে তার বোনের মেয়েকে বিয়ে করতে রাজি হলেন। নিজের ‘না’ টুকু কোরবানি দিয়ে দিলেন।

‘চলবে...’

(ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)

বিডি-প্রতিদিন/শফিক



এই পাতার আরো খবর