ঢাকা, শুক্রবার, ৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

আজকের পত্রিকা

এই ঘটনা একজন আফিফার (শেষ)
দেবী গাফফার
দেবী গাফফার

‘আমি আফিফা’

মাকে সব বলি, মা ক্ষণকাল স্তব্ধ রইলেন। বিড়বিড় করে কি যেনো বলতে থাকেন। হঠাৎ বলে বসলেন, আচ্ছা আমাকে এক কাপ চা খাওয়াতে পারবি? বড় কাপে করে দিবি, হ্যাঁ... আমার ভিষন ঘুম পাচ্ছে। আমি হতভাগ হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম। আমার পৃথিবী এমন কেনো ভাবতে ভাবতে চা নিয়ে আসি। চা না খেয়ে, আমাকে কিছু না বলেই মা চলে গেছেন। রাতে বাচ্চাদের সাথে ঘুমিয়ে পড়ি। পরেরদিন বিকালে বাবা এসে বলেন, মাকে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। চার নম্বর বোনটির বয়স এক-দেড় বছর। বুকের দুধ খায়, ওর কান্না থামানো যাচ্ছে না। বাবার সাথে বাসায় চলে যাই। মা নেই, কোথাও নেই। বোনটাকে খালার কাছে দিয়ে আসি। বছর পার হয়ে যায়, মার কোনো খবর পাই না। মার খবর না পেয়ে বাবা বিয়ে করে ফেললেন। ঘরে সৎ মা আসলো। আমার বিয়ের পাত্র নিয়ে আসলেন। বয়স চল্লিশ এর উপরে। আমি কোন কথা বলি না, ভাবি বয়স দিয়ে কি হবে? পাত্র আমাকে দুবাই নিয়ে যাবে। ছোট বোনগুলোর দায়িত্ব নিতে পারবো। বিয়ে হয়ে গেলো, আমি যেনো বাঁচলাম। আমাকে উনার সাথে করে দুবাই নিয়ে গেলেন। যে বাসায় উঠালেন, ছোট ছোট অনেকগুলো রুম। পরপর দু’টি দরজা তালা খুলে আমাকে একটা রুমে নেওয়া হলো। ছোট্ট একটি রুম কোনমতে দু’জনের থাকার জায়গা হবে। পাকিস্তানি এক লোক বাসার দেখাশোনার দায়িত্বে। আমার উনি ঐ লোকের সাথে নিচু গলায় কিছু বলে আমাকে বললেন, থাকো আমি কাজ সেরে আসি। রাত বাড়তে থাকে উনি আসেন না। রাতে পাকিস্তানি লোকটা এক পেকেটে খাবার দিয়ে যান। বার বার জিজ্ঞেস করি উনি কোথায়, কি বলে গেলেন? পরেরদিন সকাল যায় বিকেলে যায় উনি আসেন না। ছোট ছোট রুমগুলোতে আরও মেয়ে আছে। আমার কান্না দেখে পাশের রুমের মেয়েটা হাত ধরে বসিয়ে বললো, উনার ফিরে না আসার কারণ। আকস্মিক কথায় কিছুক্ষণ এর জন্য আমার পৃথিবী থমকে গেল। আমার পালানোর কোন রাস্তা রইলো না। আত্মহত্যা করারও কিছু খুঁজে পেলাম না। প্রতিদিন খোরশেদ রূপে আট-দশজন হায়েনা আসতে থাকে। প্রতিদিন আমার দশবার মরণ হয়। যে মরণে কোন জানাজা হয় না, কবরও হয় না। এই যে আমার পায়ের বুড়ো আঙুল? এই দাগ হায়েনার দাঁতের চিহ্ন।

কোনো এক দুপুরে, বাংলাদেশি এক ছেলে আসে। আমার নাম বাড়ি কোথায় সব জিজ্ঞেস করে। জীবনের সমস্ত ঘটে যাওয়া ঘটনা খুলে বলি। অনুরোধ করি আমাকে বাঁচানোর। ওর নাম বেলাল, প্রতিদিন একবার আসে। আমিও অপেক্ষায় থাকি বেলাল কখন আসবে এই রাক্ষসপুরী থেকে আমাকে মুক্ত করে নিয়ে যাবে। পাকিস্তানি লোকটাকে টাকা দিয়ে আমাকে দু’দিন সমুদ্র পাড়ে ঘুরতে নিয়ে যায়। আর আমার মুক্তির রাস্তা খুঁজতে থাকে। তৃতীয় দিন বের হয়ে আমাকে বলে, তুমি থানায় গিয়ে সব বলে সারেন্ডার কর। পুলিশই তোমার ঢাকা যাওয়ার ব্যবস্থা করবে। আর শোন, আমি তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি। কিছুদিন আমার জন্য অপেক্ষা করো, আমি তোমাকে বিয়ে করবো। ওরা আমাকে ছাড়বে না। আজকেই এই শহর আমাকে ছাড়তে হবে। আমাকে থানার সামনে নামিয়ে বেলাল দ্রুত চোখের আড়ালে চলে যায়।

লেখকের কথা রাতে একটা ফোন আসে এয়ারপোর্ট থেকে। পটুয়াখালীর এক ট্যাক্সি ড্রাইভার। ড্রাইভার : ম্যাডাম কক্সবাজারের এক মেয়ে বিপদে পড়েছে, আপনাকে নাকি চিনে। আফিফা নাম। নিয়ে আসবো? আমি চিনতে পারি, ছোট বেলায় দেখেছি। ড্রাইভার নিয়ে আসে। ঐ রাতেই সব ঘটনা বলে। এই ঘটনা ২০০৭ এর দিকে। সব শুনে আমি বাকহারা হয়ে যাই। ওকে ছয় মাস আমার কাছে রাখি। বেলালের সাথে আমারও কথা হয়। প্রতীক্ষার ছয় মাস পর বেলাল আসে। আফিফার জীবনে নতুন সূর্য উদয় হয়, ঝকঝকে রোদ নিয়ে নতুন সকাল আসে। ওরা কক্সবাজার রওয়ানা দেয়। ভাগ্যবতী আফিফার গায়ে হলুদ হয়, মাইকে গানবাজনা হয়ে বেলাল নামের ফেরেশতার রূপে হাত ধরে শ্বশুরবাড়ি রওয়ানা দেয়। সব পুরুষ খারাপ হয় না, ভালো মানুষ আছে। ওদের এখন দুই রাজপুত্র। খোরশেদ পরিবারের করুণ পরিণতি বলে শেষ করা যাবে না। খোরশেদ এখন জেলে ঘাস কাটে। ইয়াবা মামলার এক নম্বর আসামি। ছোট বউ আমেনা দীর্ঘদিন ক্যান্সারে ভোগে গত বছর মারা গেছে। আমেনার মেয়ের অবস্থা আফিফার দুঃখকেও হার মানায়। মেয়ের বিস্তারিত নাইবা বললাম। অনেক বছর পর আফিফার মা পাগল অবস্থায় ফেরত আসে। কথা হলো প্রকৃতি কাওকে ক্ষমা করে না।

(ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)

বিডি প্রতিদিন/শফিক



এই পাতার আরো খবর