ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

আজকের পত্রিকা

এই সপ্তাহে শুরু হয়েছে চার কিংবা পাঁচের নামতা!
আমিনুল ইসলাম
আমিনুল ইসলাম

আমেরিকায় এখন সবচাইতে বেশি করোনা রোগী। ইতালি এবং চায়নার চাইতেও আমেরিকায় এখন করোনা রোগীর সংখ্যা বেশি; প্রায় ৮৫ হাজার! এই যখন অবস্থা; তখন বাংলাদেশের ভাগ্যে কি অপেক্ষা করছে; সেটা সহজেই অনুমান করা যায়।

এই লেখাটা বর্তমান করোনা পরিস্থিতি নিয়ে। তবে পুরো ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করার জন্য অন্য আরও অনেক কিছু ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন। বিজ্ঞান যেখানে উত্তর দিতে অপারগ, কল্পকাহিনী'র শুরু সেখন থেকে'ই।

একটা সময় মনে করা হতো কোন অদৃশ্য শক্তি মানুষের উপর বিরক্ত হয়ে ঘূর্ণিঝড়-ভূমিকম্প এইসব দিচ্ছে। মানুষ তখন ঘূর্ণিঝড় হলে অদৃশ্য শক্তি যেন তাদের উপর বিরক্ত না হয়, এই জন্য প্রার্থনা করতো, মানত করতো। একটা সময় মানুষ প্রশ্ন করা শুরু করল- কেন এমন হয়?

যেই না মানুষ প্রশ্ন করা শুরু করল, সেই সঙ্গে তখনকার সময়ের ধ্যান-ধারণাগুলোর সমালোচনা করা শুরু করল; দেখা গেল মানুষ নতুন নতুন সব আবিষ্কার কিংবা উত্তর নিয়ে হাজির হচ্ছে।

এই যেমন একটা সময় মানুষ বুঝতে শিখল ঘূর্ণিঝড় আসলে কোন অদৃশ্য শক্তির কাজ না বরং বায়ুর চাপ কিংবা ইত্যাদি কারণে ঘূর্ণিঝড় হয়। অর্থাৎ মানুষ তাদের প্রশ্নের উত্তরগুলো জানতে শুরু করল। যেই প্রশ্নের উত্তরই তারা দিতে পারত না; সেটা থেকে যেত অলৌকিক কিছু কিংবা কল্পকাহিনীর আড়ালে।

একটা সময় মানুষ মনে করতো সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘুরে। এরপর মানুষ নিজেরাই প্রশ্ন করতে শুরু করেছে- কেন? উল্টোও তো হতে পারে? এরপর এই মানুষই আবার আবিষ্কার করেছে- আসলে সূর্য না; পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘুরে।

এই যেমন ধরুন বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল নামে একটা জায়গা আছে; সেখানে অতীতে অনেক বিমান এবং সমুদ্র জাহাজ গিয়ে আর ফেরত আসেনি। বিজ্ঞানীরা সেই প্রশ্নের সমাধান দিতে না পারার কারণে এই নিয়ে তৈরি হয়েছে হাজার রকম কল্পকাহিনী।

বেশিদূর যেতে হবে না- এইতো বছর কয়েক আগে মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্সের একটা বিমান উধাও হয়ে গেল। আজ অবদি সেই বিমানের কোন খোঁজ কেউ করতে পারেনি। বিমানটা শেষপর্যন্ত কোথায় গিয়ে বিধ্বস্ত হলো; এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর আজ অবদি কেউ দিতে পারেনি। যার কারণে এই নিয়েও এখন নানান সব কল্পকাহিনী চালু আছে।

অর্থাৎ বিজ্ঞানীরা যখন'ই কোন একটা প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে পারেনি; তখন'ই সেটা নিয়ে কল্পকাহিনী চালু হয়েছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে সঠিক উত্তর দেওয়ার জন্য তো প্রশ্ন করতে হবে আগে। প্রশ্ন না করে নিশ্চয় আপনি ওই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবেন না।

আমাদের দেশের কিংবা ভারতীয় উপমহাদেশ অথবা মধ্য প্রাচ্যের দেশগুলোর সমস্যা হচ্ছে- সেখানে আপনি প্রচলিত কোন কিছু নিয়ে প্রশ্নই করতে পারবেন না! যেমন ধরুন অতীতে পদার্থবিদ্যা কিংবা গণিতের অনেক সূত্র ভারতীয় কিংবা আরবের বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছে।

তাহলে ভারতীয় উপমহাদেশ কিংবা আরবরা জ্ঞান-বিজ্ঞানে এতো পিছিয়ে কেন?

এর কারন হচ্ছে- সেখানকার রাজা-বাদশাহ এবং সরকারগুলো এই ধরনের আবিষ্কারকে কোন দিন পছন্দ করেনি। কারণ এই ধরনের আবিষ্কারগুলো প্রচলিত কল্পকাহিনীগুলোর উত্তর দিয়ে দিতে সক্ষম। আর আপনি যদি এই সব কল্পকাহিনীর উত্তর দিয়ে দেন; তাহলে মানুষ সব কিছু জেনে-বুঝে যাবে; তখন রাজা-বাদশাহরা আর মানুষের শাসন-শোষণ করতে পারবে না!

যার কারণে এই সব আবিষ্কারকে আমাদের মতো দেশগুলোতে কখনো ব্যবহার করা হয়নি উল্টো যারা আবিষ্কার করেছে- তাদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে।

অথচ ওই আবিষ্কার কিংবা তত্ত্বগুলো নিয়ে ইউরোপ-আমেরিকানরা জ্ঞান-বিজ্ঞান প্রযুক্তিতে অনেক এগিয়ে গিয়েছে। বলছি না, ইউরোপ-আমেরিকার রাজা-বাদশাহ'রা এমন ছিল না। তারাও ছিল। তারাও তাদের দেশের বিজ্ঞানীদের আবিষ্কারকে স্বাগত জানাত না। একটা সময় তারা তাদের ভুল বুঝতে পেরে ওই জায়গা থেকে সরে এসেছে এবং সকল ধরনের প্রশ্নকে তারা স্বাগত জানাতে শুরু করেছে।

আর আমাদের দেশে? আপনি প্রশ্ন করবেন! তাহলে'ই হয়েছে! উল্টো আপনাকে জেলে ভরে দিবে কিংবা বেঘোরে প্রাণটাও চলে যেতে পারে। যেই জায়গাগুলোতে সবচাইতে বেশি জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা হওয়া উচিত, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হচ্ছে অন্যতম।

সেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্ররা যদি শিক্ষককে প্রশ্ন করে; শিক্ষক উল্টো বকা দিয়ে বসে! আমি নিজেই হাজারো বার এই অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছি। যদি বকা নাও দেয়; একটা প্রচ্ছন্ন হুমকি তো আছেই- পরীক্ষায় ফেল করিয়ে দেবে কিংবা কম নাম্বার দিবে!

এটাই আমাদের সংস্কৃতি! কোনো প্রশ্ন করা যাবে না! সব কিছু মেনে নেও!

আমি দেশ এবং বিদেশ মিলিয়ে চারটা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি। ইউরোপের চারটা বিশ্ববিদ্যালয় আছে। এর মাঝে তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়'ই পৃথিবীর যে কোন র‌্যাকিং এ সেরা ১০০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঝে আছে। সুইডেনের লুন্ড ইউনিভার্সিটি, নেদারল্যান্ডসের লাইডেন ইউনিভার্সিটি এবং ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি।

এইসব লিখতে ইচ্ছে করে না। এতে মানুষ আবার মনে করে বসতে পারে- আমি নিজেকে জাহির করার জন্য বলছি। নিজেকে জাহির করার কোন ইচ্ছে আমার নেই। স্রেফ ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলার জন্য লেখা।

ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে পড়তে গিয়েছি। প্রোগ্রামের হেড প্রথম দিন আমাদের বললেন

-আমরা যা বলি, সব কিছু মেনে নিবে না। শিক্ষকরা যা পড়ায়, সব কিছু মেনে নিবে না। সব তত্ত্ব বা থিউরি এক কথায় মেনে নিবে না। মনের মাঝে যেই প্রশ্নেরই উদয় হবে; করে ফেলবে। প্রশ্ন না করলে আমরা এগুবো কি করে?

এই হচ্ছে জগত সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের কথা- প্রশ্ন না করলে এগুবো কি করে!

আর আমরা? আপনাদের জানিয়ে রাখি গতকাল বাংলাদেশ সরকার একটা ঘোষণা দিয়েছে। আপনারা অনেকে'ই হয়ত জানেন না। সেই সরকারি ঘোষণায় বলা হয়েছে- দেশের সকল মূল ধারা'র টেলিভিশন এবং সংবাদ পত্রগুলো যাতে করোনা নিয়ে কোন গুজব ছড়াতে না পারে; এই জন্য দেশের নানান সব মন্ত্রণালয়ের একেক জন সচিব'কে একেকটা টেলিভিশনের জন্য নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। কোন সচিব, কোন টেলিভিশনের তদারকি করবে; সেই নামগুলোও দিয়ে দেওয়া হয়েছে।

অর্থাৎ সরকার ধরে নিয়েছে, দেশের মূল ধারার টেলিভিশনগুলো করোনা নিয়ে গুজব ছড়াচ্ছে!

কি চমৎকার ব্যাপার, তাই না? এই যে গতকাল দেশের বিভিন্ন বাড়ি থেকে মাঝ রাতে আজান দেওয়া হলো (মাঝরাতে আজান দিলে নাকি করোনা হয় না!); এই গুজব কি টেলিভিশনগুলো ছড়িয়েছে?

এই যে এতোদিন ধরে বলা হলো মুসলমানদের করোনা হয় না; এই গুজব কি টেলিভিশনগুলো ছড়িয়েছে?

এই যে এতদিন ধরে বলা হলো করোনা হচ্ছে অমুসলিমদের উপর গজব; এই গুজব কি টেলিভিশনগুলো ছড়িয়েছে?

তাহলে, আপনাদের সকল রাগ-ক্ষোভ কেন টেলিভিশনগুলোর উপর গিয়ে পড়েছে? টেলিভিশনগুলোর উপর নজরদারি করার জন্য আলাদা করে কেন সচিব নিয়োগ দিতে হয়েছে?

উত্তরটা কিন্তু খুব সোজা!

কারণ টেলিভিশনগুলো খবর করছে- দেশের নানা প্রান্তে করোনা সন্দেহে মানুষ মারা যাচ্ছে। করোনা রোগীর সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে কিংবা যতটা সম্ভব মানুষকে তারা সচেতন করার চেষ্টা করছে!

সেটা কেন আপনাদের ভালো লাগবে? আপনাদের তো সেটা ভালো লাগার কথা না! টেলিভিশন কিংবা মূল ধারার মিডিয়া কিংবা লেখক হিসেবে আমি নিজেও "প্রশ্ন" করি কিংবা প্রশ্ন করতে পছন্দ করি। প্রশ্ন করলেই না উত্তর পাওয়া যাবে; এগুনো যাবে।

সেই প্রশ্ন আপনাদের ভালো লাগবে কেন?

প্রশ্নের উত্তর জেনে গেলে যে আপনাদের সমস্যা! তাই না? গুজব তো আসলে আপনারা'ই ছড়ান। আপনারা চান দেশে গুজব থাকুক। যাতে খুব সহজে সাধারণ মানুষকে দমন করা যায়।

এরপর আপনাদের লোকজন এসে প্রথম তিনের নামতা পড়বে এক সপ্তাহ জুড়ে! গত এক সপ্তাহে প্রতিদিন তিন জন করে করোনা রোগী এই বাংলাদেশে পাওয়া গিয়েছে। এই সপ্তাহে অবশ্য শুরু হয়েছে চার কিংবা পাঁচের নামতা!

আপনারা মনে করছেন- এই দেশের মানুষ এখনও ক্লাস ফোর কিংবা ফাইভে পড়ে; এদের চার কিংবা পাঁচের নামতা পড়িয়ে চুপ রাখা যাবে!

ভালো করে জেনে রাখুন- এই দেশের মানুষ এখন চার-পাঁচের নামতা নয়; ৪০-৫০ এর নামতাও গড়গড় করে বলে দিতে পারে।

যেই সচিবগুলো নিয়োগ দিয়েছেন টেলিভিশনগুলো'কে তদারকি করার জন্য; তাদের কি অন্য কোন দায়িত্ব দেওয়া যেত না?

করোনা সন্দেহে অনেক মানুষকে হাসপাতালগুলো নিতে চাইছে না। ডাক্তার'রা নিজদের প্রটেক্ট করার জন্য সঠিক পোশাক পাচ্ছে না। আপনাদের তো উচিত ছিল এই ব্যাপারগুলো দেখার জন্য আলাদা করে সচিব নিয়োগ দেওয়া। সেটা না করে কিনা আপনারা টেলিভিশনগুলো যাতে গুজব না ছড়ায়; এই জন্য সচিব নিয়োগ দিয়েছেন!

কথায় আছে- "বিপদে বন্ধুর পরিচয়!"

বাংলাদেশ শুধু একা না, পুরো পৃথিবী এখন মহাবিপদের মাঝ দিয়ে যাচ্ছে। এই বিপদের সময় আপনারা কেমন আচরণ করছেন, এর উপর নির্ভর করবে- আপনারা আমাদের বন্ধু নাকি শত্রু!

(ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)

বিডি প্রতিদিন/হিমেল



এই পাতার আরো খবর