ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

আজকের পত্রিকা

''তাই বলে কি আমি হেরে যাবো, কখনোই না''
আমিনুল ইসলাম

ডাক্তার'কে জিজ্ঞেস করলাম -আমি কি বেঁচে আছি?

ডাক্তার চমৎকার একটা হাসি দিয়ে বলেছে

-মনে তো হচ্ছে বেঁচে আছো। -তাহলে আমার এমন লাগছে কেন? -অনেক লম্বা একটা সময় তোমার জ্ঞান ছিল না, এই জন্য তুমি এখন খানিকটা ঘোরের মাঝে আছো। ১২ ঘণ্টার মাঝে'ই ঘোর কেটে যাবে।

আমি হাসপাতালের বেডে সোজা হয়ে শুয়ে আছি। ৪৮ ঘণ্টা আগে ছোটখাটো একটা অপারেশন হয়েছে আমার।

ফ্যামিলি ডাক্তার ফোন দিয়েছিল দিন তিনেক আগে। হঠাৎ করে জানালো:

-আমিনুল, তোমার অপারেশন'টা এখন'ই করে ফেলতে হবে। নইলে ভবিষ্যতে সমস্যা হতে পারে। -এই ভাইরাসের সময় না করলে'ই কি হচ্ছে না?

ডাক্তার এইবার বড় একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলেছে:

-আমি জানি, এই সময়ে হাসপাতালে আসা ঠিক না। চারদিকে ভাইরাস কিন্তু তোমার অপারেশনটা এখন'ই করিয়ে ফেলতে হবে।

ভোরে হাসপাতালে হাজির হলাম। কাউকে জানানোর প্রয়োজন মনে করিনি। এমনকি এই শহরে থাকা আমার বোন'কেও না। এই ভাইরাসের সময় কারো'ই আসলে হাসপাতালে যাবার অনুমতি নেই। এছাড়া বাসা থেকে বের হওয়াই তো অনিরাপদ। তাই একাই হাজির হতে হলো হাসপাতালে। অপারেশনের আয়োজন চলছে আর আমি ভাবছি- আচ্ছা, এই কঠিন সময়ে আমার কাকে মনে হচ্ছে?

হঠাৎ আবিষ্কার করলাম- আমার মনে হচ্ছে সেই সব মানুষদের কথা, যাদের আমি বার বার বিশ্বাস করেছি; অথচ এরা কি চমৎকার ভাবে'ই না সেই বিশ্বাস ভঙ্গ করেছে।

আচ্ছা, আমার এদের কথা মনে হচ্ছে কেন?

এদের প্রতি কোন ক্ষোভ কি আমি পুষে রেখেছি?

শুনেছি ভয়ানক বিপদ কিংবা কঠিন সময়ে মানুষ খুব কাছের কিংবা প্রিয়জনদের কথা ভাবে।

আচ্ছা, এরা কি তাহলে আমার প্রিয়জন ছিল? এরা কি করে আমার প্রিয়জন হয়! যারা বার বার বিশ্বাসের অমর্যাদা করেছে।

তাহলে আমি এদের কথা ভাবছি কেন?

এইসব ভাবতে ভাবতে'ই গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলাম।

জেগে উঠার পর ডাক্তার'কে প্রথম যে প্রশ্ন'টা করেছি

-আচ্ছা, আমি বেঁচে আছি তো?

আজ আড়াই দিন হয় হাসপাতালে আছি। অপারেশন করতে হবে, সেটা আমি অনেক আগে থেকে'ই জানতাম। কিন্তু এতো দ্রুত সময়ের নোটিশে করতে হবে, সেটা বুঝতে পারিনি। হাসপাতাল থেকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে- এই সময়ে হাসপাতালে যত কম থাকা যায়, তত'ই ভালো। পুরোপুরি সেরে উঠতে আরও সপ্তাহ খানেক লাগবে। কিন্তু ওরা আমাকে আজ'ই রিলিজ দিয়ে দিচ্ছে। বলেছে- বাসায় থেকে রেস্ট নিতে। হাসপাতালে থাকার চাইতে বাসায় থাকা'ই নিরাপদ।

হাসপাতাল থেকে বাসায় ফিরতে ফিরতে ভাবছিলাম- এই কঠিন সময়ে কেউ পাশে নেই!

কি এক অদ্ভুত সময় পার করছি আমরা পৃথিবীর নাগরিক'রা।

আচ্ছা, কারো কি আমার পাশে থাকার কথা ছিল?

খানিক আগে'ই ফেসবুক থেকে জানতে পারলাম এক লোক আত্মহত্যা করেছে। তার বউ তাকে ছেড়ে চলে গিয়েছে। ডিভোর্স দিয়েছে এই কষ্ট সহ্য করতে না পেরে অভিমানে সে আত্মহত্যা করেছে।

আচ্ছা, এই মানুষটার কি কোন আপনজন ছিল?

হয়ত ছিল। সে যাকে কিংবা যাদের আপনজন ভেবেছে, খুব কাছের মানুষ ভেবেছে; তারা হয়ত কোনদিনও আপন ছিল না। সে হয়ত সেটা বুঝতে'ই পারেনি।

যে অবহেলা এবং ঘৃণা নিয়ে আমি বড় হয়েছি; আমি জানি বেঁচে থাকার যুদ্ধটা কতোটা কঠিন।

যাকে সবচাইতে কাছের মানুষ মনে করেছি, আপনজন মনে করেছে; যার কাছে নিজেকে প্রকাশ করেছি; সেই মানুষটা বলে বসেছে

- আমার সব কিছু'ই অস্বাভাবিক। কথা বলা, চলাফেরা থেকে শুরু করে সব কিছু'ই। এমনকি আমার সঙ্গে কথা বলতেও তার সমস্যা।

অথচ আমার সব কিছু'ই তার কাছে বছরের পর বছর স্বাভাবিক ছিল। সে হয়ত এখন যে অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে; সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা তো দূরে থাক; খুঁড়িয়ে হাঁটার অবস্থাও হয়ত তার ছিল না। এখন যখন জোর পায়ে দাঁড়াতে পারছে; দৌড়ে বেড়াতে পারছে; তখন তার কাছে আমার সব কিছু'ই অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে। কারণ আমি আমার নিজেকে তার কাছে প্রকাশ করেছি।

তাই বলে কি আমি হেরে যাবো?

অবশ্য'ই না। কখনো'ই না।

অপারেশন শেষ হবার পর যখন আবিষ্কার করলাম বেঁচে আছি, নিজেকে'ই নিজে প্রশ্ন করেছি- আচ্ছা, জীবনের মানেটা কি?

এরপর মনে হলো- সেই ছেলেটার কথা, যার পড়াশুনার দায়িত্ব আমি নিয়েছিলাম। কলেজ পাশ করেছে, নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করে বিসিএস ক্যাডার হয়েছে। নিভৃতে আমি তার সকল পড়াশুনার খরচ বহন করেছি।

ছেলেটা এখন দেশের এই কঠিন সময়ে, এই করোনা যুদ্ধে দেশের সাধারণ মানুষগুলোর পাশে দাঁড়িয়েছে; নিজের জীবন বাজি রেখে যতটা সম্ভব মানুষের জন্য করছে; আমি তাকে লিখে পাঠিয়েছি

- তোমার ভয় হচ্ছে না?

ও আমাকে লিখেছে:

-আমার তো আজ রাস্তায় মুড়ি বিক্রি করার কথা। সেখান থেকে'ই আজ আমি এই অবস্থায় এসছি। আপনার সঙ্গে পরিচয় না হলে হয়ত আমি আজীবন মুড়ি'ই বিক্রি করতাম। ভয় হবে কেন? বরং এই মানুষ গুলোর জন্য করতে পারলে মনে হয়- নিজের জন্য'ই করছি।

হ্যাঁ, জীবনের মানে হয়ত এটা'ই।

আমি যেই শহরে থাকি, এই শহরে'ই অনেক বাংলাদেশি ছেলে তাদের নানান বিপদে আমার কাছে এসছে, নানানভাবে পরামর্শ চেয়েছে, নানান সাহায্য চেয়েছে।

এমন না, আমার খুব সামর্থ্য আছে কিংবা আমার পক্ষে সব সময় সাহায্য করা সম্ভব। আমি অতি অবশ্য'ই ক্ষুদ্র মানুষ। এরপরও নিজের সামর্থ্য এবং সীমার মাঝে থেকে যতটা সম্ভব চেষ্টা করেছি করতে।

হ্যাঁ, জীবনে মানে আমার কাছে এটা'ই।

স্রেফ নিজের জন্য নয় অন্যদের জন্যও বেঁচে থাকা যায়।

এর মাঝেও এমন সব মানুষ থাকবে, যারা স্রেফ নিজের স্বার্থ উদ্ধার করার জন্য কাছে আসবে, পাশে থাকবে। আবার স্বার্থ উদ্ধার হয়ে গেলে ভুলে যাবে, চিনতেও পারবে না। যাদেরকে জীবনের কোন কঠিন মুহূর্তে পাওয়া যাবে না। যারা কেবল নিজের কাজটুকু হাসিল করার জন্য'ই আশপাশে থাকবে।

এদের'কে কখনোই আপন ভাবা যাবে না। বরং ভেবে নিতে হবে- এরা কখনোই আমাদের আপন ছিল না।

গত আড়াই দিন হয় হাসপাতালে আছি। এই আড়াই দিনে কেউ আমার খোঁজ নেয়নি। অথচ আজ সকালে বাসায় আসার পরপর'ই যখন ফোন'টা চালু করলাম; তখন'ই পাশের ফ্ল্যাটে থাকা রাশিয়ান মেয়ে এলিসের ফোন

-আমিনুল, তোমার ফোন এই কয়দিন বন্ধ ছিলো কেন? আমি তো চিন্তায় অস্থির! এই করোনার সময় তোমার ফোন বন্ধ থাকবে কেন?

আমি একটু হেসে বললাম

-তুমি কি করে জানলে আমার ফোন বন্ধ? -আমি তো দুই দিন ধরে চেষ্টা করে যাচ্ছি। কি হয়েছে তোমার?

আমি আবারও হেসে বললাম

-কিছু হয়নি। ইচ্ছে হলো ফোনটা বন্ধ করে বসে থাকি। -এটা তুমি ঠিক করোনি। আমি তো খুব চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম। তোমার কি কোন কিছুর প্রয়োজন আছে? কোন সাহায্যের দরকার? প্রয়োজন হলে কিন্তু আমাকে বলবে। আমি গিয়ে দিয়ে আসব।

আমার চোখটা প্রায় ঝাপসা হয়ে এসছিল। চোখ মুছতে মুছতে'ই আমি ফোন ছেড়েছি। যেই মানুষগুলোর জন্য প্রায় নিজের জীবন'টাই উৎসর্গ করে দিয়েছি; এমন কিছু নেই, যা করিনি; এদের কেউ খোঁজ নেয়া তো অনেক দূরের ব্যাপার; পারলে আরও কঠিন অবস্থায় নিয়ে আমাকে ফেলে।

অথচ রাশিয়া থেকে আসা এই মেয়েটা; যার সঙ্গে হয়ত স্রেফ অল্প একটু বন্ধুত্বের সম্পর্ক; সে কিনা জিজ্ঞেস করছে- কোন প্রয়োজন হলে কিন্তু আমাকে বলবে!

ঠিক তখন'ই মনে হলো- সম্পর্কগুলো এমন'ই হওয়া উচিত। যেই সম্পর্কগুলো স্রেফ প্রয়জনের জন্য গড়ে উঠে; তারা কখনো প্রিয়জন হতে পারে না। যেই সম্পর্কগুলো স্রেফ নিঃস্বার্থ ভাবে গড়ে উঠে; তারা'ই আসলে দিনশেষে আমাদের প্রিয়জন।

যেই ছেলেটা আজ আত্মহত্যা করেছে; সে হয়ত বুঝতে'ই পারেনি- কে তার প্রিয়জন ছিল।

অনেক সময় পুরো জীবন কেটে যায়, কিন্তু আমরা বুঝে উঠতে পারি না- কে আমাদের সত্যিকারের কাছের মানুষ। তখন আমরা নিজদের প্রশ্ন করতে থাকি- জীবনের মানে কি?

যেই ছেলেটা আত্মহত্যা করেছে- সেও হয়ত এই প্রশ্ন'ই করেছে।

সামাজিক মনোবিজ্ঞান পড়া'ই আমি। আত্মহত্যা নিয়ে আমাকে অনেক পড়তে হয়েছে।

ছেলেটা হয়ত বুঝতে'ই পারেনি- আমাদের বেঁচে থাকতে হয় স্রেফ নিজের জন্য নয়; অন্যদের জন্য।

এই আমাকে জীবনের চলতি পথে, স্রেফ জন্মসূত্রে পাওয়া অপূর্ণতার জন্য কতো কিছু শুনতে হয়েছে। মানুষের ঘৃণা- অপমান বয়ে বেড়িয়ে'ই আমি আজ এই পর্যন্ত এসেছি। পড়াশুনা বন্ধ হয়ে যাবার উপক্রম হয়েছিলো, স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে যাচ্ছিলো; এরপরও থেমে থাকিনি।

জীবনের এই পর্যায়ে এসে এমনকি যাকে সবচাইতে কাছের আপনজন ভেবেছি; সে পর্যন্ত বলে বসেছে- কথা বলতে ভালো লাগে না। কারণ আমার কথা তার কাছে অস্বাভাবিক মনে হয়।

বুকের ভেতর জমা হওয়া পাথর'টা হয়ত ডাক্তার কেটে ফেলে দিয়েছে কাল; কিন্তু হৃদয়ের গভীরে যেই ক্ষত আমি বয়ে বেড়াচ্ছি সেটা হয়ত যাবার নয়।

না, এরপরও আমি থেমে যাবো না।

কারণ আমি জানি- পরাজিত মানুষদের এই পৃথিবী মনে রাখে না। পরাজিত মানুষদের কোন স্থান নেই এই পৃথিবীতে।

সুস্থ-স্বাভাবিকভাবে জন্ম নেয়া মানুষগুলো জন্মসূত্রে পাওয়া স্বাভাবিকতা নিয়ে গর্ব করতে থাকুক; নিজদের বড় মনে করতে থাকুক। এরপরও এদের কোন সাহায্যের প্রয়োজন হলে যাতে সাহায্য করতে পারি- এই জন্য এগিয়ে যেতে হবে আমাকে।

অপূর্ণতা'কে সঙ্গে নিয়ে'ই আমি এগিয়ে যাবো। হৃদয়ের এই ক্ষত নিয়ে'ই আমি এগিয়ে যাবো। কারন আমি বেঁচে থাকার মানে'টা উপলব্ধি করতে পেরেছি।

পৃথিবী নামক এই গ্রহে মানুষ হিসেবে জন্মানোর সব চাইতে বড় সুবিধা'ই হচ্ছে- স্রেফ নিজের জন্য বেঁচে না থেকে; অন্যদের জন্যও বেঁচে থাকা যায়।

(ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)

বিডি প্রতিদিন/ফারজানা



এই পাতার আরো খবর