ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

আজকের পত্রিকা

করোনা রোগীর বিদায়বেলা-সেবা, স্মৃতি আর বেদনা!
সেরীন ফেরদৌস
সেরীন ফেরদৌস

জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দুলছে ৫৮ বছর বয়সী জন (আসল নাম নয়)! পরিবারের কেউ হাসপাতালের আইসিইউতে প্রবেশ করতে পারছে না! মারাত্মক ভাইরাসটির বিস্তার রোধে এ কঠিন সিদ্ধান্তটি নিতে হয়েছে কর্তৃপক্ষের! নার্স থ্যাকার একহাতে তার সেলফোনটি জনের মাথা বরাবর পর্দার এপাশে ধরে রেখেছে আর অন্য হাতে টিস্যু দিয়ে বারবার চোখ মুছছে! ফোনের অপর প্রান্তে, হাসপাতালের বাইরে আকুল হয়ে কাঁদছে জনের প্রিয়জনেরা!

কন্যা কেঁদে কেঁদে বাবাকে ডাকছে, “বাবা, বাবা, জেগে ওঠো! বাবা, আমরা তোমার জন্য অপেক্ষা করছি...বাড়িতে ফিরে আসো!” নীরবে চোখের জল গড়িয়ে পড়ছে উপস্থিত নার্সের, কর্তব্যরত ডাক্তারের!

ব্রাম্পটন সিভিক হাসপাতালের আইসিইউতে চাকরি করা নার্স দারাস থ্যাকারের অভিজ্ঞতা রয়েছে ২০০৩ সালের সার্স-আক্রমণের সময়কারও। সে জানে, সে এমন একটি ইউনিটে কাজ করছে যেখানে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ চিকিৎসার পরেও রোগী মারা যায়!

তার জন্য আরও একটি কঠিন মুহূর্ত ছিল যখন তার নিজেরই সহকর্মী শেষ নিঃশ্বাস নিচ্ছিলেন! সেসময় শক্ত করে তার হাত ধরে পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন থ্যাকার! তিনি বলেন, “ও তো আমাদেরই একজন! যাবার আগে ওর পাশে পরিবারের কেউ ছিল না তাতে কি! পাশে দাঁড়িয়ে কেঁদেছি, ওর জন্য প্রার্থনা করেছি! আমার জন্য কঠিনতম একটি মুহূর্ত ছিল সেটি!”

তবু, এবারে করোনা-ভাইরাসের মরণকামড়ের কাজ করতে এসে বারবারই আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ছেন থ্যাকার! নিজেকে সামলে রাখা দায় হয়ে পরছে বারবার। নিজে ভীত ছিলেন যথেষ্ট, নিজ পরিবারের কথাও মাথায় রাখতে হয়েছে তাকে, তারপরও তিনি দৃঢ়কণ্ঠে বলেন, ‌‘আমাদের পিছিয়ে যাবার সুযোগ নেই! সবাইকে মিলেমিশের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যেতে হবে!”

করোনাভাইরাসটি অতি উচ্চমাত্রায় ছোঁয়াচে বলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বাধ্য হয়ে আত্মীয়স্বজনকে আইসিইউতে প্রবেশ নিষেধ করেছেন। কিন্তু তারা তাদের সাধ্যমতো চেষ্টা করছেন পরিবারগুলোকে প্রিয়জনের সাথে যোগাযোগ করানোর, তাদের শেষ ইচ্ছাগুলো পালন করানোর। ডাক্তার, নার্স ও সমাজকর্মীরা সেলফোন, ভিডিও কনফারেন্স ইত্যাদির মাধ্যমে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আত্মীয়-স্বজনকে প্রিয় মানুষটিকে দেখানোর ব্যবস্থা করেছেন। অনেক ক্ষেত্রেই তারা নিজেদের ফোন নাম্বার দিয়ে অনুরোধ করছেন, যে-কোনো সময়ে ফোন দিলেই তারা তথ্য দেবেন এই বলে।

উদ্বেগ, প্রিয় মানুষ হারানোর বেদনা, আশঙ্কা-ভয় ইত্যাদি দূর করতে ডাক্তার-নার্স-সমাজকর্মীরা প্রতিমুহূর্তে রোগীর অবস্থা বর্ণনা করছেন কাছের মানুষদেরকে, যাতে পুঙ্খানুপুঙ্খ তথ্য পেয়ে তারা স্বস্তি পেতে পারেন। রোগী যতোই মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যেতে থাকেন, ততই তারা পরিবারগুলোকেও সম্ভাব্য ঘটনার জন্য প্রস্তুত করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন। সবাই মিলে সেই চেষ্টাই করেন যাতে পরিবার-পরিজন অন্তত একবারের জন্য হলেও প্রিয় মানুষটাকে আন্তরিক ‘বিদায়’ জানাতে পারেন! এমনি তাদের শেষকৃত্য কোথায় কিভাবে হবে, সেগুলোরও তদারকি করেছেন তারা।

হাসপাতালের ক্রিটিক্যাল কেয়ার ডাক্তার ব্রুকস ফ্যালিস এই হাসপাতালেরই একজন ক্লিনারের মৃত্যুর সময় তার পাশে ছিলেন। মৃত্যুর আগ মুহূর্তে রোগীর মেয়েটিকে তিনি এক ভিডিও কনফারেন্সে ডাকেন বাবার সাথে কথা বলার জন্য। মেয়েটি ভিডিওতে বাবাকে দেখে উচ্চস্বরে বাবাকে সাহস জোগাতে থাকে। বলে, বাবা, তুমি তো জানো কত ভালোবাসি তোমাকে আমি! আর একটু শক্ত হও তো, আরও একটু চেষ্টা করো টিকে থাকতে! তুমি পারবে বাবা, তোমার শক্তি অনেক, জানি তুমি ফিরে আসবে! 

ডা. ফ্যালিস বলেন, “আমি আর নার্স তখন কাঁদছিলাম। এই ভেবে ভালোও লাগছিলো যে শেষ পর্যন্ত মেয়েটি বাবার সাথে কথা বলতে পেরেছে!”

এরকম আরও অনেক ঘটনাই আছে। বিভিন্ন ধর্মের মানুষের শেষ বিদায়ের সময় নানারকম আকাঙ্ক্ষা বা রীতিনীতি পালনের রেওয়াজ থাকে। হাসপাতালে সেগুলোও যথাসাধ্য পালন করার চেষ্টা করছেন তারা। যেমন, ব্রাম্পটন হাসপাতালের সমাজকর্মী ড্যানিয়েল রোগীর স্বজনের ইচ্ছা অনুযায়ী, একজন রোগীর হাত-পা এবং শরীর একটি নির্দিষ্ট দিক বরাবর করে শুইয়ে দিয়েছেন। আবার আরেকজন রোগী মারা যাবার আগে তার সারা গায়ে পবিত্র পানি ছিটিয়ে দেবার কাজটি করেছেন একজন ডাক্তার। ভিডিও কলে রোগীর স্বজনেরা কিভাবে কাজটি করতে হবে তার নির্দেশনা দিয়েছেন ডাক্তারকে!

ডা. ফ্যালিসের মতে, শুধুতো করোনার জন্যই নয়, আইসিইউ লাইফ সাপোর্ট, কিডনি ডায়ালাইসিস, ভেন্টিলেটর, হার্ট-সাপোর্ট ইত্যাদি নানারকম যন্ত্রপাতিতে ঠাসা থাকে। এইসব হাজারো মেশিনপত্রের ভিড়ে প্রিয় মানুষটিকে নিথর হয়ে পরে থাকতে দেখাটাও প্রিয়জনের একটা বেদনাদায়ক ব্যাপার। 

তিনি বলেন, আমাদের কাজ হলো পরিবারের সেসব বেদনাও ভাগাভাগি করে নেয়া আর যতোটা সম্ভব তাদের শেষ ইচ্ছাটুকু পূরণ করা!

নার্স থ্যাকার তার সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা থেকে বলেন, ভেন্টিলেটরে সারি সারি শুয়ে আছে ঘুমন্ত রোগীরা, কারো নড়াচড়া নেই, সবাইকে দেখতে একই রকম লাগছে! মনে হতে থাকে, কেনো হরর ছবির অংশ এই আমি ও আমরা! কিছুই করার নেই কারো, শুধু তাদের জেগে ওঠার জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া!

(ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)

লেখক: কানাডার কমিউনিটি নার্স।

বিডি-প্রতিদিন/বাজিত হোসেন



এই পাতার আরো খবর