ঢাকা, মঙ্গলবার, ৩০ জুলাই, ২০২৪

আজকের পত্রিকা

নিরন্তর লড়ে যাওয়া এক যোদ্ধার নাম মোহাম্মদ শরীফ খান
ইফতেখায়রুল ইসলাম

চাকরির বাকি আর মাত্র তিন মাস! এই অবস্থায় মানুষ সাধারণত চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে চায়না! চাকরিটা ভালোয় ভালোয় শেষ করে বিদায় নিতে চায়! কিন্তু মোহাম্মদ শরীফ খানের মাথায় সে চিন্তা ভুলেও জায়গা পেল না!

কে এই শরীফ খান? ৬৫৬৭ এটি তার পেশাগত পরিচয়! শরীফ আজ থেকে ৪১ বছর আগে বাংলাদেশ পুলিশে কনস্টেবল হিসেবে যোগদান করেন। যোগদানের হিসেব অনুসারে আর মাত্র তিন মাস পরেই অবসরে যাবেন ৬৫৬৭ নম্বরধারী কনস্টেবল শরীফ!

শরীফ খানের মত অনেকেই অবসরে চলে যান, আমরা কয়জনইবা সেটি মনে রাখি? আজ বাংলাদেশ পুলিশকে নিজের জীবন থেকে ৪১ বছর দিয়ে দেয়া শরীফ খানের বাস্তব গল্পের শেষাংশটুকু শোনাতে চাই আমি।

যেদিন থেকে করোনার প্রভাব শুরু এই বাংলাদেশে ঠিক সেইদিন থেকে সামগ্রিকভাবে পাহাড়সম কাজের পরিধি নিয়ে কাজ করে চলেছে বাংলাদেশ পুলিশ! করোনা পূর্ব থেকে শুরু করে এই করোনাকালীন সময়ে পুলিশ কোন কাজে আছে না বলে, কোন কাজে নেই সেটির জিজ্ঞাস্য আশা করি বেশি যুক্তিযুক্ত হবে। বাংলাদেশ পুলিশ প্রধানের নির্দেশনা পাওয়ার সাথে সাথে পুলিশির প্রতিটি সদস্য পেশাদারিত্ব ও মানবিকতার মিশেলে নিজেদের সর্বোচ্চটুকু দেয়ার চেষ্টা করে চলেছে।

জনবলের বিচারে এবং আপদকালীন সময়ের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ পুলিশ বারবার প্রমাণ করেছে, জাতির যে কোনও ক্রান্তিলগ্নে পুলিশ মাথা উঁচু করে টিকে থাকেই! মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধের রাজতিলক যে সার্ভিসের কপালে তারা যুদ্ধে পিছপা হবেন না সেটাই অতি স্বাভাবিক!

কনস্টেবল শরীফ চাকরিতে প্রবেশের পূর্বেই শপথ নিয়েছেন। দেশের অভ্যন্তরীণ শান্তি, শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তার বিনির্মানে কাজ করবেন। রাষ্ট্রের যে কোন প্রয়োজনে সর্বস্ব উজাড় করে দেবেন! শপথ বাক্য পাঠ করি আমরা অনেকেই, প্রতিপালন করি কজনইবা! করোনা যুদ্ধের একজন বয়স্ক যোদ্ধা (প্রায় ৫৯ বছর ছুঁই ছুঁই ) হিসেবে শরীফ চাইলেই নিজ বাসায় অসুস্থতার অজুহাতে বিশ্রাম নিতে পারতেন। কিন্তু না, তিনি তা করেন নি!

ওয়ারী বিভাগে যখন ৬৮৬টি বাড়ি লকডাউন করা হয়েছে তখন তরুণ যুবাদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়ে গেছেন আমাদের যোদ্ধা শরীফ। কখনো আপনাকে বাসায় রাখতে, কখনো সামাজিক দূরত্ব মানাতে, কখনো আপনার অসুস্থ দেহকে হাসপাতালে প্রেরণ করতে, কখনো আপনার লাশ দাফন ও কবরস্থ করতে আবার কখনো বা আপনার বাসায় খাবার না থাকায় নিজের ব্যক্তিগত অর্থ বা বেতনের টাকায় অথবা স্থানীয় কারো সহায়তায় আপনাকে খাবার পৌঁছে দিতে দিনের পর দিন, রাতের পর রাত কাজ করে গেছে আমাদের শরীফ। মুখে একটি টু শব্দও করেননি শরীফ, শুধু কাজ করে গেছেন।

কাউকে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য বলছি না, আপনারা জেনে থাকবেন করোনাকালীন সময়ে কেউ কেউ সেবা দেয়া থেকে বিরত থেকেছেন অথবা সেবা প্রদান করতে অপারগতা প্রকাশ করেছেন! কিন্তু সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশের কোথাও কি শুনেছেন বাংলাদেশ পুলিশ সেবা দিতে অনীহা পোষণ করেছেন? বিপদে বন্ধুর পরিচয় মেলে এটি আপনারা সকলেই জানেন! বিপদের বন্ধুদের তাই চিনে রাখুন এবং জেনেও রাখুন!

যে কোনও জাতীয় দুর্যোগে বাংলাদেশ পুলিশ শুধু নিজের কাজ করে থেমে থাকে না বরং অন্যের অসম্পাদিত কাজও নিজের কাঁধে তুলে নেয় রাষ্ট্র তথা জাতির প্রতি দায় মেটাতে! কখনওবা অন্যের দায়িত্বাধীন কাজকে সহজতর করে দেয় বাংলাদেশ পুলিশ। এই বিষয়কে গ্রেটনেস বলে কিনা আমি জানি না, তবে তা দেশপ্রেম তো অবশ্যই! জাতির যে কোনো প্রয়োজনে অবদান রাখার পর কেউ স্বীকৃতি দিল কি দিল না তা নিয়েও মাথা ঘামায় না পুলিশ; এই বিষয়কে মহানুভবতা বলে কিনা আমি জানি না, তবে তা পেশাদারিত্ব তো অবশ্যই!

কনস্টেবল শরীফরা আপনাকে সেবা দিতে দিতে হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে পড়ে! তারপরেও চোখে, মুখে কোনো ভয় না রেখে অসীম সাহসিকতার সাথে বলে, আমার কিচ্ছু হবে না স্যার, দেখেন আমি সুস্থ থাকবো! 

দূর্ভাগ্যবশত কোভিড-১৯ পরীক্ষা করিয়ে শরীফের রিপোর্ট পজিটিভ এসেছে! আপনার পরিবারের চিন্তা করতে যেয়ে শরীফ নিজের পরিবারকে বেমালুম ভুলে গিয়েছিল! বাংলাদেশ পুলিশের প্রতিটি সদস্য ভুলে যায়! পুলিশের চেয়ে তার পরিবারের ত্যাগ আরও বেশি। দিনের পর দিন স্বামী ছাড়া, বাবা ছাড়া কাটাতে হয় পুলিশের স্ত্রী, সন্তানদের! সেই গল্প অজানাই থেকে যায়! জানার চেষ্টা আপনারা কখনো করেন কি?

 শরীফ প্রতি রাতে কাজ শেষে নিজ বাসায় ফেরেন। যার ফলাফল হিসেবে শরীফের পরিবারে নিজের স্ত্রী ও দুই সন্তানও এখন করোনা পজিটিভ! কখনো কি ভেবে দেখবেন আপনারা, এই আপনাদের জন্য পুলিশ না হয়েও পুলিশের পরিবারকে কত বড় সংগ্রামী হতে হয়, কতটা যুদ্ধ করতে হয়?

অবসরে চলে যাবেন যে শরীফ, সেই শরীফের এই যুদ্ধকে এবং তার যুদ্ধের পরিণাম হিসেবে তার স্ত্রী, সন্তানের যুদ্ধকে আপনি কি নাম দেবেন জানি না! আমার কাছে শরীফ একজন দৃষ্টান্তের নাম! আমার কাছে শরীফ আমাদের সার্ভিসের প্রাণ, আমাদের শক্তি। আপনার সেবায় নিয়োজিত হতে যেয়ে আমাদের যে সদস্য আক্রান্ত হলেন, তাকে ভালবাসা দেখানোর বা জানানোর জন্য আজ আর কেউ নেই শুধু পুলিশ ছাড়া!

সকল পেশায় সিনিয়র, জুনিয়র শৃঙ্খলাবোধের বিষয় থাকলেও জুনিয়রদের সম্মান প্রদর্শনে বাঁধা কোনও কালেই ছিল না! ডিসি ওয়ারী স্যারের নির্দেশনায় যোদ্ধা কনস্টেবল শরীফের প্রতি সম্মান ও তার যোদ্ধা স্ত্রী ও যোদ্ধা সন্তানদের প্রতি স্যালুট ও সম্মান প্রদর্শন করতে আমরা তার আলয়ে গিয়েছিলাম! আমরা এই যোদ্ধা পরিবারকে এই মেসেজটুকু দিতে চেয়েছি, পুলিশ যতটুকু মানুষের ঠিক ততটুকু তার নিজের অফিসারদেরও! এই ক্ষুদ্র প্রয়াস শরীফ ও তার পরিবারের ত্যাগের কাছে পিঁপড়া সমতুল্যও নয়! তাও আত্মসন্তুষ্টি পাবার প্রত্যাশায় আমাদের প্রচেষ্টা!

ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের প্রথা আমাদের মাঝে নেই বললেই চলে। এই করোনাকালীন সময়ে আপনারা প্রত্যেকেই দেখছেন কারা ঠিক কতটুকু করছেন আপনাদের জন্য। শরীফের মত সম্মুখ যোদ্ধাদের মাঝে মাঝে ধন্যবাদ দিয়েন, খুব কষ্ট হলেও দিয়েন! এতে এই যোদ্ধারা মানসিক শক্তি পাবে! এটি তাদের ভাবতে শেখাবে, আমার ও আমার পরিবারের ত্যাগ বৃথা যায়নি!

এরকম হাজারো শরীফের ত্যাগের বিনিময়ে করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চলছে! এই যুদ্ধের যোদ্ধা যদি নাও হতে পারেন সমস্যা নেই কিন্তু একজন সহমর্মি হতে কুন্ঠাবোধ করেন না, প্লিজ। নাহলে যে ইতিহাসও আপনাকে মাফ করবে না!

লেখক: অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (প্রশাসন), ওয়ারী বিভাগ, ডিএমপি, ঢাকা।

(ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)

বিডি-প্রতিদিন/সিফাত আব্দুল্লাহ



এই পাতার আরো খবর