ঢাকা, মঙ্গলবার, ৩০ জুলাই, ২০২৪

আজকের পত্রিকা

এক মুমিন কয়েদখানায় ; শত মুমিন নেতার ছায়ায়!
বাণী ইয়াসমিন হাসি
বাণী ইয়াসমিন হাসি

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে নথি বের করে জালিয়াতির মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত বদলে দেওয়ার অভিযোগের মামলায় ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সহ সভাপতি তরিকুল ইসলাম মুমিনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।

নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে কোষাধ্যক্ষ পদে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এম এনামুল হক, বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মো. আব্দুর রউফ এবং বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালের সাবেক কোষাধ্যক্ষ অবসরপ্রাপ্ত এয়ার কমোডর এম আবদুস সালাম আজাদের নাম প্রস্তাব করে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে নথি পাঠানো হয়।

এই নথি প্রধানমন্ত্রীর সামনে উপস্থাপন করার পর তিনি অধ্যাপক ড. এম এনামুল হকের নামের পাশে টিক চিহ্ন দেন। পরে চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য নথিটি রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানোর প্রস্তুতি পর্বে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অফিস সহকারী ফাতেমার কাছে এলে তিনি এম আবদুস সালাম আজাদ অনুমোদন পাননি বলে ফোনে মুমিনকে জানিয়ে দেয়।

এরপরেই মুমিনের পরিকল্পনা অনুযায়ী, নথিটি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে কৌশলে বের করে ফরহাদ নামে একজনের হাতে তুলে দেয় ফাতেমা। এরপরেই সেই নথিতে মুমিন ড. এম এনামুল হকের নামের পাশে প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া টিক চিহ্নটি ‘টেম্পারিং’ করে সেখানে ক্রস চিহ্ন দেয়।একইভাবে অধ্যাপক মো. আব্দুর রউফের নামের পাশে ক্রস চিহ্ন দিয়ে এয়ার কমোডর এম আবদুস সালাম আজাদের নামের পাশে টিক চিহ্ন দেয়। প্রায় এক মাস আগে নথিটি রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ে পাঠানো হয়।

এই নথি হস্তান্তরের আগে ফাতেমা ১০ হাজার টাকা বিকাশের মাধ্যমে গ্রহণ করে এবং হস্তান্তরের পরে আরেক দফায় ১০ হাজার টাকা তার ছেলের বিকাশ একাউন্টের মাধ্যমে নেয়।

শামিমা নূর পাপিয়া একটি মফস্বল শহর নরসিংদীর যুব মহিলা লীগের নেত্রী। পাপিয়া এবং মফিজুর রহমান দম্পতিকে বাংলাদেশ পুলিশের বিশেষ বাহিনী র‍্যাব গত ২২শে ফেব্রুয়ারি ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে আটক করে। পুলিশের ভাষ্য অনুযায়ী এরা আরও দুজন সহযোগী সহ ভারতে যাওয়ার চেষ্টা করছিলো, তখন তাদের ধরা হয়। রাজধানীর গুলশানের অভিজাত হোটেল ওয়েস্টিনের প্রেসিডেন্ট স্যুট ভাড়া নিয়ে পাপিয়া অসামাজিক কার্যকালাপ চালাতো।

গাড়ির ব্যবসার আড়ালে পাপিয়া অবৈধ অস্ত্র, মাদক ব্যবসা ও চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত ছিল।সমাজসেবার নামে সে নরসিংদীর অসহায় নারীদের অনৈতিক কাজে লিপ্ত করে আসছিলো। অধিকাংশ সময় সে নরসিংদী ও রাজধানীর বিভিন্ন বিলাসবহুল হোটেলে অবস্থান করতো। সেখানে তার ও তার স্বামীর ব্যবসায়িক অংশীদারদের অসামাজিক কার্যকলাপের জন্য নারী সবরবরাহ করাই ছিল তার মূল কাজ।

শামিমা নূর পাপিয়াকে নিয়ে নানা খবর প্রকাশিত হওয়ার পর তাকে নিয়ে আওয়ামী লীগ এবং যুব মহিলা লীগ বেশ বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছে। বিশেষ করে পাপিয়ার সঙ্গে সরকার এবং ক্ষমতাসীন দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতা এবং মন্ত্রীদের ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপকভাবে শেয়ার হওয়ার পর এটি তাদের মধ্যে বিরাট অস্বস্তি তৈরি করেছে।

প্রধানমন্ত্রীর স্বাক্ষর জালিয়াতি করার অভিযোগে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি তরিকুল ইসলাম মুমিনকে সংগঠন থেকে স্থায়ী বহিষ্কার করা হয়েছে।

শনিবার সন্ধ্যায় ছাত্রলীগের সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় ও সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য স্বাক্ষরিত এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। 

সমাজসেবা ও গাড়ি ব্যবসার আড়ালে অবৈধ অস্ত্র, মাদক ব্যবসা ও চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগে র‌্যাবের হাতে আটক নরসিংদী জেলা যুবমহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদক শামিমা নূর পাপিয়াকেও আজীবনের জন্য যুব মহিলা লীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।

গণমাধ্যমে খবর প্রকাশ এবং গ্রেফতারের পর তাদেরকে সংগঠন থেকে বহিস্কার করা হলো। এখন প্রশ্ন হলো সংগঠনের কি কোন দায় নেই? পদ পদবি পাওয়ার পর সবাই কি ঈশ্বর হয়ে যায়? কোন জবাবদিহিতা কেন নিশ্চিত করা হয় না? নূন্যতম নজরদারিরও কেন কোন ব্যবস্থা নেই?

কোটাবিরোধী আন্দোলনে যে ছেলেগুলো সবচেয়ে বেশি সরব ছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের গালি দেওয়া, মন্ত্রীদের কে নিয়ে ট্রল করা, শেখ হাসিনাকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করা ছেলেগুলোই পরবর্তীতে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে জায়গা করে নিয়েছে।

শুধু তাই নয় কোনদিনও ছাত্রলীগ করেনি এমন এমপি/মন্ত্রীপুত্র, বাচ্চার বাবা, দাগী অপরাধী, মাদকসেবী, মাদক ব্যবসায়ী, অনুপ্রবেশকারীদেরও জায়গা মিলেছে। কিন্তু জায়গা হয়নি পরীক্ষিত আর নির্যাতিতদের। বাপের জায়গা জমি নিয়ে মারামারি করতে গিয়ে তুহিন, তাকিম, সাদ্দাম, টগর, মাসুদেরা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে জামাত শিবিরের হাতে হাত পা হারিয়ে পঙ্গু হয়নি। তারা পঙ্গু হয়েছে ছাত্রলীগ করতে গিয়ে, শিবিরের ক্যান্টনমেন্টে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে। ছাত্রলীগ করতে যেয়ে পঙ্গু হয়ে, হাত পা হারিয়েও ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে তাদের জায়গা মেলেনি। তাহলে কি ত্যাগের চেয়ে তেলের মুল্য অনেক বেশি?

একটা সময়ে হল কমিটি পূর্ণাঙ্গ করার মত কর্মী খুঁজে পাওয়া যায়নি। আর এখন লাখে লাখে ছাত্রলীগ!

শেখ হাসিনার গ্রেফতারের পর জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রথম মিছিল করা ছেলেগুলো কে কোথায় আছে? যতদূর জানি এমপি মন্ত্রী তো দূরের কথা একটা চেয়ার পর্যন্ত জোটেনি কারো ভাগ্যে। যেসব বাঘা বাঘা আইনজীবী তখন শেখ হাসিনার মামলা লড়েনি তারা এখন সবচেয়ে বড় ফাইটার। অনেকটা স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে সাবজেলের সামনে শুধু টিভি ক্যামেরায় চেহারা দেখিয়ে অনেকেই রাতারাতি বড় ত্যাগী তে পরিণত হয়েছিলো। সবটা কাছ থেকে, একদম ভেতর থেকে দেখেছি। সেসময় রাস্তায় ছিল হাতেগোনা কিছু মানুষ। সেই মানুষগুলোর বিশেষ কোন চাওয়া নেই। তাদের একটাই চাওয়া একটু সম্মান, একটু মূল্যায়ন। কিন্তু হায় কিছুই জোটে না তাদের কপালে!

মাত্র ২০ হাজার টাকায় যে কার্যালয় থেকে গুরুত্বপূর্ণ নথি বাইরে চালান করা যায় সেইখান বসে আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী অফিস করেন। একবার ভেবে দেখেন উনি কতটা অনিরাপদ।

আরেকটা কথা; আমার কিন্তু বিশ্বাস হয় না এটার সাথে শুধু অফিস সহকারী জড়িত। আরো বড় বড় মাথা নিশ্চয়ই এটার পেছনে আছে। আর এটা ছিল তাদের টেস্ট কেস; সফল হলে বড় কোন ধামাকা করতো।

দীর্ঘদিন ধরে খুব সূক্ষভাবে শেখ হাসিনার পাশ থেকে পরীক্ষিতদের সরিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং সেখানে জায়গা করে নিয়েছে বেঈমান লোভী আর সুবিধাবাদী কিছু মানুষ। এতবড় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় সেখানে কয়টা সাবেক ছাত্রলীগ আছে? বড় বড় চেয়ারগুলো যারা দখল করে বসে আছে দল এবং দলীয় প্রধানের জন্য তাদের কনট্রিবিউশন কি?

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সহযোগী ও অংগ সংগঠনে এমন মুমিন পাপিয়ার সংখ্যা কিন্তু কম না। এদের অপকর্ম ধরা পড়েছে, গণমাধ্যমে খবর হয়েছে বলেই সবার টনক নড়েছে। তা না হলে এরা বহাল তবিয়তেই সবদিক ম্যানেজ করে তাদের অপকর্ম চালিয়ে যেতো। এখন প্রশ্ন হলো যেসব মুমিন এবং পাপিয়া এখনও ধরাছোয়ার বাইরে রয়েছে তারা কি শুধরাবে? আর অনৈতিক সুবিধা নিয়ে এদেরকে সংগঠনে যারা জায়গা করে দিচ্ছে তাদের ব্যাপারে দলীয় হাইকমান্ড কি কঠোর হবে না?

মুমিন এবং পাপিয়া দুজনের ব্যাকগ্রাউন্ড খুঁজলেই দেখা যাবে এই দল বা সংগঠনে তাদের কোন অবদান নেই। তাদের দীর্ঘদিনের ত্যাগ বা লড়াই সংগ্রাম কিছুই নেই। বরং তারা বিশেষ কোন নেতার ব্যক্তিগত ফুট ফরমায়েশ সার্ভ করেছে। সম্পূর্ণ অনৈতিক উপায়ে ত্যাগী এবং যোগ্যদের বঞ্চিত করে এদেরকে সংগঠনকে জায়গা করে দেওয়া হয়েছে। যাদের হাত ধরে এদের এমন নগ্ন উত্থান তাদের দায় কি কোন অংশে কম?

লেখক: সম্পাদক, বিবার্তা২৪ডটনেট।

বিডি-প্রতিদিন/সালাহ উদ্দীন



এই পাতার আরো খবর