ঢাকা, সোমবার, ২৯ জুলাই, ২০২৪

আজকের পত্রিকা

হাবীব আহসান, আমার ‘স্মৃতির অতলে’
আহমদ মাজহার
আহমদ মাজহার

গতকাল সন্ধ্যায় যখন শুনলাম হাবীব ভাই নেই, তখন থেকে আমার মন ভার হয়ে আছে অব্যাখ্যেয় এক বেদনার অনুভূতিতে। এই বেদনা কেবল আমার ব্যক্তিগত নয়, তিনি আমার নিকটজন ছিলেন বলেই বিষণ্ণ নই কেবল; আমার মন দুঃখ ভারাক্রান্ত হয়ে আছে আমাদের সামষ্টিক পরিমণ্ডলে তাঁর অবস্থানের অনন্যতা আমাদের সব সময় যেভাবে উজ্জ্বলিত করে রাখত তার সুযোগ আর রইল না বলে। এই বিষাদভার তাঁর ব্যক্তিপ্রভার সঙ্গে পরিচিত পরিমণ্ডলের সকলের। এই ‘সকলে’ সাধারণ কেউ নন, এই সকলে হচ্ছেন তাঁরা, যাঁরা তাঁর অন্তহীন কৌতূহল উৎসাহ নিমজ্জন ও প্রেরণা দ্বারা কখনো-না-কখনো স্পর্শিত হয়েছেন এবং এর দ্বারা জ্বলে উঠেছেন নিজেরা!

আমাদের এখনকার অর্থগৃধ্নু ও শিল্প-উদাসীন ধান্ধাবাজ সমাজে এক দুর্মর উৎসাহিতপ্রাণ শিল্পপ্রেমী ব্যতিক্রমী মানুষ ছিলেন তিনি। তাঁর অফুরাণ শিল্পতৃষ্ণা আমাকে বছরের পর বছর ধরে স্পর্শ করেছে; লক্ষ করেছি জাগতিক বাস্তবতায় তাঁর উপর্যুপরি ব্যর্থতা ও বঞ্চনা তাঁকে শিল্পতৃষ্ণা থেকে বিরত করতে পারেনি। এই রকম শিল্পতৃষ্ণান্তহীন একটা প্রাণ আমাকে আর অবিরাম জ্বালিয়ে রাখবে না--এই শূন্যতার বোধ আমাকে ছাড়ছে না কিছুতেই। করোনাক্রান্তির বিশ্বব্যাপী সংকটের প্রভাব উপচিয়ে আমার ব্যক্তিসত্তা তাঁর বিয়োগব্যথায় কেবলই প্লাবিত হয়ে পড়ছে। এমনই এক শূন্যতাভারে আক্রান্ত হয়ে আছি বকুল, রিটন, আমীরুল--আমরা সবাই--আমরা যারা তাঁর কেন্দ্রে আবর্তিত! জানি একই রকম অনুপস্থিতিবেদনায় ভরে আছে এই কেন্দ্রধারক চয়ন ইসলাম-লিলি ইসলামের মনও।

ব্যক্তিগতভাবে বলতে পারি, ‘হিন্দুস্তানি’ সংগীতের রসাস্বাদনের দুয়ার তিনি খুলে দিয়েছিলেন আমার সামনে। উচ্চাঙ্গ সংগীতের রসাস্বাদনের মানে যে কেবল বিন্যাসিত ধ্বনির শ্রবণ নয়, প্রকৃতপক্ষে আবেগের বিহ্বলতাকে জাগিয়ে দেয়া--তার বার্তা তিনিই সংগীতরসিকের ভাষায় আমার অনুধাবনে পৌঁছে দিয়েছিলেন। ঐটুকু যদি সম্ভব না হতো তাহলে আমার পক্ষে কোনোদিন ধ্বনিশ্রোতাত্ব অতিক্রম করে প্রাথমিক স্তরের সংগীতরসিক হওয়াও সম্ভব হতো কিনা জানি না। আজও আমি যখন ‘হিন্দুস্তানি’, ‘বাংলা গান’, ‘পাশ্চাত্য উচ্চাঙ্গ সংগীত’ আস্বাদনে প্রয়াসী হই তখন হাবীব ভাই দাঁড়িয়ে থাকেন আমার ‘স্মৃতির অতলে’।

সত্তরের দশকের প্রথম ভাগে বাংলাদেশের গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলনের সূচনাকালে চট্টগ্রামে তিনি যুক্ত ছিলেন। তাঁর লেখা নাটক মঞ্চে এসেছে। চলচ্চিত্রবিদ্যা শিখেছিলেন। টেলিভিশনের নাটক রচনা ও প্রযোজনায় তাঁর সে বিদ্যার শিল্পিত প্রকাশ আমরা দেখেছি। একটা সাধারণ টিভিনাটককে শিল্পে উত্তীর্ণ করার জন্য তাঁর মধ্যে যে আকুতি দেখতাম তা ছিল বিরল। বিটিভিতে নাটক প্রযোজনা তাঁর গ্রাসাচ্ছাদনের ব্যাপার হলেও এবং এর সকল সীমাবদ্ধতা মেনেও চেষ্টা করতেন তাকে শিল্পে উত্তীর্ণ করে তুলতে। এতে তাঁর কুশীলব ও কলাকুশলীরা অনেক সময় বিরক্ত হলেও ছিলেন অদমিত। নিজের সংগীতানুধাবনকে অন্যদের মধ্যে পৌঁছে দিতে ‘গানবাজনার সমঝদারি’ নামে যে বইটি লিখেছিলেন তা ছিল সংগীতের প্রতি তাঁর ভালোবাসারই আন্তরিক ও গভীর প্রকাশ। বইটি এখন আমার ঢাকার ফ্ল্যাটে নিঃসঙ্গ শোক প্রকাশ করছে বলে তাকে এখানে হাজির করতে পারলাম না।

টেলিভিশনে নানা ধরনের অনুষ্ঠান প্রযোজনা করেছেন হাবীব ভাই, যত সীমাবদ্ধতার মধ্যেই থাকতে হতো না কেন তাঁকে, সবখানেই দেখেছি অনুষ্ঠানকে সুন্দর করে তুলতে আন্তরিক প্রয়াসী হতে। বিটিভির পঁচিশ বছর পূর্তি উপলক্ষে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ উপস্থাপিত ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানটিকে প্রযোজক হিসেবে সার্থক করে তুলতে তাঁর নিজের আন্তরিক নিবেদনের আমি ছিলাম প্রত্যক্ষ সাক্ষী। ভালো ছবি আঁকতে পারতেন; দক্ষতা ছিল সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য স্থাপনীয় স্থাপনাশিল্পেও! এমনকি বন্ধুমণ্ডলীর ঘরোয়া অনুষ্ঠানের জন্যও মেধাব্যয়ী হতে দেখেছি তাঁকে। আমাদের একমাত্র সন্তান সুদীপ্ত প্রিয়দর্শনের প্রথম জন্মবার্ষিকীতে আত্মীয় ও বন্ধুবৃত্তকে নিয়ে আমাদের উদযাপনে তাঁর আন্তরিক অংশগ্রহণ আমাদের মনে অমলিন স্মৃতি হয়ে আছে। আমাদের নিয়ে লিলি ইসলাম-চয়ন ইসলামের যে কোনো আয়োজনে হাবীব ভাই ছিলেন অবশ্যম্ভাবী আমন্ত্রিত। দেখা হওয়া মাত্র আমাদের বাস্তবতাবাধা অতিক্রমী আন্তরিকতা-স্পর্শে উজ্জীবিত হয়ে পড়তাম। হাবীব ভাইকে কেবল অগ্রজপ্রতিম বন্ধু হিসেবেই নয়, দীর্ঘকাল পেয়েছি সহকর্মী হিসেবেও। সবখানেই তাঁর সঙ্গে আলাপে আড্ডায় ক্রমাগত ঋদ্ধ হয়েছি।

বয়সে অগ্রজ হওয়া সত্ত্বেও তাঁর প্রীতিময় গুণগ্রাহিতা ছিল বয়োকনিষ্ঠদের প্রতি, ছিল তাঁর অবিরল স্নেহধারা। পরিচয়ের শুরু থেকেই অনুভব করেছি তাঁর সঙ্গে আড্ডা হওয়ার মানে কোনো-না-কোনো ভাবে শৈল্পিকতার সূত্রের উন্মোচন ঘটা। তাঁর উৎসাহ ছিল যেমন প্রদর্শশিল্পে, তেমন ছিল ভাষিকশিল্পেও; অর্থাৎ যেমন তাঁর ভালোবাসা ছিল সংগীতে তেমনই ছিল সিনেমাশিল্পে, উৎসাহ ছিল কবিতা গল্প বা নাটক রচনায়। লিখেছিলেন স্মৃতিকথাও। না, সার্থকতার নিরিখে তো তাঁকে আমি কখনো দেখি না। চারপাশে যেখানে প্রাণোচ্ছ্বাসই বিরল সেখানে সাফল্য খুঁজব কোথায়? একশোজন হাবীব আহসানের জীবন পোড়ালে তো একজন সফল শিল্পী পাবার সম্ভাবনা দেখা দেয়। আমাদের চারপাশে হাবীব আহসানের মতো কয়জন শিল্পতৃষ্ণায় পুড়তে থাকা মানুষ দেখা যায়! অধিকাংশ মানুষকেই তো দেখি চালাকিদ্বারা সাফল্য অর্জন করায় প্রয়াসী হতে। হাবীব ভাইয়ের জন্য আমার সব সময় হৃদয় আর্দ্র হয় এইজন্য যে, চালাকি কী করে করতে হয় তার বিদ্যায় জন্মাবধি তিনি ছিলেন প্রতিবন্ধী!

যতদিন বেঁচে থাকব তাঁর স্মৃতি আমাকে উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করবে। যখনই সংগীতের স্বাদ নিতে যাব হাবীব ভাই আমার সঙ্গে থাকবেন মৃদু হাসি নিয়ে; আমি যে রসিক হয়ে ওঠার পথে তাঁর নির্দেশনা নিতে পারছি তাতে তাঁর ভূমিকার সাফল্যের আনন্দের হাসি সেটা।

(ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী

বিডি প্রতিদিন/ফারজানা



এই পাতার আরো খবর