ঢাকা, সোমবার, ২৯ জুলাই, ২০২৪

আজকের পত্রিকা

সফল হবার দৌড়ে সন্তানদের অমানুষ করে গড়ে তুলছেন; সে খবর কি রাখছেন?
ওহিদুর রহমান টিপু
ওহিদুর রহমান টিপু

দুটো বাচ্চা ছেলেকে (একটার বয়স ১৪/১৫ হবে, অন্যজনের বয়স হবে ৭/৮) ঘরে ঢুকতে দেয়া হচ্ছিলো না। এরা দুই ভাই। বাবা'র সাথে তাদের ধানমন্ডি'র বাসায় থাকতো। বাবা-মা'র বিবাহ বিচ্ছেদ হবার কারণে মা এই বাসায় থাকতো না।

দুই মাস আগে তাদের বাবার মৃত্যু হয়। যার কারণে এই দুই ভাই এক রকম এতিম হয়ে  যায়। বাবার মৃত্যুর পর একা হয়ে যাওয়ায় তারা কিছু দিনের জন্য তাদের মায়ের বাসায় গিয়েছিল।

গত পরশু মায়ের বাসা থেকে তাদের ধানমন্ডির বাসায় ফিরলে; তাদের চাচা, যিনি কিনা একজন ব্যারিস্টার; তাদেরকে বাসায় ঢুকতে দেয়নি। রাস্তা থেকে'ই বের করে দিয়েছে। বলেছে- পরের দিন আসতে।

এই দুই ভাই পরের দিন অর্থাৎ গতকাল আবার গেলে তখনও তাদের ঢুকতে দেয়া হয়নি। দারোয়ান তাদের বলেছে -স্যারের অনুমতি নেই। তো, কে এই স্যার? এই দুই ছেলের চাচা। এই দুই ছেলের বাবা এবং তার ভাই (মানে ছেলে দুটোর চাচা ); এরা দুই ভাই পৈত্রিক সম্পত্তি হিসেবে পাওয়া ধানমন্ডির এই বাড়িতে থাকতো। এই দুই বাচ্চা ছেলের দাদা কে ছিল জানেন? বাংলাদেশের সাবেক এটর্নি জেনারেল। যিনি নিজেও একজন ব্যারিস্টার ছিলেন। আমি যেবার হার্ভাডে চান্স পাই বাবাকে ব্যারিস্টারের উদাহরণ দিয়ে বলেছিলাম আজ আমি ব্যারিস্টারি পড়লেওতো তোমার টাকা খরচ হতো। তো আবারো বলছি এডভোকেট না, ব্যারিস্টার।

অর্থাৎ পুরোপুরি স্বচ্ছল, বিত্তবান পরিবার। এই এটর্নি জেনারেল আরও আগেই মারা গিয়েছেন। তার দুই পুত্র পরিবার নিয়ে ধানমন্ডির এই বাসায় থাকছিলো। বড় ভাই পরিবার নিয়ে এক তলায় থাকছেন। ছোট ভাই অর্থাৎ এই দুই বাচ্চা ছেলের বাবা, যার স্ত্রী ছিল না বিচ্ছেদ হয়ে যাওয়ার কারণে; তিনি এই দুই বাচ্চা ছেলেকে নিয়ে আরেক তলায়  থাকছিলেন।

দুই মাস আগে হঠাৎ তিনি মারা যাবার পর এই দুই বাচ্চা ছেলে এতিম হয়ে গেলে তারা তাদের মায়ের বাড়ি গিয়েছিল কয়েকদিনের জন্য। ফিরে এসে দেখে - তাদের চাচা সব কিছু দখলে নিয়ে ফেলেছে। বাড়ি'র দারোয়ান পর্যন্ত তাদের ঢুকতে দিচ্ছে না। কারণ স্যারের অনুমতি নেই!

বাচ্চা এই দুই ছেলের যাওয়ার আর কোন জায়গা নেই। রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছেলে দুটো  কাঁদছিল। এদের ফুফু এরপর এসে চেষ্টা করেছে দুই ছেলেকে যদি বাড়িতে ঢুকিয়ে  দেয়া যায়।

কিন্তু তার ভাই; মানে এই দুই বাচ্চা ছেলের চাচা উল্টো ফুফুকে পর্যন্ত হুমকি দিয়েছে! শেষমেশ বাধ্য হয়ে এরা ধানমন্ডি থানায় গিয়ে আবেদন করেছে- এই বাচ্চা দুটো ছেলেকে যেন পুলিশ সাহায্য করে।

পুলিশ বলেছে চেষ্টা করবে। এরপর কি হয়েছে জানেন? পুলিশ ওই ব্যারিস্টার, মানে তাদের চাচার সাথে যোগাযোগ করে বাচ্চা দুটো এবং তাদের ফুফুকে জানিয়েছে। 

-উপরের নির্দেশ আছে। আমাদের পক্ষে কিছু করা সম্ভব না। এই হচ্ছে মূল কাহিনী। চিন্তা করে দেখুন অবস্থা। আপন চাচা, নিজ ভাইয়ের ছেলে দুটোকে রাস্তা থেকে দারোয়ান দিয়ে তাড়িয়ে দিয়েছে। ভাইয়ের মৃত্যুর পর ছেলে দুটোকে চিনতে পারছে না।

তো, এরা কি গরীব? আমরা কথা বলছি দেশের সর্বচ্চ আইন কর্মকর্তা, সাবেক এটর্নি জেনারেলের পুত্র এবং তার নাতিদের নিয়ে। যার কিনা ধানমন্ডির মতো অভিজাত এলাকায় বিশাল বাড়ি আছে,  গুলশানে প্লট আছে, আরও নানান কিছু আছে।

এই পরিবারের ছেলে, যিনি নিজেও একজন ব্যারিস্টার; তিনি তার আপন ভাইয়ের মৃত্যু'র পর তার সন্তানদের আর চিনতে পারছে না। পৈত্রিক সূত্রে ওই বাড়ি'র মালিক এই দুই বাচ্চা ছেলেও। অথচ এই চাচা কিনা সব কিছু দখলের জন্য প্রকাশ্য দিবালোকে এই ছেলে দুটোকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে! দারোয়ান দিয়ে তাড়িয়ে দিয়েছে।

যা হোক, এই ছেলেগুলোর সৌভাগ্য যে তাদের এই ঘটনাটি টেলিভিশনে প্রচার হয়েছে।

গতপরশু মধ্য রাতে টেলিভিশনের আলোচনা অনুষ্ঠানে এই দুই ভাই এবং তাদের ফুফু অনেক  অনুনয়-বিনয় করে সবার কাছে অনুরধ করছিল- যাতে তারা বাসায় থাকার জায়গা পায়।  নিজেদের পড়াশুনা টুকু চালিয়ে যেতে পারে। কারণ ওদের তো আর কিছু নেই।

আমি নিজে এই অনুষ্ঠান সরাসরি দেখছি। এইসব শুনছিলাম আর আমার বুক কেঁপে উঠছিল এটা ভেবে- এটাই বাস্তবতা, এটাও সম্ভব।

এতোটা অমানবিকও মানুষ হতে পারে। রাস্তা থেকে ছেলেগুলোকে তাড়িয়ে দিয়েছে। তবে আমি বাস্তবতাও জানি। মানুষের অমানুষ হবার দৃশ্য আমিও নিজ চোখে দেখেছি।

এই পরিবারের কি কোথাও টাকার অভাব আছে? কোন কিছুর কমতি আছে? নামকরা একটা পরিবার। অথচ দেখুন সম্পত্তি আর টাকার লোভে এদের চাচা কতোটা নিচে নেমে গিয়েছে।

কেন এমন আচরণ করছে? আমি শত ভাগ নিশ্চয়তা দিয়ে বলতে পারি, এই ছেলে দুটোর দাদা মানে সাবেক এটর্নি জেনারেল, তার দুই ছেলেকে সঠিক শিক্ষা দিয়ে যেতে পারননি। এই জন্য তার সন্তানরা হয়ত ব্যারিস্টার হয়েছে; সম্পদের মালিক হয়েছে; সাফল্যের  পেছনে ছুটেছে। পৈত্রিক সূত্রে অর্থবিত্তের মালিকও হয়ত হয়েছে। কিন্তু মানুষ হতে পারেনি। যেই মানুষ আপন ভাইয়ের মৃত্যু'র পর তার সন্তানদের বাড়ি থেকে রাস্তায় বের করে দেয়; সে তো কোন ভাবেই মানুষ হতে পারে না। অথচ এই লোক কিনা হাই-কোর্টের ব্যারিস্টার!

আমি এই দুই ছেলের কথা শুনছিলাম আর হঠাৎ আমার নিজের অভিজ্ঞতার কথা মনে হচ্ছিলো। সেই অমানুষদের গল্প না হয় অন্য কোন সময় করা যাবে। যা হোক, আমার মতো অনেকে'ই পরশুর ওই আলোচনা অনুষ্ঠান নিশ্চয় সরাসরি দেখছিল। হাইকোর্টের এক বিচারপতি এই অনুষ্ঠান দেখে কাল মধ্য রাতেই আদালত বসিয়ে রুল জারি করেছেন-যাতে পুলিশ এই বাচ্চা ছেলে দুটোকে তাদের বাসায় ঢুকানোর ব্যবস্থা করে।

আদালত নিজ থেকে রুল জারি করে আপাতত হয়ত পুলিশকে নির্দেশনা দিয়েছে। এটা অতি অবশ্য'ই চমৎকার বিষয়। কিন্তু এই দুই বাচ্চা ছেলেকে তো ওই চাচার সাথে এক বাসাতেই থাকতে হবে। যেই  চাচা তাদের বাসায় ঢুকতে দিচ্ছিল না; তাদের ফুফুকে, মানে নিজের বোনকে পর্যন্ত হুমকি দিচ্ছিল; এই চাচা পরবর্তীতে যে এদের কোন ক্ষতি করবে না; এর কোন নিশ্চয়তা আছে?

বাচ্চা দুটো এই বয়সে দেখছে- পৃথিবীর মানুষ কতোটা অমানবিক, অমানুষ হতে পারে। জানি  না, বেঁচে থাকলে বড় হয়ে এর প্রভাব এদের মনোজগতে কিভাবে পড়বে।

তবে এতটুকু জানি, আপনারা যারা নিজদের সন্তানদের, পরিবারের ছোটদের কিংবা অন্য যে কাউকে স্রেফ সফল হতে বলেন; গাড়ি-বাড়ি'র মালিক হতে শেখান; তারা একবার চিন্তা করে দেখুন এই পরিস্থিতি।

আপনার নিজের আপন ভাই, আপনার মৃত্যুর পর আপনার সন্তানদের বাসা থেকে বের করে দিচ্ছে। আপনার সন্তানরা রাস্তায় দাঁড়িয়ে কাঁদছে। কারন তাদের আর কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। আগে মানুষ হতে শেখান। মানবিক হতে শেখান।

গাড়ি-বাড়ি এবং সফল হবার দৌড়ে যে সন্তানদের অমানুষ করে গড়ে তুলছেন; সে খবর কি রাখছেন? 

সন্তান হয়ত একদিন গাড়ি-বাড়ির মালিক হবে। সফলও হবে। এরপর একটা সময় তার নিজের পিতা-মাতাকেই আর চিনবে না।

আমার খুব ওই দারোয়ানের ইন্টার্ভিউ নিতে ইচ্ছে করছে। যে কিনা বাচ্চা ছেলে দুটোকে বলেছে -স্যারের অনুমতি নেই। ঢুকতে দেয়া যাবে না। এ  তো নিশ্চয় সেই একই দারোয়ান, যে কিনা এই দুই বাচ্চা ছেলের বাবা যখন বেঁচে  ছিল; তার অধীনেও কাজ করেছে। এই দারোয়ান যখন এই বাচ্চা ছেলেদের ঢুকতে  দিচ্ছিল না বাসায় এবং বলছে - স্যারের অনুমতি নেই; তখন কি সে মনে মনে উপহাস  করছিল আর ভাবছিল -তোমরা  শিক্ষিত, বড়োলোক আর নামকরা পরিবার। সমাজে তোমাদের অনেক নাম-ডাক। কিন্তু  তোমরা তো মানুষ'ই হতে পারোনি। এর চাইতে দারোয়ান হয়ে আমি'ই বরং ভালো আছি।  অন্তত আমার সন্তানদের রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতে হচ্ছে না। ছেলে-মেয়েদের  মনুষ্যত্ব শেখান। মানবিকতা শেখান। মানুষ হতে শেখান। 

পুনশ্চ: আমার বড় ভাইয়ের দুই ছেলে মেয়ে মানে আমার ভাতিজা ভাতিজি মাগুরা সরকারী স্কুলে লেখাপড়ার সুযোগ পাওয়ার পর তাকে পরিবারসহ বাসা ভাড়া করে থাকতে দেখে নিজের কষ্টার্জিত জমানো যে সামান্য অর্থ, তা দিয়ে একটি স্বল্প মূল্যে বাড়ি ক্রয় করে দিয়েছিলাম। দেশের সব চাচারা কেন ইতর হতে যাবে? কিছু চাচারা এখনো শান্তির বার্তা নিয়ে ভায়ের সন্তানকে নিজের সন্তান মনে করে বড় করতে ভীষণ ব্যস্ত। ঐ বাচ্চা দুটো ভালো থাকুক।

বি:দ্র: কিছু লেখা সংগৃহীত।

(লেখকের ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)

বিডি প্রতিদিন/হিমেল



এই পাতার আরো খবর