ঢাকা, সোমবার, ২৯ জুলাই, ২০২৪

আজকের পত্রিকা

‘অথচ ওরা টোকাই বলে নাক সিঁটকাই, ভালো ব্যবহার করি না’
আসিফ ইকবাল

"থাট্টি ফার্স্ট নাইটে কত্ত আতশবাজি পুড়াইবেন। কত্ত বোম ফুডাইবেন। কত্ত ট্যাকা খরচ করবেন। আর আমরা এহনও রাইতে খাই নাই।" কথাগুলো শুনে থমকে গিয়েছিলাম অনেক সময়। স্বাভাবিক হতে বেশ সময় লেগেছিল।

রাস্তার পাশে পড়ে থাকা সুয়ারেজ লাইনের বড় বড় পাইপে শুয়ে রাত পার করা কোনো একজন টোকাইয়ের মুখে এমন কথা শুনে থমকে যাওয়াই স্বাভবিক! ৯ বছর বয়সী আবুল কাশেমের মুখে এমন কথা আমায় বাকরুদ্ধ করে দিয়েছিল সেদিন।  তারিখটা ছিল ৩১ ডিসেম্বর। সময় রাত ১১টা। তালতলার একটি কফি শপ থেকে বের হয়ে বাসায় ফিরছি। খিলগাঁও মডেল কলেজের গেটের পাশে বড় একটি পাইপের সামনে কাশেমের সাথে আমার হঠাৎ দেখা। পাইপে শুয়ে থাকতে দেখে আমার অনুসন্ধিৎসু মন তাদের সাথে কথা বলি। ছবি তুলতে চাইলে কাশেমের বন্ধু শুক্কুর রাজী হয়নি। কেন রাজি হয়নি, কারণটা আমায় বলেনি। তবে ক্ষুধা পেটে পূর্ণিমার চাঁদকেও ঝলসানো রুটি লাগে! সেখানে ক্ষুধার্ত শুক্কুর ছবি তুলবে কেন? আর কাশেমই কেন বলবে না?

কাশেমের কাছে রাতের খাবার না খাওয়ার কথা শুনে মনটা কেঁদে উঠে। রাত সাড়ে ১১টা পর্যন্ত খায়নি শুনে পাউরুটি, কলা ও মিস্টি কিনে দেই। কিনে দেওয়ার সময় কাশেমের মুখে যে হাসিটা দেখেছিলাম, সেটা লাখ টাকা দিয়েও কেনা যাবে না! ওদেরকে খাবার খেতে দিয়ে চলে আসি। বাসায় তখন মাঈশা ও রুসলান অপেক্ষায় ছিল আমার।  সুয়ারেজ পাইপে শুধু কাশেম ও শুক্কুরই থাকে না, দুটি কম্বল ভাগযোগ করে ছয় বন্ধু ঘুমায়। কাশেম ও শুক্কুরের বাড়ি সিলেট। হৃদয় জানে না কোথায় তার বাড়ি। কুমিল্লায় বাড়ি আকাশের। শামীমের বাড়ি খুলনা ও মামুনের বাড়ি চট্টগ্রাম।  ছয়জন জানে না তাদের বাবা মা কোথায়। শুক্কুর বলে, "ছোটবেলায় মা আমারে ঢাকায় রাইখা চইলা গেছে। জানি না কোথায় থাকে।" একই কথা কাশেমেরও। মামুন মাইরের ভয় একদিন রাতে চট্টগ্রাম ছাইড়া ঢাকায় চলে আসে। শামীম জানায় তার মা বেঁচে আছে, "মা ছোট বেলায় আমারে ঢাকায় রাইখা যায়নি। আমি সায়দাবাদ বাস টার্মিনাল থেকে হারাইয়া যাই। এখন বলতে পারুম না মায় কই থাহে?" হৃদয় কিছুই বলতে পারে না মা-বাবা সম্পর্কে।

গতকাল হঠাৎ দেখা শুক্কুরের সাথে। হেঁটে আসছি, তখনই দেখা। চিৎকার করে দৌড়ে কাছে চলে আসে এবং জানতে চায়, "কেমন আছেন মামা?"

ডাক শুনে দাঁড়িয়ে পড়ি এবং মাথা ঝাঁকিয়ে বলি, "আলহামদুলিল্লাহ। তোরা কেমন আছিস?"

"আমরাও ভালো আছি। আপনার কতা জিগায় ব্যাক্তে। এহন সবাই ঘুমাইতেছে। ভোরে উইঠা কাজে বাড়ামু।"

ছয় বন্ধু এক সাথে থাকে এবং ভাঙারির কাজ করে। কাল রাতে বাটারবন, মিস্টি কিনে ওদের সাথে আড্ডা মারি ঘণ্টাখানেক। টোকাই হলে হবে কি? দারুণ আড্ডাবাজ। ফূর্তিও আছে মনে। আর এক বন্ধুর আরেক বন্ধুর প্রতি টান ও মোহাব্বতও বেশি।

কাশেম, শুকুরদের মতো আমাদেরও সন্তান আছে। আমরা আমাদের সন্তানদের মুখে হাসি দেখতে দিনরাত এক করে ফেলি। অথচ ওরা টোকাই বলে নাক সিঁটকাই, ভালো ব্যবহার করি না। আর খাবার দেওয়ার কথা ভাবতেই পারি না। মানসিক দূরত্ব থাকতে পারে। তারপরও কাশেম, হৃদয়, আকাশ, শুকুর, মামুন ও শামীমদের দিকে আমরা যদি একটু হাসিমুখে, ভালোভাবে কথা বলি, সামর্থ্য থাকলে খাবার কিনে দেই, তাহলে ওদের মুখের হাসিটুকু আমাদের মনে প্রশান্তি যোগাবে, কোনো সন্দেহ নেই।

লেখক: সিনিয়র ক্রীড়া সাংবাদিক

(ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)

বিডি প্রতিদিন/ফারজানা



এই পাতার আরো খবর