ঢাকা, রবিবার, ২৮ জুলাই, ২০২৪

আজকের পত্রিকা

এটিএম শামসুজ্জামানের ইবাদত, রাজীব ও মালয়েশিয়ার সেই সব দিন
দেবী গাফফার
দেবী গাফফার

চলচ্চিত্রের শিল্পীদের গল্প মানে আমাদের কাছে এক রূপকথার গল্পের মতো। তাঁদের সুখ দুঃখ, পাওয়া না পাওয়া মান  অভিমান। আমি ভাগ‍্যবতী বলবো নিজেকে এই অমূল্য তারকাদের সাথে আমার উঠা বসার সুযোগ হয়েছে। আজকের পার্ট ম‍্যালেশিয়া। ৯৬ সালের দিকে। কিছু কারণে ছবির নাম বা প্রযোজকের নাম উল্লেখ করা ঠিক হবে না। প্রথম অপ্রস্তুত হলাম ম‍্যালেশিয়া বিমানবন্দর নেমে। কাস্টমস দেখলেন, এক বস্তা চাল, এক বস্তা পিয়াজ, এক বস্তা আলু। আমাদের শুটিং টিমের। প্রযোজককে ডাকলেন। উনারা অর্থাৎ কাস্টমস কর্মকর্তা জিজ্ঞেস করলেন এসব কেনো? প্রযোজক বললেন, আমরা যে কয়দিন থাকবো এগুলো আমাদের রেসন। সব শিল্পীদের মুখ কালো হয়ে গেলো, একজন আর একজনের মুখের দিকে তাকাতে থাকলেন। পাঁচশ স্কয়ার ফিট একটা ফ্ল্যাটে আমাদের নিয়ে উঠালেন, সাথে সেই চাল, আলু, পিয়াজের বস্তা। আমরা বোধহয় টোটাল ১০ জন। আমাদের একটা রুম দেওয়া হলো, বাকিদের জন‍্য ঐটুকু জায়গা যথেষ্ট না। বাকিরা বলতে ওখানে  ছিলেন মোজাম্মেল স‍্যার। হুমায়ুন আহমেদ সাহেবের নাটকে কাজ করেছেন। এক সময় বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিলো উনার খুক খুক কাশি। আপনাদের নিশ্চিত মনে আছে। তাছাড়া উনি আদমজী  কলেজ এর  শিক্ষক ছিলেন। সাধারণত শিল্পীদের খাবার দাবার, থাকার ব‍্যাবস্থা প্রযোজক করেন। রাতের খাবার কি হবে? ঐ বস্তা থেকে খাবার চলবে। আমি একা মহিলা, বাকিরা পুরুষ। কি আর করা রান্না ঘরে ঢুকে সেই মোটা চালের ভাত আর আলু ভর্তা করে দিলাম, সবাই খুশি হয়ে পেট ভরে খেলো। মোজাম্মেল ভাই খুশি হয়ে বার বার আমার প্রসংসা করলেন। দোয়া দিলেন। আমাদের সাথে ডনও ছিলো। পরের দিন সবাই সারাদিন শুটিং থেকে ক্লান্ত হয়ে ফিরে। রাতের খাবার একই অবস্থা। আমি বের হয়ে ডাল তেল টুকি টাকি নিয়ে এসে সবার রান্না করি। সবাই মজা করেই খেতো। আমি মোটেও বিরক্ত ছিলাম না। আমার কাছে পিকনিক মনে হতো। মোজাম্মেল ভাই এর সাথে গল্প করে অনেক কিছু শিখতে পারছি। তৃতীয় দিনে রাজীব সাহেব এর অগ্নিমূর্তি দেখলাম। আমাকে বললেন, ব‍্যাগ গোছাতে। আমাকে নিয়ে বের হয়ে গেলেন। হোটেলে উঠলাম। থ্রি স্টার টাইপ হোটেল। স‍্যারসহ বেচারাদের একা ফেলে আসতে মায়া হচ্ছিলো। হাতে যেটূকু খুচরা টাকা কয়েন ছিলো, ফাইটার ছেলেদের হাতে দিলাম। নায়িকা ছিলো ভারতের প্রিয়াঙ্কা ত্রিবেদী। হঠাৎ বৃষ্টি ছবির নায়িকা। ও আর ওর মাকে অন‍্য বাসায় রাখা হয়েছিলো। ওদের ও একই অবস্থা, খাবার এর সমস‍্যা। প্রিয়াঙ্কা আর ওর মাকে নিয়ে রাতে বাইরে খাওয়াতাম। দিনের বেলা শুটিংয়ে সবাই এক জায়গায় হই। সবাই বিরক্ত। সিলিন্ডারে গ‍্যাস নেই। খাওয়ার কষ্ট, আবার প্রযোজক বলছেন, ওরা হট কেটলি নষ্ট করে ফেলেছে আলু সিদ্ধ করতে গিয়ে। যাই হোক সবাই অসন্তোষ প্রকাশ করছে, শুটিং বন্ধ হয়নি। জহুর বারু সৈকতে শুটিং এর অবসরে আমি আর মোজাম্মেল ভাই গল্প করতাম আর কাঁদতাম। কারণ স‍্যারের ১১  বছরের তাজা ছেলেটা মারা গেছে কিছুদিন আগে, আমার জয়-বিজয় ও নেই। কতো কথা কতো গল্প শেষ হতো না। সেই মোজাম্মেল স‍্যার আমাদের মাঝে নেই। আপনাকে অনেক মিস করি মোজাম্মেল ভাই। প্রিয়াঙ্কা বিয়ে করেছে, ভালো আছে। মা বাঙালি হওয়ার কারণে ও খুব মিশুক। ওর সাথেও অনেক গল্প হতো। হুমায়ুন আহমেদ সাহেব এর একটা প্রোগ্রাম সম্ভবত হোটেল সোনারগাঁয়ে। রাজীব সাহেব এর শিডিউল না থাকায় আমাকে যেতে হয়েছে। আমি উনার কিছু বই পড়ে জেনেছি, উনার গল্পের বেশিরভাগ নায়িকা নীল শাড়ি পরেন। আমিও নীল শাড়ি পরেছিলাম। দেখা হওয়ার পর বললাম, রাজীব সাহেব কেনো যেতে পারেননি, উনার পক্ষ থেকে ক্ষমা চাইলাম। মুচকি হেসে বললেন, ভাবী  এই রঙের শাড়ী আপনাকে বেশ মানিয়েছে। আমিও সাথে সাথে বললাম, আপনার গল্পের নায়িকা হওয়ার চেষ্টা, হা হা। ভালো মানুষ। উনার ব‍্যক্তি জীবন বাদ দিলে, আর একজন হুমায়ুন আহমেদ আমরা পাবো কি না, কে জানে! আমাদের এটি এম শামসুজ্জামান ভাই। আমার বাচ্চারা যখন মারা যায় সবার মতো এটি এম ভাই-ভাবিও পাশে ছিলেন। প্রতিদিন যোগাযোগ করতেন।  সমস্যা ছিলো আমার বাচ্চা নেওয়া নিয়ে। আবার বাচ্চা আসলে হয়তো জয়, বিজয়কে হারানোর বেদনা কিছুটা লাঘব হবে। আমি ডাক্তার এর দরজায়, দরজায় ঘুরতে থাকি। এটিএম ভাই জানতে পেরে, আমাকে হুকুম করলেন, বৌমা কালকেই তোমার ভাবির সাথে নারিন্দার পীর সাহেবের কাছে যাবে। কি করা! আমি ভাবির সাথে কয়েকবার গিয়েছি। তাবিজও বেঁধেছি। এটি এম ভাই এর বাসায় দেখতাম নারিন্দার হুজুরের ঔষধে রেক ভরা। ভাবী কিছুটা  অসুস্থ ছিলেন ঐ সময় জেনেছিলাম ভাবি কোন ডাক্তার দেখান না। হুজুর এর ওষুধ খান। পরবর্তীতে ডাক্তার দেখিয়েছিলেন কি না জানি না। নারিন্দার হুজুর আমাদের বাসায়ও আসতেন। কিছুদিন পরে কড়া হরতাল। উত্তরায় শুটিং। এটি এম ভাই আমাদের উত্তরার বাসায় থেকে শ্যুটিং করবেন। রুম গুছিয়ে সব ব‍্যবস্থা করে দিলাম। আমি বলবো ওরকম একজন আল্লাহ্ ওয়ালা মানুষ আমি দেখিনি। কোন কিছুর সমালোচনা করতে শুনলাম না। সারারাত রুমে লাইট জ্বলতো। আমারও ঘুম নেই। যতরাত হোক উঁকি দিয়ে দেখতাম হাতে তজবি দোয়া পড়ছেন। কখন ঘুমাতেন, সারাদিন কি করে কাজ করেন, জিজ্ঞেস করলে বলতেন, আল্লাহ্ শক্তি দেন। আলহামদুলিল্লাহ্ উনার মতো একজন সাদা মানুষের সেবা করার সুযোগ পেয়েছি। কথায় কথায় জানলাম, উনার কোন ব‍্যাংক ব‍্যালেন্স নেই। এতো ছবিতে কাজ করেন, টাকা কই? বললেন, এক লাখ টাকা জমলেই মহা খুশি, ওমরা করতে চলে যান। রাজীব সাহেব যখন হলি ফ‍্যামিলিতে ভর্তি, বাঁচার আশা নেই। সেদিন এটি এম ভাই আর রাজীব সাহেবের গলা জড়িয়ে কাঁন্না থামাতে পারছিলাম না। আমিসহ ডাক্তার নার্স ও কেঁদেছিলেন। আমি উনার দোয়া পেয়েছি। একদিন আমরা সব নাই হয়ে যাবো। এমন কাজ করি যেনো মানুষ বলে আহারে ভালো মানুষ ছিলেন।

 

(ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)

 

বিডি প্রতিদিন/ফারজানা

 



এই পাতার আরো খবর