ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ জুলাই, ২০২৪

আজকের পত্রিকা

বম্বের রাতদিন
দেবী গাফ্ফার
দেবী গাফ্ফার

সম্ভবত এপ্রিলের ২৫ তারিখ ২০০৪ উনার অপারেশন এর ডেট পড়লো। যেদিন অপারেশন সেদিন থেকে রোগীর রুম ক‍্যানসেল। টাকা দিলেও রোগীর কোনো আত্মীয় ঐ রুমে  অবস্থান করতে পারবে না। বোম্বের হোটেলগুলো প্রতি মূহূর্তে মনে করে বাংলাদেশের লোক মানে খাতারনাক। বাংলাদেশিদের হোটেলে রুম দেয় না। অপারেশন হলো, বম্বের কোনো হোটেল আমার বাংলাদেশের পাসপোর্ট দেখে রুম দিলো না। আমার ঢাউস একটা ব‍্যাগসহ আমার জায়গা হলো, কয়েকটা সোফাসহ একটা রুমে। যেটা ওয়েটিং রুম। অনেকেই আছেন ঐ রুমে। আমি ও তাদের মতো একজন। সারাক্ষণ বুকটার মাঝে তিন বাচ্চার জন্য হাহাকার। আহারে আমার দুধের বাচ্চারা কেমন আছে। আমি কি করবো? মা হিসেবে দায়িত্ব পালন করবো? না কি মানবিকতা প্রকাশ করবো? তিনদিন হয়ে গেলো আমি খাইনি, গোসল করিনি, আমি একটা মুহূর্তের জন্য ঘুমাইনি। এই তিন দিনে আমার পরিধেয় বস্ত্র কেমন যেন ভার, আঠা। একদিন উনার পিএস বললো, ম্যাডাম আমাকে একটু ভাত খাওয়ান। আমি কোথায় ভাত পাবো, ওকে নিয়ে অনেক্ষণ হেঁটে রাস্তায় ফ্রাইড রাইস আর চিকেন গ্রেভি পেয়েছিলাম। আমাদের পিএস লোকমান বরিশালের মাছে ভাতে মানুষ। ওতো এই খাবার দেখে কাঁদো কাঁদো অবস্থা। ও কোথায় থাকতো এতোদিন পরে তাও মনে নেই। কতোদিন আমি ভাত খাইনি, গোসল করি না, আমি ঘুমাই না। আমার বাচ্চাদের দেখি না। ও আল্লাহ্ এ কোন পরীক্ষা। হিন্দোজা হাসপাতালের নিচে চা, কফি, ভেজিটেবল পেটিস আর দেখতে কেক এর মতো কিন্তু কেক না। ইন্ডিয়ান খাবার এর  নাম ধোকলা, এই খাবার খেয়ে কতোদিন থাকা যায়? এক বালতি ঠাণ্ডা পানি দিয়ে একটু গোসল করতে পারলে প্রাণ জুড়াতো। আহা আমি একটু ডাল দিয়ে ভাত খেতে পারতাম? এভাবে কয়দিন মনে নেই। একদিন লোকমানকে বললাম, ‌‘আমি একটু গোসল করে একবেলা ভাত খেতে চাই লোকমান।’ লোকমান বললো, ‘মেডাম বরিশালের এক মেয়ে আছে এখানে থাকে, আপনার আপত্তি না থাকলে ওর বাসায় আপনাকে নিতে পারি।’ আমি তো মহাখুশি। বললাম, ‘ভাতের ব‍্যবস্থা কর।’ অল্প সময়ের জন্য লোকমানের সাথে ঐ মেয়ের বাসায় রওয়ানা দিলাম। ভিতরে ধুকপুক করছে, কখন ডাক্তার ডাক দেয়। তাড়হুড়ো করে ঐ মেয়ের বাসায় রওয়ানা দিই, বাসা কাছেই। মেইন রোডের সাথে বস্তি। এক রুমের বাসা, সামনে চটের বেড়া। আমার কাছে তখন হাজার ডলার। কিছু কিছু সময় টাকা কোনো কাজে লাগে না। বাসায় পৌঁছে একটু থমকে গেলেও নিজেকে সামলে জিজ্ঞেস করি, গোসল করার জায়গা আছে? রুমের সাথেই চটের আড়াল দেওয়া এক বালতি পানি আমার জন্য প্রস্তুত ছিলো। আমি প্রশান্তি নিয়ে গোসল সারি। অধীর হয়ে এক থাল ভাতের অপেক্ষা করছিলাম। ওরা গরম একথাল ভাত দিয়েছিলো আহা। সাথে ডাল, আলু ভর্তা বা ডিম হতে পারে। আমি বেহেশত দেখিনি, ওখানকার খাবার কেমন হয় তাও দেখিনি। সেদিন মনে হয়েছিলো এই তো বেহেশতি খানা। ঐ মেয়েটার কথা, সুখী চেহারা এখনো চোখে ভাসে। শ্বশুর, শ্বাশুড়ি স্বামীসহ ঐ এক রুমে চারজন থাকে, ওরা ভালো আছে। খাটের নিচে স্বামী-স্ত্রী, খাটে শ্বশুর, শ্বাশুড়ি নিয়ে ওদের সুখের এক টুকরো জীবন। ওরা ভালো আছে। ভালো থেকো মেয়ে।

 

(ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)

 

বিডি প্রতিদিন/ফারজানা



এই পাতার আরো খবর