ঢাকা, শুক্রবার, ২৬ জুলাই, ২০২৪

আজকের পত্রিকা

ওজন দরে বই এবং একটি বই বাজারের মৃত্যু
আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু

রদ্দি মাল হিসেবে আমরা পুরোনো সংবাদপত্র, ছেড়া-ফাটা বই ওজন দরে বই বিক্রি করতে অভ্যস্ত। কিন্তু নতুন বই কিনতে হলে বইয়ের গায়ে লেখা দামেই কিনতে হয়। কোথাও কিছু কমিশন পাওয়া যায়, অনেকে কমিশন দেয় না। ওজন দরে হোমার, রুডইয়ার্ড কিপলিং, আরব্য উপন্যাস, শেক্সপিয়র, অথবা জনপ্রিয় লেখক জন গ্রিশাম, ডেনিয়েল স্টিলের বই এবং শার্লক হোমস, ড্যান ব্রাউন, জেফ্রি আর্চার এবং ফিফটি শেডস অফ গ্রে’র পুরো সিরিজ কেনা যেতে পারে তা আমরা ভাবতেই পারি না।

কিন্তু বইয়ের দোকানে সমৃদ্ধ দিল্লির দরিয়াগঞ্জে বড় ও প্রাচীন বইয়ের দোকানগুলোতে নতুন, অব্যবহৃত বই বিক্রি হচ্ছে ওজন দরে। বইয়ের ধরন  অনুযায়ী প্রতি কিলোগ্রাম ১০০ রুপি থেকে ২৫০ রুপি পর্যন্ত। শার্লক হোমস ও শেক্সপিয়র সমগ্র ২৫০ রুপি কেজি, ইংরেজি ও হিন্দি অভিধান ২০০ রুপি কেজি। পুরোনো ক্লাসিকস বই ১৫০ রুপি কেজি। শুধু বই নয়, রেজিস্টার, নোটবুক, ক্যালকুলেটর, পেন্সিল ও ম্যাগনিফাইং গ্লাসের প্রতি কেজি ২০০ রুপি। কবীরের দোহা, প্রেমচাঁন্দ ও চাণক্য নীতি থেকে শুরু করে হিন্দি সাহিতের বিশাল সম্ভাব থেকে বই বেছে নিতে পারেন প্রতি কেজি ২০০ রুপি দরে।

দরিয়াগঞ্জের সব বইয়ের দোকানেই যে ওজন মেপে বই বিক্রি হয় তা নয়। অভিষেক জৈন এর মালিকানাধীন “বিগ বুক বাজার” ওজনে বই বিক্রির অগ্রপথিক। তাকে অনুসরণ করে এখন আরও অনেক বই বিক্রেতা ওজন দরে বই বিক্রি করছেন।

একটি বইয়ের বাজারের মৃত্যু দরিয়াগঞ্জের ইতিহাস মোগল আমলের সঙ্গে জড়িত, যখন দিল্লির নাম ছিল শাহজাহানাবাদ। তখন দরিয়াগঞ্জ ছিল ফৈয়াজ বাজার এবং মোগল দিল্লির গুরুত্বপূর্ণ অভিজাত বাণিজ্যিক কেন্দ্র। দুই পাশে চমৎকার সব সারিবদ্ধ বাড়ি ও গাছের সারি এবং কেন্দ্রস্থলে পানির ফোয়ারা। জায়গাটি ছিল উদ্যানের মতো। দরিয়াগঞ্জের স্থায়ী দোকানপাটগুলো ছাড়াও অর্ধ শতাব্দীর বেশি সময় যাবত দরিয়াগঞ্জে জুমা মসজিদের পেছনে ও কস্তুরবা গান্ধী হাসপাতালের কাছে প্রতি রবিবার বসত বইয়ের বাজার, যেটি পরিচিত ছিল “পত্রি কিতাব বাজার” বা “সানডে বুক বাজার” নামে। উন্মুক্ত স্থানে বইয়ের পসরা নিয়ে বসতো দোকানিরা। প্রথম দিকে চার/পাঁচটি বইয়ের দোকান বসতো, যা দিনে দিনে ২৫০টিতে উন্নীত হয়। দুষ্প্রাপ্য প্রাচীন বই থেকে শুধু করে সদ্য প্রকাশিত বই পর্যন্ত’ হেন বই নেই যা পাওয়া যেত এখানে। কারও কোনো পছন্দের বই এক রবিবারে যদি নাও পাওয়া যায়, দোকানি বলে দেন পরের রবিবার আসতে।

বাজারের সবচেয়ে পুরোনো বই বিক্রেতা এ. এল. বর্মা বলেন, “এই বই বাজারের পেছনে একটি মেশিন কাজ করছে।” বইগুলো আসে বিভিন্ন উৎস থেকে। বাড়ি বাড়ি ঘুরে যারা পুরোনো জিনিসপত্র সংগ্রহ করে তাদের মাধ্যমে; যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য থেকে আসা বইভর্তি কনটেইনার, যেগুলো আমদানিকারকরা নির্দিষ্ট সময়ে ছাড় না করানোর কারণে কাস্টমস বিভাগ নিলামে তোলে; ব্যক্তিগত লাইব্রেরির মালিকের মৃত্যুর পর বইয়ের প্রতি অনাগ্রহী উত্তরাধিকারীদের দ্বারা বিক্রি করে দেওয়ার ধারাবাহিকতা এবং প্রকাশকদের অবিক্রিত বই। বই বাজারের আরেক দোকানি শরীফ আহমেদ বলেন, “দিল্লি সম্পর্কে যা জানতে চান আমার কাছে জেনে নিতে পারেন। আমি দিল্লির রাস্তায় বড় হয়েছি। দিল্লি আমার নখদর্পণে।”

কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই উন্মুক্ত বইয়ের বাজারের মৃত্যু ঘটেছে। দিল্লির ট্রাফিক বিভাগের দীর্ঘদিনের অভিযোগ ছিল যে পুরোনো দিল্লির এই এলাকায় রবিবারের দুঃসহ যানজটের কারণ বই বাজার। ২০১৯ সালে উচ্চ আদালত আদেশ দেয় সেখান থেকে বই বাজার অপসারণ করতে। বিকল্প প্রস্তাব আসে বইয়ের দোকানিরা আসফ আলী রোডে অবস্থিত “মহিলা হাটে” তাদের পসরা বসাতে পারে। কিন্তু সেখানে সব দোকানির স্থান সংকুলান হবে না বলে উচ্ছেদ হওয়ার পর ছয় মাস পর্যন্ত তারা সেখানে বইয়ের বাজার বসায়নি। জীবিকার তাগিদে স্বল্প পরমাণে বই নিয়ে কিছু দোকানি বসলেও ক্রেতার ঘাটতির কারণে তাদের সংসার চালানো কঠিন হয়ে ওঠে। বইয়ের খরিদ্দাররাও দোকানিদের সাথে সংহতি প্রকাশ করে পথে নামে।  খোলামেলা উন্মুক্ত স্থানের পরিবর্তে বেষ্টিত স্থানে “মহিলা হাট” এ প্রত্যেকের জন্য স্থান বরাদ্দ হয় ৬ ফুট X ৪ ফুট, সাপ্তাহিক ভাড়া ২০০ রুপি। এই পরিবর্তনকে একটি স্থানের পরিবর্তনের চেয়ে বেশি ঐতিহ্য বিলুপ্তির সাংস্কৃতিক পরিবর্তন বলে মনে করেন অনেক দিল্লিবাসী। “পত্রি কিতাব বাজার” পরিণত হয়েছে একটি “বুক মার্কেট” এ। এখানে ভিড় নেই, বই বিক্রিও কমে গেছে। বিক্রেতাদের জীবিকা নির্বাহ করা কঠিন হয়ে পড়েছে।

বিলুপ্ত ‘দরিয়াগঞ্জ বুক বাজার ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক প্রেসিডেন্ট কমর সাঈদ বলেন, “এখানে পকেটমারের উৎপাত নেই, মহিলারা অবাধে ঘুরতে পারে। ছোট জায়গা বলে সব বই ছড়িয়ে রাখা যায় না। সেজন্য বইয়ের বিক্রয় কমে গেছে।”

(ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)



এই পাতার আরো খবর