ঢাকা, শুক্রবার, ২৬ জুলাই, ২০২৪

আজকের পত্রিকা

বিদ্যানন্দ আর কিশোর দাসের নাম শুনেই বিচার করে ফেলেছে...
শংকর মৈত্র
শংকর মৈত্র

বিদ্যানন্দের কিশোর কুমার দাস, বহুজাতিক কোস্পানিতে চাকরি নিয়ে পেরু চলে যান। তিনি কোটি টাকার ওপর বেতন পেতেন। সেই টাকা থেকেই দেশের গরীব মানুষের জন্য কিছু করার চিন্তাভাবনা করেন। কারণ এতো টাকা তার খরচ হতো না। পেরুর সমুদ্রপাড়ের এক শহরে নিঃসঙ্গ থাকতেন।

অত্যন্ত গরীব ঘরের সন্তান কিশোরের শৈশব কেটেছে চরম দারিদ্র্যের মধ্যে। পেট পুরে খাবার জুটতো না। ক্ষুধার জ্বালা টের পেয়েছেন। অর্থভাবে পড়াশোনায় ব্যাঘাত ঘটেছে।  মেধার জোরে চট্টগ্রাম প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে দেশে বহুজাতিক কোম্পানিতে চাকরি করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন এক সচিবের মেয়ে সহপাঠী তাঁর প্রেমে পড়েন। এক পর্যায়ে তারা বিয়েও করেন। কিন্তু দরিদ্র পরিবারের সন্তান কিশোর আর তার স্ত্রী সচিবের মেয়ের মানসিক দূরত্ব থেকে বেশিদিন সংসার টেকেনি। তাদের ডিভোর্স হয়। বহুজাতিক কোম্পানির বড় পদে চাকরি নিয়ে কিশোর দেশ ছেড়ে পেরু চলে যান। সেখানে কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থ কামালেও কিশোর দাস তার শৈশবের দারিদ্রতা, ক্ষুধার কষ্ট ভুলতে পারেন নি।  ক্ষুধার কষ্ট কি, যে ক্ষুধার্ত থাকে সেই বুঝে।  সেই কষ্ট থেকেই তিনি ক্ষুধার্ত মানুষকে খাওয়ানোর ভাবনা করেন। পেরুতে তিনি যে নারীকে বিয়ে করেন তিনিও বিশাল অংকের বেতন পান। তাদের দুজনেরই প্রচুর টাকা। কিশোর ভোগ বিলাসে মগ্ন না হয়ে দেশে ক্ষুধার্ত মানুষকে একবেলা হলেও পেটপুরে খাওয়ানোর চিন্তা করেন। দেশে সমমনা স্বেচ্ছাসেবিদের নিয়ে বিদ্যানন্দ চালু করেন। শুরু করেন নিজের উপার্জিত অর্থ দিয়ে।  কিন্তু কেউ যাতে "মাগনা" খাওয়ার নামে হীনমন্যতায় না ভোগে সে থেকে এক টাকার বিনিময়ে আহার চালু করেন। টাকার অভাবে যাতে কোনো শিশুর পড়াশোনা আটকে না যায় সেই সহায়তা তারা করতে থাকেন। কিশোর ভোগ বিলাসে না যেয়ে মানব সেবায় জীবন দর্শন গ্রহণ করেন। পেরুর এক পাহাড়ে তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে একটি হোটেল করেন। সেই হোটেল থেকেও তার আয় হয়। সেখানে তিনি বেওয়ারিশ, অসুস্থ কুকুরদের জন্য একটি আশ্রয় কেন্দ্র খুলেন। কুকুরদের খাদ্য দেন, চিকিৎসা দেন।  কিশোর দাস পেরুর যে পাহাড়ে হোটেল করেছেন সেখানে একটি পাওয়ার স্টেশন রয়েছে। সেখানকার লোকজন হোটেলটিতে থাকে।  এই সবকিছুই আমি শুনেছি আর জে (দেশের জনপ্রিয় রেডিও উপস্থাপক) কিবরিয়ার কাছ থেকে। আর জে কিবরিয়ার সঙ্গে এক বিশাল সাক্ষাৎকারে কিশোর কুমার দাসের জীবনের গল্প শুনে আমি কেঁদেছিলাম। একজন মানুষ জীবনে এতো ত্যাগ কী ভাবে করতে পারে? একজন মানুষ এতো লোভ লালসার উর্ধ্বে কেমনে উঠতে পারে? আমার চেয়েও কম বয়সের কিশোর দাসের জীবনের গল্প শুনে আমি নিজেকেই প্রশ্ন করেছি, আমি কেনো মানুষের জন্য কিছু করতে পারি না? আমি কেনো একজন ক্ষুধার্ত মানুষকে প্রতিদিন খাওয়াতে পারি না? কিশোর সর্বস্ব দিয়ে দিচ্ছে। তার জীবন মহিমান্বিত। শুধু কী তাই? তাকে যাতে কোনো লোভ লালসা স্পর্শ করতে না পারে সে জন্য সে ও তাঁর স্ত্রী কোনো সন্তান পর্যন্ত নেবে না। যাতে উত্তরাধিকারের জন্য লোভ বা স্বার্থ কাজ করে এই ভয়ে। যদি মানুষের সেবা না করতে পারে!  এই ভোগবাদী সমাজে কিশোরদের মতো মানুষ জন্ম নেয়া, সর্বস্ব বিলিয়ে দেয়া, এটা নিয়ে যখন ভাবি তখন মনে হয়, আমরা কতো ক্ষুদ্রতা নিয়ে বেঁচে আছি।  আমি বিদ্যানন্দকে আজ পর্যন্ত একটি টাকাও দেইনি। আর জে কিবরিয়ার মাধ্যমে কিশোরের গল্প শুনে আমার মনে হয়েছে, সামর্থ্য অনুযায়ী আমিও বিদ্যানন্দের সঙ্গে কাজ করবো। নিজ উপর্জনের কিছু দেবো। যারা একজন ক্ষুধার্ত মানুষের মুখে একবেলা আহার দেয় তারাই মহান। মহাত্মা গান্ধী বলেছিলেন, একজন ক্ষুধার্ত মানুষের কাছে ঈশ্বরকেও রুটি হয়ে আসতে হবে। ক্ষুধার্ত মানুষকে খাদ্য না দিয়ে, নীতিকথা শুনালে তার ক্ষুধার জ্বালা মিটবে না।  ক্ষুধার্ত মানুষের কোনো জাত নেই, ধর্ম নেই, দেশ নেই। মূলত: প্রকৃত মানুষ যে তার কাছে কোনো ধর্ম, জাত, দেশ বিবেচনায় থাকে না। মানুষ আর মনুষ্যত্বই তার কাছে মহান। কিশোর বিদেশে বসে ভোগ বিলাসে জীবন কাটাতে পারতো। তা না করে সে মানব সেবায় নেমেছে। ইউনিক আইডিয়া নিয়ে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন করে, দেশের স্বেচ্ছাসেবকদের মাধ্যমে সেবা করে যাচ্ছে। কিন্তু কী অদ্ভুত মানুষ আমাদের! বিদ্যানন্দ আর কিশোর দাসের নাম শুনেই বিচার করে ফেলেছে এটা হিন্দুয়ানী সংগঠন, ভারতের র'এর সংগঠন, ইসকনের সংগঠন। স্বামী বিবেকানন্দ আর বিদ্যানন্দকে গুলিয়ে ফেলেছে। বাংলা নামের প্রতি এতো জিঘাংসা! অথচ বিদ্যার মধ্যে আনন্দ থেকে বিদ্যানন্দের নামকরণ করা হয়। নোংরা সাম্প্রদায়িক মানুষগুলো আদা-জল খেয়ে লেগেছে কিশোর আর বিদ্যানন্দের বিরুদ্ধে। এখানে তাদের কোনো যুক্তি নেই নোংরা সাম্প্রদায়িকতা ছাড়া। এতো নোংরা আর ঘৃণিত মানসিকতার এরা, ভাবলেই থু থু দিতে ইচ্ছে করছে। নিজেরা মলমূত্রত্যাগ ছাড়া আর কিছুই করবে না। চুরি করবে, বাটপারি করবে আর ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে সমাজে হিংসা ছড়াবে। আবার অন্য কেউ ভালো করলে তাকে টেনে নামানোর চেষ্টা করবে। এ দেশে সবচেয়ে সহজ হচ্ছে ধর্ম নিয়ে ঝাপিয়ে পড়া। মানবতা মনুষ্যত্ব কোনো কাজে আসবে না। অনুভূতির নামে হিংসার আগুন জ্বালিয়ে দাও।  নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করি এই জীবনের উদ্দেশ্য নিয়ে। কি রেখে যাবো? মাতৃগর্ভে  লড়াই করে জন্ম নিলাম, বড় হলাম, কর্ম করলাম, সংসার করলাম, সহায় সম্পদ করলাম, সন্তানাদি জন্ম দিলাম। তার পর টুস করে একদিন মরে যাবো। কেউ মনে রাখবে? স্ত্রী সন্তান হয়তো কিছু দিন। তার পর? সমাজে, মানুষের জন্য আমার অবদান কি? আমি যে ছিলাম কেউ কী মনে রাখবে? মনে রাখতে হলে সমাজে দাগ রেখে যেতে হয়। আমি পারছি না। এটা আমার ক্ষুদ্রতা, ব্যর্থতা, দৈন্যতা। এই প্রজ্ঞা, ত্যাগ মনের মধ্যে জাগ্রত হতে পারেনি। তাই ক্ষুদ্রতা থেকে সরতে পারছি না। কিন্তু যারা করছে তাদের স্যালুট জানাই। তারা মহান। তারাই পৃথিবীতে টিকে থাকবে। তাদের নামই অমরত্ব হবে। করোনা মহামারির সময় ভয়ে আমরা ঘর থেকে বের হইনি, মৃত্যু ভয়ে। কিন্তু তখন করোনা আক্রান্ত হয়ে যাদের মৃত্যু হয়েছে তাদের অনেকের দাফন করেছে, আল মারকাজুল নামের একটি সংগঠনের কর্মীরা। এই কর্মীরা নিজের জীবনকে তুচ্ছ করে করোনায় মৃত্যুবরণকারীর লাশ কাঁধে নিয়ে দাফন করেছে। সেটা নিয়ে আপন মনে ভাবতাম মানুষ কতো মহৎ হতে পারে। এটাকেই হয়তো বলে নিজের জীবন বিলিয়ে দিয়ে মানব সেবা করা। আল মারকাজুলের নাম শুনলেই আমি শ্রদ্ধায় অবনত হই। যারা এটা করেছেন তারা আমার কাছে মহামানব মনে হয়।  নিজে কিছু না করতে পারলেও যারা মানুষের জন্য কিছু করে, করছে তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি। সততা, সত্যতা অবশ্যই যাচাই করতে হবে। চোর বাটপারের অভাব নেই। সমাজ সেবার নামে চোর বাটপারি বেশি হয়। কিন্তু যারা প্রকৃতই মানব সেবা করে তাদের সহায়তা করা প্রত্যেকের কর্তব্য। জাত পাত ধর্ম এগুলোর উর্ধ্বে ওঠে যে মানব সেবা করতে পারে সেই মানুষ। বাকি সব ভণ্ড, স্বার্থান্ধ।

(বি.দ্র: বিদ্যানন্দ আর কিশোর দাসকে নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে যে নোংরামি চলছে, তা দেখে বিবেকের তাড়নায় লেখাটি লিখলাম। বিদ্যানন্দ বা কিশোরের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক আমার নেই। কোনোদিন এক টাকাও তাদের সহায়তা করিনি)।

(ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)

বিডি-প্রতিদিন/সালাহ উদ্দীন



এই পাতার আরো খবর