ঢাকা, শুক্রবার, ২৬ জুলাই, ২০২৪

আজকের পত্রিকা

আমেরিকার আমিশ সম্প্রদায়
ডা. মাহবুবর রহমান
ডা. মাহবুবর রহমান

বহুদিন থেকে আমেরিকার আমিশ সম্প্রদায় সম্পর্কে শুনে আসছিলাম। এবারের আমেরিকা যাত্রায় এদের জীবনযাপন সামনাসামনি থেকে অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ চলে এলো।

মেরিল্যান্ড থেকে সোজা উত্তর দিকে টানা তিন ঘণ্টার গাড়ি ভ্রমণ শেষে পেনসিলভানিয়া অঙ্গরাজ্যের ল্যাংকাস্টার কাউন্টিতে পৌঁছালাম। মেরিল্যান্ডের তুলনামূলক সমতল ভূমি পার হয়ে ছোট ছোট পাহাড় ঘেরা ঢেউ খেলানো পেনসিলভানিয়া প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর। এখানে এখন গ্রীষ্মকাল হওয়ায় চারিদিকে ঘন সবুজের উৎসব। ফসিল ফুয়েলের ব্যবহার মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে যাওয়ায় বিশ্বজুড়ে তাপমাত্রা অস্বাভাবিক হারে বেড়ে চলেছে। ফলে আগের চেয়ে এই অঞ্চলের উত্তাপও বেড়ে গেছে। তবে বাতাসে জলীয় বাষ্পের আর্দ্রতা কম থাকায় এখানের গরম অনেকটা সহনীয়।

কারা এই আমিশ সম্প্রদায়?

এখন থেকে প্রায় পাঁচশ বছর আগে সুইজারল্যান্ডে ক্যাথলিক চার্চের একটি ক্ষুদ্র অংশ বাইবেলের মৌলিক  নির্দেশনা  এবং প্রকৃতির সাথে ঘনিষ্ঠ  জীবনযাপন পদ্ধতি নিয়ে মূল চার্চের সাথে মতপার্থক্য দেখা দেয়ায় ব্যাপটিজম বিরোধী (অ্যানাব্যাপটিস্ট) একটি সম্প্রদায়ের উদ্ভব হয়। এরই একটি শাখা জ্যাকব আম্মান এর নেতৃত্বে আমিশ গোষ্ঠীর উৎপত্তি। ক্যাথলিক  চার্চের রীতি অনুযায়ী জন্মের পরপর শিশুকে পবিত্র পানি দিয়ে গোসল করিয়ে খৃষ্ট ধর্মে দীক্ষিত করা হয় যাকে ব্যাপটিজম নামে অভিহিত করা হয়। আমিশ মতে যেহেতু শিশু নিষ্পাপ হয়েই জন্মগ্রহণ করে তাই তাকে জন্মের পরপর  ব্যাপটিজম করার প্রয়োজন নেই। আমিশ মতে শিশু যখন বয়ঃসন্ধিকাল প্রাপ্ত হয় তখনই তার ব্যাপটিজম সম্পন্ন হয়। এইরূপ কিছু ধর্মাচার ও জীবনযাপন পদ্ধতি নিয়ে মতপার্থক্য তৈরী হওয়ায় মূল চার্চের সাথে আমিশদের দ্বন্দ্ব ক্রমেই বেড়ে চলে।

যেহেতু রাষ্ট্রের উপর চার্চের কর্তৃত্ব ছিল অপরিসীম তাই আমিশদের উপর রাষ্ট্র তথা চার্চের অত্যাচার ও নিপীড়ন ক্রমেই অসহনীয় হয়ে পড়ে।  ভিন্নমত পোষণ করার জন্য বহু আমিশ সম্প্রদায়ের মানুষকে হত্যা করা হয় ( স্মর্তব্যঃ আমাদের অঞ্চলের আহমাদিয়া সম্প্রদায়! )। তারা ধর্ম ও জীবন বাঁচাতে জার্মানী, হল্যান্ড সহ ইউরোপের অন্যান্য দেশে ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু ধীরে ধীরে ঐসব দেশের সরকার ও চার্চের অত্যাচারও বৃদ্ধি পেতে থাকে। ফলে ১৭২০ সালের দিকে আমিশরা দলে দলে আমেরিকায় পাড়ি জমাতে থাকে। আজকের আমেরিকার পেনসিলভানিয়া, ওহাইও সহ বিভিন্ন রাজ্যে তারা বসবাস করছে। তবে সবচেয়ে বড় সমাবেশ হলো পেনসিলভানিয়া রাজ্যের ল্যাংকাস্টার কাউন্টিতে। (কাউন্টি হলো আমাদের দেশের জেলাসদৃশ প্রশাসনিক ইউনিট)। শুধু এই কাউন্টিতেই রয়েছে প্রায় তিন লক্ষ আমিশ সম্প্রদায়ের বসবাস।

ঈশ্বর, পরিবার , কমিউনিটি ও প্রকৃতিঃ আমিশ দর্শনের মূল ফোকাস

আমিশদের কাছে সবার আগে ঈশ্বরের আদেশ শিরোধার্য। তারা বাইবেলের সব অনুশাসন এবং নির্দেশাবলী অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে বদ্ধপরিকর। এরপর আসে কমিউনিটি বা সম্প্রদায়ের মংগলার্থে  বিভিন্ন কার্যক্রম। আমিশরা মনে করে প্রকৃতি ঈশ্বরের প্রতিভূ। প্রকৃতির মধ্য দিয়ে ঈশ্বরের প্রকাশ। তাই প্রকৃতির কোন মৌলিক পরিবর্তন কাম্য নয়। এজন্য তারা অযান্ত্রিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ করে। প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে চলে আসা ঘোড়া দিয়ে হালচাষ করে ফসল উৎপাদন করে। ফসল উৎপাদন, কুটিরশিল্প এবং নিজেদের ব্যবহার্য পোষাক নিজেরাই উৎপাদন করে থাকে। তারা গৃহস্থালী কোন কাজে বিদ্যুৎ ব্যবহার করে না। ঘরে কোন ফোন ব্যবহার করে না। ব্যবসায়িক কাজে ফোন জরুরি হলে ঘরের বাইরে নির্দিষ্ট একটি স্থানে ফোন রেখে দেয়। তারা ব্যক্তিকে কোনভাবে ফোকাস করে না। এজন্য পুরুষ মহিলারা একরঙা সাদাসিধে কাপড় পরিধান করে থাকে।

আমিশরা মনে করে মানুষ তার কাজের মধ্যে বেঁচে থাকে, তার বাহ্যিক অবয়ব বা চাকচিক্য দিয়ে নয়। ব্যক্তি স্বাতন্ত্র ইহজাগতিক বিষয়, যা বাইবেলের শিক্ষার সাথে সাংঘর্ষিক। এজন্য আমিশ সম্প্রদায় কোনো প্রকার ফটোগ্রাফ, প্রতিকৃতি , টেলিভিশন ইত্যাদি পছন্দ করে না। তারা চায় না তাদের ছবি কেউ ক্যামেরাবন্দী করুক। ইহলৌকিক জগৎ থেকে একটা দূরত্ব, একটা মোহমুক্ত, উচ্চাভিলাষহীন সাদামাটা রহস্যঘেরা  জীবনযাপনই তাদের কাঙ্খিত দর্শন। ইহজাগতিক সেক্যুলার দর্শনের কারণে তারা আমেরিকার জাতীয় দিবসসমূহ যেমন স্বাধীনতা দিবস, শ্রমদিবস ইত্যাদি পালন করে না।

আমিশদের পরিবার:

আমিশদের পরিবার অনেকটা আমাদের দেশের হারিয়ে যাওয়া যৌথপরিবারের মত। বাবা মা সন্তান নিয়ে একান্নবর্তী পরিবার। বয়স্ক বাবামায়ের যত্ন নেয়া আমিশদের বাইবেল নির্দেশিত কর্তব্য। বাবা মা বৃদ্ধ হলে তাঁদের জন্য একটি টেকসই ঘর তৈরি করে তাদের সার্বক্ষণিক যত্ন নেয় তারা। নাতি নাতনিদের সাহচর্যে তাঁরা শান্তিপূর্ণ জীবনযাপন করেন।

জীবন যেহেতু ঈশ্বরের দান তাই আমিশ সম্প্রদায় কোনধরণের পরিবার সংকোচন নীতি মেনে চলে না। ফলে প্রতি পরিবারে ৮/১০ জন বাচ্চা জন্ম গ্রহণ করে। বাচ্চারা নিজেদের মধ্যে খেলাধূলা করে আনন্দময় সময় পার করে। অবসরে ছেলে বাচ্চারা পিতার চাষবাসে সহযোগিতা করে। মেয়ে বাচ্চারা মাকে কাপড় কাচাসহ গৃহস্থালী কাজে সাহায্য করে। 

শিক্ষা:

জীবনের প্রথম ছয়টি বছর আমিশ শিশুরা বাড়িতে একটি বিবর্তিত ডাচ ভাষায় কথা বলে। এরা এটাকে বলে পেনসিলভানিয়া ডাচ। কোনো ইংরেজি ভাষা বাড়িতে ব্যবহার করে না এবং স্কুলে না যাওয়া পর্যন্ত শিশুরা ইংরেজী জানে না, বোঝেও না।

আমিশদের লেখাপড়া খুবই মৌলিক। তারা একটা বড়  ক্লাসরুমে একসাথে পাঠ গ্রহণ করে। জীবনযাপনের জন্য শুধু প্রাথমিক জ্ঞানটুকু তারা অর্জন করে। সর্বোচ্চ অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত তাদের লেখাপড়া। তাদের শিক্ষকরাও অষ্টম শ্রেণি পাশ।  স্কুলের শিক্ষার মাধ্যম ইংরেজি। 

ব্যাপটিজম, বিবাহ এবং সংস্কৃতি:

সাধারণত ১৬ বছর পূর্ণ হলে আমিশ ছেলেমেয়েরা খ্রীষ্ট ধর্মে এবং আমিশ দর্শনের জীবনযাপন পদ্ধতিতে নিজেদেরকে দীক্ষিত করে। কেউ যদি আধুনিক জীবনযাপন পদ্ধতির মূলস্রোতে যেতে চায় তাহলে সেই সুযোগ তাকে দেয়া হয়। তবে প্রতি পাঁচজনের চারজনই আমিশ দর্শনের জীবনযাপন পদ্ধতি গ্রহণ করে। বাকীরা আমেরিকার মূলস্রোতে মিশে যায় এবং পরিবার থেকে স্থায়ীভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

আমিশ ছেলেরা খৃষ্ট ধর্মে দীক্ষিত হলে দাড়ি রেখে দেয় কিন্তু গোঁফ কেটে ফেলে। বিবাহিত ছেলেদের চেনার উপায় হলো গোঁফহীন বিশাল দাড়ি।

সাধারণত ২১/২২ বছরের মধ্যে আমিশ ছেলেমেয়েরা বিয়ে করে ফেলে। কনে নিজে থেকে বর পছন্দ করতে পারে। তবে তা চার্চের কাছে অনুমোদনপ্রাপ্ত হতে হবে। নির্দিষ্ট দিনে চার্চ সব পাত্রপাত্রীর তালিকা প্রকাশ করে। তারপর বর-কনের পরিবার নিজস্ব নিয়মে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিবাহকার্য সম্পন্ন করে।

আগেই বলেছি যে, আমিশ সম্প্রদায় যান্ত্রিক জীবনযাপন পছন্দ করে না। পরিবহনের জন্য তারা ঘোড়ার গাড়ি ব্যবহার করে। এজন্য তাদের মধ্যে ছুতার কামার ইত্যাদি নানান পেশার মানুষের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। তারা নিজেদের প্রয়োজন মিটিয়ে অর্থনৈতিকভাবে সাবলম্বী হতে বাণিজ্যিকভাবে পল্ট্রি, ডেইরী এবং গৃহনির্মাণ শিল্প গড়ে তুলেছে। কিন্তু তাদের মধ্যে কোন অর্থলোভ কাজ করে না। তারা অর্থ উপার্জনের জন্য বাইরের কোন চাকরি করে না। তারা সরকারকে বিধি অনুযায়ী ট্যাক্স দেয় কিন্তু সরকারের কাছ থেকে সোশ্যাল সিকিউরিটিসহ অন্যান্য সুবিধা গ্রহণ করে না।

আমিশ সম্প্রদায় বিভিন্ন খেলাধুলা, কমিউনিটিভিত্তিক বিভিন্ন অনুষ্ঠান করে থাকে। তারা সংগীত পরিবেশন করে কিন্তু কোন বাজনা বা যন্ত্রসংগীত ব্যবহার করে না। আমেরিকার আধুনিকতার এই চরম উৎকর্ষে আমিশদের জীবনযাপন সত্যিই একটি বিস্ময়কর ব্যাপার। একদিকে চরম ব্যক্তি স্বাধীনতা, অন্যদিকে পরিবার ও সম্প্রদায়ের স্বার্থে ব্যক্তি স্বাধীনতা স্বেচ্ছায় বিসর্জন। একদিকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির চরম ঝলকানি, অন্যদিকে মাটি ও প্রকৃতির মায়াবী কোলে মিটমিট করে জ্বলা মোমের প্রদীপ।

আমাদের গাড়িচালক কাম গাইড এমনভাবে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছিলেন যে, স্থির মত কোন আমিশ মানুষের অবয়ব দেখা যাচ্ছিল না। ফলে তাদের কোন ছবিও তোলা যাচ্ছিল না। সবকিছু একটা রহস্যময়তা ধূম্রজালে আচ্ছন্ন মনে হচ্ছিল। তবে যেখানে নিষেধের বেড়াজাল সেখানেই মানবমনের সব আগ্রহ দানা বাঁধে। তাই আমাদের গাড়ি যখন একটি আইসক্রীম কাম বেকারীর দোকানে এসে দাঁড়ালো তখন সামনাসামনি দুটো আমিশ মেয়েকে দেখতে পেলাম। অবাক চোখে তাকিয়ে দেখি তারা আমাদের মতই রক্তমাংসের মানুষ। তারা আমাদের সাথে ইংরেজিতে কথা বলছে। তাদের নীল চোখের তারায় আমাদের মতই আলোর ঝিলিক। সাহস করে ছবি তোলার অনুরোধ জানাতেই মধুর হাসিতে রাজী হয়ে গেল !

সময় নষ্ট না করে ক্লিক ক্লিক !

(ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)

বিডি প্রতিদিন/জুনাইদ আহমেদ 



এই পাতার আরো খবর