ঢাকা, শুক্রবার, ২৬ জুলাই, ২০২৪

আজকের পত্রিকা

‘মেডিকেল হিস্টোরি বলছে পাঁচ বছরে মরবো না’
আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু
আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু

গত বৃহস্পতিবার, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ডাক্তারের কাছে গেছি। আমি গেছি বলা ঠিক হবে না, পেটের নাড়িভূড়ির বিশেষজ্ঞ ডাক্তার, ‘গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজিস্ট’, বাংলায় ‘অন্ত্রবিদ’ বলা যেতে পারে, তার অফিস থেকেই যেতে বলা হয়েছিল। পাঁচ বছর আগে তিনি আমার কোলোনোস্কপি করেছিলেন। আমার কোলোন বা বৃহদান্ত্রে কোনো সমস্যা ছিল না। পাঁচ বছর পর কোনো সমস্যা হলো কিনা তা জানতেই এই তলব।

সুন্দরী তরুণী মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট আমার প্রেসার, হাইট, ওয়েট এসব মেপেছেন, আমি কি কি ওষুধ খাই, কোনো ওষুধে অ্যালার্জিক রিয়েকশন আছে কিনা জেনে আমার আগের মেডিকেল হিস্টোরি আপডেট করে আমাকে অপেক্ষা করতে বলে চলে যান। 

কয়েক মিনিট পর ডাক্তার এসে মনিটরে আমার মেডিকেল হিস্টোরি দেখে জেরা করলেন:

‘কি কমপ্লেইন আজ আপনাকে এখানে এনেছে?’

আমি উত্তর দিই, ‘নো কমপ্লেইন। আপনার অফিস থেকে আসতে বলেছে, অ্যাপয়েন্টমেন্ট ঠিক করে দিয়েছে, তাই এসেছি।’

এরপর তিনি রুটিন মাফিক প্রশ্ন করেন, স্টুল কেমন হয়, পেট মোচড়ায় কিনা বা পেটে ব্যথা হয় কিনা, রক্ত যায় কিনা, ইত্যাদি। অনুরূপ কোনোকিছুই আমার হয় না জেনে ডাক্তার সন্তুষ্ট। তবুও তাকে নিশ্চিত হতে হবে।

স্টুলের একটা টেস্ট লিখে দিয়ে বলেন, ‘টেস্ট রিপোর্ট পজেটিভ হলে কোলোনোস্কপি করবো, নেগেটিভ হলে পাঁচ বছর পর করলেই চলবে।’

‘ডক্টর, আপনার কি ধারণা, আমি পাঁচ বছর বাঁচবো?”

ডাক্তার হাসলেন, কম্পিউটার স্ক্রিনে আবার চোখ রেখে বললেন, ‘আপনার মেডিকেল হিস্টোরি বলে যে, আপনি পাঁচ বছরে মরবেন না।’

আমি বলি, ‘ডক্টর, মৃত্যুর কতো কারণ থাকতে পারে। মেডিকেল হিস্টোরি ভালো থাকলেও কত লোক হুটহাট মরে যায়।’

উনি তো উদর বিষয়ক ডাক্তার। অনেক বছর যাবত দীর্ঘ সময় বসে থাকতে পারি না। টানা এগারো বছর ব্যথানাশক ওষুধ সেবন করি, মাঝে মাঝে থেরাপি নেই। ব্যথা নাশ হয় না। অবশেষে কয়েক মাস আগে এক নিওরোলজিস্ট এবং তার মধ্যবয়সী রাশিয়ান নারী সহকারী অতি সুক্ষ্ম কয়েকটি সূঁচ আমার দুই হাঁটুর নিচে বিভিন্ন অংশে ফুটিয়ে একটি মেশিনে মনিটর করে তিন সপ্তাহ পর রেজাল্ট জানাবেন বলে আমাকে বিদায় করেন। দুই সপ্তাহ পর ক্যালিফোর্নিয়ায় গিয়ে সেখান থেকে ফিরে আসতে আরো দুই সপ্তাহ। পঞ্চম সপ্তাহে নিওরোলজিস্টের কাছে গেলে তিনি মনিটরে রিপোর্ট দেখে ঘোষণা করেন, ‘নিওরোপ্যাথি’। থেরাপি নিতে হবে, প্রতি সপ্তাহে একটি করে ভিটামিন বি১২ ইঞ্জেকশন নিতে হবে তিন মাস। বি১২ যুক্ত খাবার এবং বি১২ সাপ্লিমেন্ট খেতে হবে। পেইন মেডিকেশন তো আছেই। নিওরোলজিস্ট আমার প্রাথমিক চিকিৎসা সেবাদানকারী ডা. মুজিবকে ফোন করে বিস্তারিত বললেন।

বহু বছর যাবত আমার উচ্চ রক্তচাপ আছে। নিয়মিত ওষুধ সেবন করি। কিছুদিন যাবত কোলেস্টরেল লেভেল স্বাভাবিক রাখতেও ওষুধ সেবন করি। ২০০৫ সালে ভোকাল কর্ডে সার্জারি করতে হয়েছে দু’বার। এখনো কণ্ঠস্বর একটু উঁচুতে উঠলেই কয়েক সেকেন্ড পর্যন্ত কথা বের হয় না। কণ্ঠ স্বাভাবিক হলে নিচু লয়ে কথা বলি।

কখন কি হয়ে যায়। “এক সেকেন্ডর নাই ভরসা ---।”

কোনো গ্যাস্ট্রোএন্টরোলজিস্ট, কার্ডিওলজিস্ট বা অন্যান্য লজিস্টের কি সাধ্য মৃত্যুকে ঠেকায়! ৬৫ বছর হতেই কবরস্থান, ফিউনারেল হোমস থেকে জিসাসের বাণী সম্বলিত চিঠি আসে। অর্থ্যাৎ মৃত্যু ডাক দিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশিদের নানা আঞ্চলিক সমিতির প্রধান কাজ হলো নিজ নিজ এলাকাবাসী, যারা ধরাধাম ত্যাগ করবেন, তাদের জন্য কবরের জায়গা কিনে রাখা। সবাই জানেন, ‘কুল্লু নাফসিন জাইকাতুল মওত,’ - ‘প্রতিটি প্রাণীকেই মৃত্যুর স্বাদ পেতে হবে’। ডাক্তার সাহেবরাও মারা যান।

তবুও ডাক্তাররা ভালো কিছু বললে মৃত্যু পথযাত্রী রোগীর পাণ্ডুর মুখেও এক চিলতে হাসি ফুটে উঠে।

গ্যাস্ট্রেএন্টারোলজিস্টের পাঁচ বছরের মধ্যে আমার মৃত্যু হওয়ার তেমন শঙ্কা না থাকার বাণী সুখকর, যদিও এখনো স্টুল টেস্ট করাইনি। এ টেস্ট রিপোর্ট পজেটিভ হলে তিনি আবারও কোলোনোস্কপি করাবেন। পশ্চাদদেশ দিয়ে ক্যামেরাযুক্ত একটি দীর্ঘ নল প্রবিষ্ট করিয়ে তিনি কোলোনের বিভিন্ন অংশ পরীক্ষা করবেন। জেনারেল অ্যানেসথেশিয়ার প্রভাবে ব্যথার অনুভূতি থাকবে না।

আমেরিকায় স্বাস্থ্যসেবার গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক হলো, কোনো ব্যক্তির প্রাথমিক চিকিৎসা সেবা দানকারী ডাক্তার তার রোগীর কোন বয়সে কি রোগব্যাধি শরীরে বাসা বাঁধতে পারে, তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য রোগী কোনো কমপ্লেইন না করলেও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে পাঠান। ১২ বছর যাবত আমার প্রাথমিক চিকিৎসা সেবা দানকারী ডা. মুজিবুর রহমান। আমার চেয়ে বয়সে বেশ ছোটো। তিনি যখন সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের দ্বিতীয় বা তৃতীয় বর্ষের ছাত্র তখন থেকে আমার পরিচিত এবং ঘনিষ্ট। পাঁচ বছর আগে তিনিই গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজিস্টের কাছে পাঠিয়েছিলেন।

যে নল দিয়ে খাদ্য পাকস্থলি থেকে ২২ ফুট দীর্ঘ ক্ষুদ্রান্ত্র ও ৬ ফুট দীর্ঘ বৃহদান্ত্র পরিভ্রমণ করে মল হিসেবে দেহ থেকে বের হয়ে যায়, সেই সুদীর্ঘ নলে কোনো অঘটন ঘটেছে কিনা কোলোনোস্কপিতে সেই লক্ষণগুলো সম্পর্কে জানা যায়। কিছু ঘটে থাকলে বিনা চিকিৎসায় তার ক্যান্সারে রূপ নিতে পারে। চিকিৎসকরা বলেন, কারো কোলোন ক্যান্সার হতেই পারে এবং তা নিরাময়যোগ্য। নিয়মিত পরীক্ষার পর যথাসময়ে যথার্থ চিকিৎসা করালেই হলো।

খাদ্যাভ্যাস ও জীবন ধারা স্বাস্থ্যের ওপর বিরাট প্রভাব ফেলে। প্রক্রিয়াজাত খাবার, অধিক চিনিযুক্ত খাবার, স্যাচুরেটেড ফ্যাটযুক্ত খাবার না খেয়ে বা কম খেয়ে ওমেগা ৩ (চর্বি-সমৃদ্ধ মাছে বেশি থাকে) যুক্ত খাবার বেশি খান, আঁশযুক্ত খাবার গ্রহণ, পর্যাপ্ত পানি পান করে কোলোনের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে পারেন। আমি নিজেকে তৃণভোজী বলি এবং প্রায়ই আমি সাধারণত যা ভোজন করি, সেগুলোর ছবি ফেসবুকে আপলোড করি। অনেকে আপত্তি করেন, অনেকে পছন্দ করেন। কে কি ভাবলো তা নিয়ে আমি মাথা ঘামাই না।

বৃহদান্ত্রে ক্যান্সার ধরনের বিভ্রাট ঘটার লক্ষণ সম্পর্কে বিশেষজ্ঞদের মতামত হলো, আপনার অন্ত্রের অভ্যাসগুলোর পরিবর্তন -- ডায়ারিয়া বা কোষ্ঠকাঠিণ্য, মলত্যাগে সমস্যা বা চেপে রাখা, মলের রং পরিবর্তন ও সামঞ্জস্য না থাকা, অন্ত্র স্ফীত হয়ে বা গ্যাসের প্রভাবে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব করা, মানসিকভাবে অসহায়ত্ব ও ক্লান্তি বোধ করা। এর বাইরেও আরো কারণ থাকতে পারে, যা গ্যাস্ট্রেএন্টারোলজিস্টরা আরো ভালো বলতে পারবেন।

(ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)

বিডি প্রতিদিন/আজাদ



এই পাতার আরো খবর