ঢাকা, বুধবার, ২৪ জুলাই, ২০২৪

আজকের পত্রিকা

লালন আনন্দধাম: লোকসংস্কৃতির ধারক, বাহক, প্রচারক
ভাঙ্গা (ফরিদপুর) প্রতিনিধি
ছবি- বাংলাদেশ প্রতিদিন।

কবি, কথাশিল্পী, গবেষক, সমালোচক ও শিক্ষক সৈয়দ জাহিদ হাসান। তিনি গীতিকার ও সুরকার। সঙ্গীত অঙ্গনে তিনি 'ক্ষ্যাপা জাহিদ' নামেও পরিচিত। তার জন্ম ১৯৮২ সালে ভাঙ্গা উপজেলার কাউলীবেড়া গ্রামে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি  লাভ করেন। বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারে বর্তমানে ফরিদপুরের সদরপুর সরকারি কলেজের সহকারী অধ্যাপক পদে কর্মরত। 

পাশাপাশি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বাউলতত্বের উপর পিএইচডি গবেষণা করছেন।  উচ্চশিক্ষিত হয়েও ভুলেননি নিজের জন্মস্থানকে। তাইতো ২০১৩ সালের ০১ জানুয়ারি ৫১ শতাংশ জমির উপর জন্মস্থান ভাঙ্গার কাউলিবেড়া ইউনিয়নের  মোটরা গ্রামে প্রতিষ্ঠা করেন লোকসংস্কৃতির গবেষণা কেন্দ্র 'লালন আনন্দধাম’। এ প্রতিষ্ঠান গড়তে তার সহযাত্রী হন এলাকার মুক্তমনা বেশ কয়েকজন শিক্ষক, আইনজীবী, সরকারি- বেসরকারি চাকুরিজীবী, ছাত্র, কৃষক, ব্যবসায়ী। 

বর্তমানে এ প্রতিষ্ঠানের সদস্য সংখ্যা শতাধিক। ভাঙ্গাসহ বিভিন্ন এলাকার মানুষ এখন লালন আনন্দধাম দেখতে আসেন। এখানে বছর জুড়ে মুক্তমনা প্রগতিশীল লোকজন বিভিন্ন অনুষ্ঠান করে থাকেন। পাশাপাশি লালন আনন্দ ধামের উদ্যোগে পাশের সড়কটির নামকরণ করা হয়েছে মহাত্মা ফকির লালন শাহ সড়ক। এ প্রতিষ্ঠানের সাথে এলাকার বিভিন্ন শ্রেণিপেশার ও বিভিন্ন বয়সের মুক্তমনা মানুষ যুক্ত হয়েছে।

এলাকাবাসী জানান, সময়ের সাথে  এ প্রতিষ্ঠানের কাঠামোগত পরিবর্তন হয়েছে। এক সময়ের বাঁশ, টিন ও মাটির স্থাপনার জায়গায় এখন পাকা  স্থাপনা হয়েছে। দর্শকদের পাঠচক্র ও আলোচনাসভা করার জন্য আনন্দ ধামের ভিতরে ভিন্ন ভিন্ন নান্দনিক স্থাপনা রয়েছে। এছাড়া স্থাপনাগুলো শৈল্পিক দৃষ্টিভঙ্গী দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। স্থাপনাগুলোর নামকরণ করা হয়েছে ষড়ভুজ, বায়ুবিহার, আবেশমঞ্চ। বাউলের একতারা খচিত চিত্রাঙ্কনসহ বিভিন্ন বাঙালি ঐতিহ্যের ছবি রয়েছে স্থাপনায়। এখানে হারমোনিয়াম, ঢোল, একতারা, দোতরা, ডুগি, তবলা, কাসি, খোমকসহ বিভিন্ন ধরনের বাদ্যযন্ত্র রয়েছে। বিভিন্ন প্রজাতির গাছ লাগানো হয়েছে। গাছগুলো বড় হচ্ছে। এ ধাম দেখার জন্য দর্শনার্থীদের ভিড় বাড়ছে দিনকে দিন। 

ভাঙ্গা উপজেলা শহর থেকে পূর্ব দিকে ৩ কিলোমিটার গেলে বগাইল। বগাইল থেকে উত্তর দিকে ভাঙ্গার তুজারপুর ইউনিয়নের তুজারপুর গ্রাম হয়ে পূর্ব দিকে আরও প্রায় ৩ কিলোমিটার গেলেই ভাঙ্গার কাউলিবেড়া ইউনিয়নের মোটরা গ্রাম। আর এ নিভৃত পল্লীগ্রামে সৈয়দ জাহিদ হোসেনের স্বপ্নের প্রতিষ্ঠান লালন আনন্দধামের অবস্থান।

মোটরা গ্রামের একাধিক বাসিন্দা জানান, এ লালন আনন্দধামে বিভিন্ন সময় দেশের খ্যাতিমান বাউল সাধকগণের আগমন ঘটেছে। করোনা শুরু হওয়ার আগে ২০১৯ সালে এখানে ৩ দিনব্যাপী লালন মেলা হয়েছে। লালন সম্পর্কে আলোচনা ও লালন গানের আসর বসেছিলো তখন। বিখ্যাত বাউল গায়ক টুনটুন বাউল, পাগলা বাবলুসহ দেশের খ্যাতিমান বেশ কয়েকজন বাউলশিল্পী ওই অনুষ্ঠানে গান পরিবেশন করেছিলেন। এছাড়া  বিভিন্ন  সময়ে দেশের  বিশিষ্ট  বাউল শিল্পীরা এ ধামে আসেন। 

এছাড়া প্রতিবছর এ প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে নিভৃত এ পল্লীতে বাংলা নববর্ষ  জাঁকজমকপূর্ণ ভাবে উদযাপন করা হয়। এছাড়া বছর জুড়েই পাঠচক্র, আলোচনা সভা, সেমিনার, সাহিত্য আড্ডা,গানের আসর বসে এখানে। পাশাপাশি কৃতী শিক্ষার্থী সংবর্ধনা, আনন্দ ভ্রমণ, চিকিৎসা ক্যাম্প করে অসহায়দের চিকিৎসা প্রদান, বৃক্ষরোপণ, মাদক বিরোধী প্রচারণসহ বিভিন্ন সামাজিক কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে প্রতিষ্ঠানটি। 

২০২১ সাল থেকে এ ধামের প্রয়াত সদস্যের নামে ' আবেশ মেধা বৃত্তি' চালু করেছে লালন আনন্দ ধাম। প্রতিবছর ১৫ ফেব্রুয়ারি এলাকার দরিদ্র ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের এ বৃত্তি দেওয়া হচ্ছে। এ প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত হয়েছে এলাকার প্রগতিশীল, মুক্তমনা,কল্যাণ চিন্তার অধিকারী, সংস্কৃতিপ্রেমী মানুষ। লালন আনন্দধামের স্মারক ও গঠনতন্ত্রে এ ধামের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বর্ণনা করা হয়েছে। এখানে  উল্লেখ  রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ, মূল্যবোধ ও চেতনার ভিত্তিতে অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ে তোলায় সহযোগিতা করা এ ধামের অন্যতম উদ্দেশ্য। 

ভাঙ্গা উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান সুধিন কুমার সরকার বলেন, লেখক জাহিদ হাসান ভাঙ্গার একটি নিভৃত গ্রামে লালন আনন্দধাম  প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। এ প্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠার পর থেকে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করছে। আমি কবি জাহিদকে ধন্যবাদ জানাই। 

উদিচী শিল্পী গোষ্ঠী ভাঙ্গা উপজেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক লিয়াকত মোল্লা বলেন, লালন আনন্দধাম আমাকে টানে। ওই জায়গায় গেলে আমার মন ভালো হয়ে যায়। আমি প্রতি সপ্তাহে কমপক্ষে একবার আনন্দধামে যাই। সেখানে সুস্থ সংস্কৃতি চর্চা হয়। জাহিদ হোসেন ভালো একটি প্রতিষ্ঠান নিভৃত পল্লীতে গড়ে তুলেছেন। 

ভাঙ্গায় লালন আনন্দধামের প্রতিষ্ঠাতা সৈয়দ জাহিদ হাসান বলেন, লালন আনন্দধাম লোকসংস্কৃতির ধারক, বাহক, প্রচারক। লোকসংস্কৃতি ও লোকঐতিহ্য পরবর্তী প্রজন্মের মাঝে টিকিয়ে রাখার জন্য আনন্দধাম প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেছিলাম। পাশাপাশি লালন দর্শনের  মাধ্যমে সোনার মানুষ গড়ার স্বপ্ন দেখি। আমাদের এ ধামে মাদকমুক্ত পরিবেশ। এখন এ ধামে লোকসংস্কৃতি জাদুঘর স্থাপন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। 

তিনি আরও জানান, ধামের গ্রন্থাগারটি আরও মানসম্মত করার কাজ হাতে নিয়েছি। তবে আমরা অনেক কিছুই করেছি বা উদ্যোগ নিয়েছি। সরকারি বা বেসরকারি সহযোগিতা পেলে আমরা আমাদের কাজকে আরও অনেক দূর এগিয়ে নিতে পারবো। শিশুদের বিনোদনের জন্য দোলনা স্থাপন করেছি। আরও শিশু খেলনা স্থাপন অচিরেই করা হবে।

বিডি-প্রতিদিন/আব্দুল্লাহ



এই পাতার আরো খবর