ঢাকা, বুধবার, ২৪ জুলাই, ২০২৪

আজকের পত্রিকা

ঢাক-ঢোলের কারিগরদের ব্যস্ত সময়
টাঙ্গাইল প্রতিনিধি

দরজায় কড়া নাড়ছে শারদীয় দুর্গাপূজা। মণ্ডপে মণ্ডপে বাদ্যযন্ত্র, ঢাক-ঢোলের শব্দ আর ধূপের গন্ধে মেতে উঠবেন সনাতন ধর্মাবলম্বীরা। দুর্গাপূজাকে সামনে রেখে ব্যস্ত সময় পার করছেন টাঙ্গাইলের বাদ্যযন্ত্র কারিগররা। জেলা শহর থেকে শুরু করে উপজেলা ও গ্রামগঞ্জে ঢাক-ঢোলের কারিগররা বাদ্যযন্ত্র তৈরিতে ব্যস্ত থাকলেও এখন আর সেই ব্যস্ততা খুব একটা দেখা যায় না। তাদের উত্তরসূরীরা সময়ের প্রয়োজনে পাল্টে নিয়েছে পূর্বপুরুষের পেশা।

কিছু কারিগর তাদের ঐতিহ্য ধরে রাখতে পূর্বপুরুষের পেশা টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন। আধুনিক বাদ্যযন্ত্রের কারণে উৎসব-অনুষ্ঠানে এখন আর ঢোলের তেমন কদর না থাকলেও পূজা-পার্বণে এখনও ঢাক-ঢোলের কদর রয়েছে। পূজার আরতিতে ঢোলের এখনও কোনো বিকল্প নেই। তাই বছরের এ সময়টাতে ব্যস্ত সময় পার করেন ঢুলি থেকে শুরু করে ঢোল-খোলের কারিগররা। পূজা ছাড়াও বিভিন্ন লোকসঙ্গীতের আসরে ঢাক-ঢোল অন্যতম বাদ্যযন্ত্র।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, নাগরপুর সদর ইউনিয়ন ও সহবতপুর ইউনিয়নের ঋষি পাড়ায় ঢাক-ঢোল তৈরিতে ব্যস্ত কারিগররা। দম ফেলার ফুরসত নেই কারোর। কাঠের খুটখাট শব্দে মুখর বাড়ির উঠান। ঢাক-ঢোলের জন্য খোল তৈরি, রং করা, চামড়া লাগানো এবং মেরামতে ব্যস্ত বেশিরভাগ কারিগররা।

তাই ঢাক-ঢোল ছাড়া পূজা-অর্চনার কথা ভাবাই যায় না। তবে বর্তমান সময়ে আধুনিক যন্ত্রপাতির আধিক্যে ঢাক-ঢোলের বাজনা কমে যাচ্ছে। কাঠ, চামড়াসহ ঢাক-ঢোল তৈরির বিভিন্ন উপকরণের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় এখন খুব একটা লাভ হয় না। আগের দিনের মতো ঢাক-ঢোলের তেমন চাহিদা নেই। যুগ পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে যেতে বসেছে ঢাক-ঢোল, খোল, তবলা। তবে পূজা উপলক্ষে ঢাক-ঢোলের চাহিদা কিছুটা বেড়েছে। তিন পুরুষ ধরে এই পেশার সঙ্গে জড়িত। অনেক কষ্ট করে বাপ-দাদার পেশার হাল ধরে রেখেছি ।

একাধিক কারিগর জানান, বছরে তিন (আশ্বিন, কার্তিক ও অগ্রাহয়ণ) মাসে কাজের চাপ বেশি থাকে। দুর্গাপূজার জন্য কিছু কাজ করছি। এ ব্যবসায় এখন যা আয় হয় তা দিয়ে পরিবারের ভরণ-পোষণ করা কষ্টসাধ্য যায়। বড় আকারের প্রতিটি ঢাক ১০-১৫ হাজার টাকা। ছোট ও মাঝারি ৭-৮ হাজার টাকা। ঢোল বড়টি ৬ হাজার টাকা। ছোট ও মাঝারি ৫-৬ হাজার টাকা। খোল প্রতিটি ৫ হাজার টাকা। এই কাজ করে এখন সংসার চালানো যায় না। গান বাজনা, যাত্রা অনুষ্ঠানসহ বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠান কম হওয়ায় ঢোলের চাহিদাও কমে যাচ্ছে দিন দিন। তাই সংসারের খরচ মেটানো কঠিন হয়ে পড়েছে। যে কারণে এ কাজের আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে কারিগররা।

বাদ্যযন্ত্র অনুরাগী নাগরপুর সরকারি কলেজের সাবেক সহকারী অধ্যাপক লক্ষ্মীকান্ত সাহা বলেন, ‘আমাদের প্রায় সবারই পূজার সানাইয়ে মন কেমন করে ওঠে। শুধু সানাই নয়, জোড়া কাঠিতে ঢাক কিংবা কাসরের উপর একটানা একটি কাঠির তিনটি শব্দ সুরের যে মূর্ছনা সৃষ্টি করে এসেছে তা বাঙালির একান্ত নিজের সুর। এ সুরের ইন্দ্রজাল ছিড়ে আমাদের বাঙালির গানে প্রবেশ করেছে গিটার, প্যাডড্রাম ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্র। এর প্রভাবে আমাদের ঢাক-ঢোল লালিত সঙ্গীতে পড়েছে নেতিবাচক ছায়া। একথা অবশ্য সত্য যে সংস্কৃতি পরিবর্তনশীল এবং প্রবাহমান। ফলে নতুন বাদ্যযন্ত্র আমাদের সঙ্গীতে স্থান করে নেবে এটাই স্বাভাবিক। তবে একথাও সত্য যে, আমাদের দেশজ যন্ত্রে সুর ক্রমশ স্থিমিত হয়ে আসার অন্যতম কারণ হলো, এগুলো সঠিকভাবে বাজানো এবং সঠিক সঙ্গীতের উপযোগী করে তৈরি করা লোকের অভাব। তাই ঢাক-ঢোল মিশ্রিত সঙ্গীতের জন্য হৃদয় ব্যাকুল হলেও একদিন সত্যিই স্থিমিত হয়ে যাবে আমাদের দেশজ বাদ্যযন্ত্রের সুর।’

তিনি আরও বলেন, বিচিত্র পেশার ভিড়ে দেশজ বাদ্যযন্ত্র তৈরির পেশায় অর্থের প্রাচুর্য না থাকায় মানুষ বংশানুক্রমিক এসব পেশা পরিবর্তন করে নতুন উপার্জনের পথ ধরেছে। ফলে কমে গেছে  বাদ্যযন্ত্র তৈরির ঘরগুলো।

জেলা শিল্পকলা একাডেমীর প্রশিক্ষক শিল্পী ইব্রাহিম মিয়া জানান, ঢুকি, তবলা, ঢোল এই বাদ্যযন্ত্রগুলোর আলাদা একটি ঐতিহ্য রয়েছে। এখনো অনেক গান রয়েছে সে গানের সাথে ঢোলের সম্পর্ক নিবিড়। ঢাক-ঢোল বাজিও না। ঢাক-ঢোল বাজাইলে মনে পড়ে যায় একদিন বাঙ্গালী ছিলাম রে...।

 

বিডি প্রতিদিন/নাজমুল 



এই পাতার আরো খবর