ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৩ জুলাই, ২০২৪

আজকের পত্রিকা

চালু হচ্ছে ‘নবাব ফয়জুন্নেছা জমিদার বাড়ি যাদুঘর’
ফারুক আল শারাহ, লাকসাম:
মহিয়সী নারী নবাব ফয়জুন্নেছা চৌধুরাণীর প্রতিষ্ঠিত লাকসাম নবাব বাড়ি।

জাতীয় ঐতিহ্যের স্মৃতিবাহী কুমিল্লার লাকসাম নওয়াব বাড়ি। ভারতীয় উপমহাদেশের একমাত্র মহিলা নবাব ও নারী আন্দোলনের প্রথম অগ্রদূত নবাব ফয়জুন্নেছার স্মৃতি বিজড়িত ঐতিহাসিক এ বাড়িটি চমৎকার একটি স্থাপত্য যা দক্ষিণ এশিয়ার সৌন্দর্যমন্ডিত বাড়িগুলোর অন্যতম। দীর্ঘদিন অযত্নে-অবহেলায় পড়ে থাকার পর অবশেষে বৃটিশ আমলের কারুকার্য দিয়ে নির্মিত ‘নবাব ফয়জুন্নেছা জমিদার বাড়ি যাদুঘর’ সোমবার (৬ নভেম্বর) থেকে চালু হচ্ছে। 

এরই মধ্যে বাড়িটিকে সৌন্দর্যমন্ডিত করা হয়েছে। লাগানো হয়েছে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সাইনবোর্ড। লাকসাম পৌরশহরের পশ্চিমগাঁও এলাকায় ডাকাতিয়া নদীর তীর ঘেঁষে অপূর্ব সৌন্দর্যের লীলাভূমি ঐতিহাসিক নবাব ফয়জুন্নেছার বাড়ির (নবাব বাড়ির) অবস্থান। এ বাড়ির পাশেই রয়েছে ফয়জুন্নেছা চৌধুরাণী প্রতিষ্ঠিত নওয়াব ফয়জুন্নেছা সরকারি কলেজ, নান্দনিক মসজিদ, নওয়াব ফয়জুন্নেছা ও বদরুন্নেছা যুক্ত উচ্চ বিদ্যালয়, পশ্চিমগাঁও মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, গণ-কবরস্থানসহ বিভিন্ন স্থাপনা। 

ঐতিহ্যের ধারক নবাব বাড়ির নির্মাণ সাল নিয়ে মতান্তর রয়েছে। কথিত আছে, উপমহাদেশের একমাত্র মহিলা নবাব ফয়জুন্নেছা চৌধুরাণীর বিয়ের ১৭ বছর পর তিনি জানতে পারেন তার স্বামী হাছান আলী জমিদারের আরেকজন স্ত্রী রয়েছে। অসাধারণ ব্যক্তিত্ববান, আত্মমর্যাদাসম্পন্ন, দৃঢ়চেতা নবাব ফয়জুন্নেছা এটি মানতে পারেননি। তিনি পৃথক থাকার জন্য সাড়ে ৩ একর জমির উপর তার বিয়ের কাবিনের ১ লাখ ১ টাকা দিয়ে এই বাড়ি নির্মাণ করেন। বাড়িটি নির্মাণ করতে প্রায় ৩ বছর সময় লাগে। বৃটিশ আমলের সিমেন্ট, রড, চুন ও সুরকি দিয়ে বাড়িটি নির্মাণ করা হয়। বাড়ির পশ্চিমপাশেই ১০ গম্বুজবিশিষ্ট একটি অনিন্দ্য স্থাপত্যশৈলীর পারিবারিক মসজিদ রয়েছে। মসজিদের পাশেই রয়েছে পারিবারিক কবরস্থান, যেখানে চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন নবাব ফয়জুন্নেছা সহ তাঁর পরিবারের অন্যান্য বংশধর।

নবাব ফয়জুন্নেছা চৌধুরাণী অত্যন্ত ধার্মিক ছিলেন। তিনি এ বাড়িটিতে বসে পর্দার আঁড়াল থেকে উপমহাদেশের সকল বিচার কার্য সম্পাদন, রাস্তা-ঘাট, পুল-ব্রিজ, স্কুল-মাদ্রাসা সহ যাবতীয় জনকল্যাণমূলক কর্মকান্ড পরিচালনা করতেন। কালের বিবর্তনে বাড়িটি ঐতিহাসিক বাড়ি হিসেবে দেশ-বিদেশে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে। নবাব ফয়জুন্নেছা মৃত্যুর পূর্বে বাড়িটি সরকারের নিকট ওয়াকফ্ করে যান।

নওয়াব ফয়জুন্নেছা চৌধুরাণীর বাড়িটি এতোই চমৎকার একটি স্থাপত্য যাকে মনে করা হয় দক্ষিণ এশিয়ার সৌন্দর্যমন্ডিত বাড়িগুলোর অন্যতম। জাতীয় ঐতিহ্যের স্মৃতিবাহী এ বাড়িটি বছরের পর পর অযত্ন, অবহেলায় শ্রীহীন হয়ে পড়ে। বাড়ির পাশে দৃষ্টিনন্দন পরিবেশ, গাছপালা, বাগান কিছুই এখন তেমনটা চোখে পড়ে না। ভবনের চারপাশ দেখতে অপরিচ্ছন্ন, চুন-সুরকি-ইট-পলেস্তরা খসে পড়ছে। জায়গায় জায়গায় বেরিয়ে এসেছে জংধরা রড, দরজা-জানালা ভেঙে খুলে পড়ছে, কালি ঝুলে আছে দেয়ালের পরতে পরতে। সর্বত্র যেন মলিনতার ছাপ। যথাযথ রক্ষণা-বেক্ষণ ও সংস্কারের অভাবে বাড়িটি যখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে ঠিক তখনি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় বাড়িটি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়। অবশেষে  সৌন্দর্যমন্ডিত বাড়িটি যাদুঘরে রূপান্তরিত হওয়ায় এটিকে ঘিরে অর্থনৈতিক উন্নয়নের ব্যাপক সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।

সূত্রে জানা যায়, বর্তমান সরকারের আমলে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় ফয়জুন্নেছা চৌধুরাণীর মালিকানাধীন ৪ একর ৫৩ শতক সম্পত্তি বাংলাদেশ প্রত্নতাত্ত্বিক অধিদপ্তরকে সংরক্ষণের দায়িত্ব অর্পণ করেছে। যা গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়। এমন ঘোষণায় লাকসামের সাধারণ মহল আনন্দে উদ্বেলিত হলেও দুশ্চিন্তায় পড়েছেন অবৈধ দখলদাররা।  এদিকে, চলতি বছরের ২ জুন নওয়াব ফয়জুন্নেছা চৌধুরাণীর বাড়ি পরিদর্শনে আসেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে.এম খালিদ এমপি। পরিদর্শনকালে তিনি বলেন, মহিয়সী নারী নবাব ফয়জুন্নেছা চৌধুরাণীর স্মৃতি রক্ষার্থে তার বাড়িকে দ্রুত জাদুঘর রূপান্তরের আশ্বাস দেন।   ঐতিহাসিক লাকসাম নবাব বাড়ি যাদুঘরে রূপান্তরিত হওয়ায় এখন থেকে পর্যটক হৃদয় সিক্ত করবে। হয়ে উঠবে দেশ-বিদেশী পর্যটকদের অন্যতম দর্শনীয় স্থান। বাড়িটি আধুনিকায়ন হলে বেড়ে যাবে লাকসাম শহরের গুরুত্ব। খুলে যেতে পারে অর্থনৈতিক উন্নয়নের দ্বার। অর্জিত হবে সরকারের রাজস্ব আয়।

নওয়াব ফয়জুন্নেছা ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক আজাদ সরকার লিটন বলেন- ফয়জুন্নেছা চৌধুরাণীর স্মৃতি রক্ষায় দীর্ঘদিনের আন্দোলনের ফসল হিসেবে ঐতিহ্যমন্ডিত ফয়জুন্নেছা চৌধুরাণীর বাড়িটি প্রত্নতাত্ত্বিক অধিদপ্তরের অধীনে যাওয়ায় আমরা আনন্দিত। আশা রাখি সারাদেশের পর্যটন কেন্দ্র সমূহের অন্যতম একটি হবে ফয়জুন্নেছা চৌধুরাণীর বাড়িটি। 

লাকসাম পৌরসভার মেয়র অধ্যাপক মো. আবুল খায়ের জানান- লাকসাম নবাব বাড়িটি দীর্ঘদিন অযত্নে থাকলেও বর্তমান উন্নয়নবান্ধব সরকারের স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম এমপি’র আন্তরিকতায় বাড়িটিকে আধুনিকতার পাশাপাশি সংরক্ষণের প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এরই প্রেক্ষিতে বাড়িটিতে সোমবার থেকে যাদুঘর চালু হচ্ছে। 

 

বিডি প্রতিদিন/হিমেল



এই পাতার আরো খবর