খুলনার দাকোপ উপজেলার রিয়াজ হোসেন (৩১)। এলাকায় পশু চিকিৎসক হিসেবে সেবা দেন তিনি। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় পায়ে আঘাত পান এবং বেশ কিছু জায়গায় কেটে যায়। দীর্ঘদিন চিকিৎসা নিলেও পায়ের ঘা আরও বাড়তে থাকে। তিনি বলেন, ‘চিকিৎসা নিতে গিয়ে জানতে পারি আমার ডায়াবেটিসের মাত্রা অনেক বেশি। কিন্তু আমি জানতামই না। বারডেমে চিকিৎসক দেখে বলেছেন, পা কেটে ফেলতে হবে। ডায়াবেটিসের কোনো উপসর্গ না থাকায় আমি বুঝতেই পারিনি যে আক্রান্ত। এখন পা হারাতে বসেছি।’
প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে শহরে ঘরে ঘরে বাড়ছে ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। শিশু, তরুণ, বয়স্ক সব বয়সী মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে ডায়াবেটিসে। আক্রান্তদের ৫০ শতাংশই থেকে যাচ্ছে শনাক্তের বাইরে। এ পরিস্থিতিতে আজ পালিত হচ্ছে বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস। এ বছরের প্রতিপাদ্য ‘ডায়াবেটিসের ঝুঁকি জানুন ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিন’।
বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির সভাপতি এবং জাতীয় অধ্যাপক ডা. এ কে আজাদ খান বলেন, ‘ডায়াবেটিস শরীরের সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গে আক্রমণ করে। ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগীদের স্ট্রোকের ঝুঁকি থাকে। এতে ব্রেন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দৃষ্টিশক্তি কমে যায় ডায়াবেটিস আক্রান্ত হলে। ডায়াবেটিস আক্রান্ত হলে যৌন দুর্বলতা দেখা দেয়, কিডনি রোগ হয়, পায়ে পচনশীল ঘা হতে পারে। এই ঘায়ের কারণে পা কেটে ফেলায় পঙ্গুত্ব বরণ করতে হয় অনেক রোগীকে। ডায়াবেটিস রোগীরা হৃদরোগের উচ্চ ঝুঁকিতে থাকে।’
তিনি আরও বলেন, ‘টাইপ-২ ডায়াবেটিস পুরোপুরি নিরাময়যোগ্য। তাই হাঁটতে হবে, মুটিয়ে যাওয়া যাবে না, কোমলপানীয়-ফাস্টফুড খাওয়া বন্ধ করতে হবে, দুশ্চিন্তা করা যাবে না। ডায়াবেটিস যাতে না হয় সেভাবে জীবনযাপন করতে হবে, আর যদি কেউ আক্রান্ত হয়ে যায় তাহলে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।’ বর্তমানে বিশ্বব্যাপী ডায়াবেটিস মহামারি আকার ধারণ করেছে। রোগের ব্যাপকতা উপলব্ধি করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ১৯৯৭ সালে ডায়াবেটিস রোগটিকে মহামারি হিসেবে ঘোষণা করে।
আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিক ফেডারেশনের (আইডিএফ) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২১ সালে সারা পৃথিবীতে মোট ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা ছিল ৫৪ কোটি। এ সংখ্যা ২০৪৫ সালে ৭৮ কোটিতে পৌঁছবে বলে আশঙ্কা করা হয়েছে। আশঙ্কার বিষয়, মোট রোগীর অর্ধেকই তার শরীরে যে ডায়াবেটিস আছে তা জানে না। উন্নত বিশ্বের দেশগুলোর তুলনায় বর্তমানে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশেও ডায়াবেটিস বৃদ্ধির হার অনেক বেশি। বর্তমানে ৮০ শতাংশ ডায়াবেটিস রোগীই বসবাস করে স্বল্প ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোয়। দ্রুত নগরায়ণ ও জীবনযাপনে পরিবর্তন এর অন্যতম কারণ হিসেবে দেখা হয়ে থাকে।
বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির (বাডাস) সেন্টার ফর গ্লোবাল হেলথ রিসার্চ প্রকল্পের পরিচালক ডা. বিশ্বজিত ভৌমিক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও ডায়াবেটিস ও অন্যান্য অসংক্রামক রোগ দ্রুত বাড়ছে। আইডিএফের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে বাংলাদেশে মোট ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা ছিল ১ কোটি ৩১ লাখ। স্বাস্থ্য অধিদফতরের এনসিডি স্টেপ সার্ভে ২০২২-২৩-এর তথ্যমতে, বাংলাদেশে প্রতি ১০ জন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মধ্যে একজন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত।
ডায়াবেটিস সমিতির তথ্যমতে, এ সংখ্যা প্রতি পাঁচজনে একজন। সমিতির গবেষণা বলছে, চারজন নারীর মধ্যে একজন গর্ভকালীন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। তাদের মধ্যে ১৫ শতাংশ নারী এক বছরের মধ্যেই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ এন্ডোক্রাইন সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ডা. শাহজাদা সেলিম বলেন, বাংলাদেশ বর্তমানে বিশ্বের ডায়াবেটিসপ্রবণ দেশগুলোর একটি এবং বাস্তব পরিস্থিতি এর চেয়েও গুরুতর। বর্তমানে শহর ও গ্রামে প্রায় সমানভাবে বেড়ে চলেছে ডায়াবেটিসের রোগী। তাই গুরুতর অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে এখনই এটি প্রতিরোধে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ এখন সময়ের দাবি।
তিনি আরও বলেন, ‘এখনই ব্যবস্থা না নিলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। সর্বস্তরের সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা এবং ডায়াবেটিক রোগীর সেবায় সুলভে ওষুধ সরবরাহ থেকে শুরু করে অন্যান্য সহযোগী ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা খুবই জরুরি। বর্তমানে দেশে প্রায় ১ কোটি ৩১ লাখ মানুষ ডায়াবেটিসে ভুগছেন এবং সারা বিশ্বের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান অষ্টম। আগামী চার বছরে এই সংখ্যা দ্বিগুণ হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। সে হিসেবে দেশের চারটি অসংক্রামক রোগের মধ্যে অন্যতম এই ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা ২০২৫ সালের মধ্যে দেড় কোটি ছাড়াতে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে।