ঢাকা, শনিবার, ৯ নভেম্বর, ২০২৪

আজকের পত্রিকা

লোকসভা নির্বাচন : ষষ্ঠ দফার ভোটেও পশ্চিমবঙ্গে বিক্ষিপ্ত বিশৃঙ্খলা
দীপক দেবনাথ, কলকাতা
ফাইল ছবি

ভারতের ১৮তম লোকসভা নির্বাচনের ষষ্ঠ দফাতেও পশ্চিমবঙ্গের একাধিক জায়গায় বিক্ষিপ্ত বিশৃঙ্খলার ঘটনা ঘটেছে। শনিবার ভোট নেওয়া হয় দেশটির আটটি রাজ্য ও কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলের ৫৮টি কেন্দ্রে। এগুলো হলো উত্তর প্রদেশ (১৪), হরিয়ানা (১০), বিহার (৮), পশ্চিমবঙ্গ (৮), দিল্লি (৭), ওড়িশা (৬), ঝাড়খণ্ড (৪) ও জম্মু-কাশ্মীর (১)।

এ দফায় পশ্চিমবঙ্গের ৮ আসনে ভোট নেওয়া হয়। এগুলো হলো-তমলুক, কাঁথি, ঘাটাল, ঝাড়গ্রাম, মেদিনীপুর, পুরুলিয়া, বাঁকুড়া ও বিষ্ণুপুর। এদিন সকাল ৭টায় শুরু হয় ভোটগ্রহণ প্রক্রিয়া, চলে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত।

কিন্তু ভোট শুরু হওয়ার কয়েক ঘণ্টা আগে শুক্রবার রাতে পূর্ব মেদিনীপুর জেলার মহিষাদলে এক তৃণমূল নেতাকে খুন করার অভিযোগ উঠেছে। স্থানীয় বেতকুন্ডু গ্রাম পঞ্চায়েতের সাবেক সদস্য শেখ মইবুল যখন রাতে মোটরবাইকে করে বাড়ি ফিরছিলেন, সেই সময় আক্রমণের মুখে পড়েন তিনি। প্রথমে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপানো হয় মইবুলকে। এরপর রক্তাক্ত অবস্থায় পুকুরের পানিতে ফেলে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে।

এলাকায় দাপুটে নেতা হিসেবে পরিচিত মইবুলের মৃত্যুর ঘটনায় চরম উত্তেজনা ছড়ায় এলাকায়। বিরোধী দল বিজেপির বিরুদ্ধে এই খুনের অভিযোগ উঠলেও তারা তা অস্বীকার করেছে।

এ নিয়ে শনিবার সন্ধ্যায় বসিরহাটে এক নির্বাচনি প্রচারণা থেকে তৃণমূল নেত্রী মমতা ব্যানার্জির হুঁশিয়ারি, ‌‘গতকাল রাতে মহিষাদলে আমার এক কর্মীকে খুন করেছে। আমি এদের ছাড়বো না। এর বিরুদ্ধে আমি রাজনৈতিক বদলা নেবই।’

অন্যদিকে রাজ্য পুলিশের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের অভিযোগ তুলে সোচ্চার হয়েছেন তমলুকের বিজেপি প্রার্থী সাবেক বিচারপতি অভিজিৎগাঙ্গুলী। এদিন ভোট শুরুর পরেই এলাকায় বেরিয়ে যান অভিজিৎ। সকালে বুথে বুথে ঘুরে বেড়ান তিনি। আর প্রতিটি ক্ষেত্রেই বিক্ষোভের মুখে পড়তে দেখা যায়। তার অভিযোগ, রাজ্যের পুলিশ নন্দীগ্রাম এলাকায় বাড়ি বাড়ি গিয়ে বিজেপি কর্মীদের গ্রেফতার করছে। এই কেন্দ্রের অন্তর্গত হলদিয়ায় স্থানীয় মানুষদের বিক্ষোভের মুখে পড়েন অভিজিৎ গাঙ্গুলী। জাল ভোটের অভিযোগ পেয়ে তিনি যখন স্থানীয় একটি ভোট গ্রহণ কেন্দ্রে যান, তখন বিজেপি প্রার্থীর গাড়ি ঘিরে ধরে গো ব্যাক স্লোগানও দেওয়া হয়। মুহূর্তের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। এরপর নামানো হয় বিশাল পুলিশ বাহিনী ও কেন্দ্রীয় বাহিনীকে।

ভোটের সকালে উত্তপ্ত হয় পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার কেশপুর। ঘাটাল কেন্দ্রের বিজেপি প্রার্থী অভিনেতা হিরণ চ্যাটার্জির গাড়ির সামনে তুমুল বিক্ষোভ দেখায় তৃণমূলের কর্মী-সমর্থকরা। রাস্তার উপরে অগ্নিসংযোগ করে চন্দ্রকোনা মেদিনীপুর রাজ্য সড়কে হিরণকে আটকানোর চেষ্টা করে বিক্ষোভকারীরা। এই হামলার নেতৃত্ব দেন কেশপুর ব্লকের ৫ নম্বর অঞ্চলের তৃণমূল সভাপতি শেখ হাসানুর জামান।

এর আগে, কেশপুরে তার গাড়ি বহরকে আটকে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে রাজ্য পুলিশের বিরুদ্ধে। এরপর পুলিশের বিরুদ্ধে একরাশ অভিযোগ তোলেন হিরণ। কেশপুরেই ফের একবার বিক্ষোভের মুখে পড়তে হয় হিরণকে। লাঠি, বাঁশ নিয়ে তার উপর চড়াও হওয়ার পাশাপাশি তার গাড়ি বহর আটকে বিক্ষোভ দেখানো হয় বলে অভিযোগ।

তবে ওই কেন্দ্রেরই তৃণমূল প্রার্থী দীপক অধিকারীকে (দেব) দেখা গেল রিফ্রেস মুডে। বাইক নিয়ে বিভিন্ন বুথে পরিদর্শন করতে দেখা যায় দেবকে।

ঝাড়গ্রামের বিজেপি প্রার্থী প্রণত টুডুর উপর গড়বেতার ফুলকুশমায় হামলার অভিযোগ ওঠে তৃণমূলের বিরুদ্ধে। প্রার্থীকে মারধর করার পাশাপাশি ভাঙচুর করা হয় তার গাড়িবহর। প্রার্থীকে লক্ষ্য করে ছোড়া হয় পাথর। প্রার্থীর ব্যক্তিগত নিরাপত্তা রক্ষীকে মেরে মাথা ফাটিয়ে দেওয়া হয় বলে অভিযোগ। প্রার্থী বলেন, ‘প্রায় ১০০ থেকে ২০০ জন ঘিরে ধরে হামলা চালায়, হামলাকারীদের মধ্যে রোহিঙ্গারা রয়েছে। আজ নিরাপত্তারক্ষী না থাকলে বেঁচে ফিরতাম না।’

তৃণমূলের লোগো বুকে লাগিয়ে বুথে বুথে ঘুরে ভোটারদের প্রভাবিত করার অভিযোগ উঠেছে বিষ্ণুপুর লোকসভা কেন্দ্রের তৃণমূল প্রার্থী সুজাতা মন্ডলের বিরুদ্ধে। এই নিয়ে প্রতিবাদ জানায় বিজেপি। যদিও সুজাতার দাবি কোনো বিধিভঙ্গ হয়নি।

মেদিনীপুরের কেশিয়াড়িতে বুথের মধ্যে কলকাতা পুলিশের সদস্যকে দেখে নিজের ক্ষোভ উগরে দেন বিজেপি প্রার্থী অগ্নিমিত্র পাল। এদিন কান্দামারি আংশিক বুনিয়াদি বিদ্যালয়ের একটি বুথে বিজেপির পোলিং এজেন্টকে ভয় দেখিয়ে উঠিয়ে দেওয়ার অভিযোগের খবর পেয়ে সেখানে আসেন অগ্নিমিত্রা। কথা বলেন প্রিসাইডিং অফিসারের সাথে। তার অভিযোগ দরজার পাশে দাঁড়িয়ে রাজ্যের পুলিশ ভোট করাচ্ছে, আর কেন্দ্রীয় বাহিনী দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে। পরে তাকে বুথ থেকে বাইরে বের করে দেন।

আবার অ্যাকশন মুডে দেখা যায় মেদিনীপুর কেন্দ্রের তৃণমূল প্রার্থী অভিনেত্রী জুন মালিয়াকে। একটি বুথের ভেতর গিয়ে বিজেপির বুথ সভাপতির বিরুদ্ধে বাজে আচরণ করার অভিযোগ তুলেছেন জুন। ওই বুথের ভেতরে বিজেপির পোলিং এজেন্টের সাথে তুমুল বচসায় জড়িয়ে পড়েন জুন মালিয়া। এ ছাড়াও বেশ কয়েকটি ভোটগ্রহণ কেন্দ্রে ইভিএম খারাপ হওয়ার খবর এসেছে। আবার কোথাও ভোটারদের ভয়ভীতি প্রদর্শন, বুথে আসতে বাধা দেওয়াসহ বিক্ষিপ্ত কিছু ঘটনার খবরও পাওয়া গেছে।

জম্মু-কাশ্মীরের অনন্তনাগ-রাজৌরি কেন্দ্রের ‘পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট’র পোলিং এজেন্ট ও দলের কর্মীদের অকারণে আটকের অভিযোগ তুলে বিক্ষোভে বসেন দলের নেত্রী সাবেক মুখ্যমন্ত্রী মেহেবুবা মুফতি। তার মোবাইল ফোনের আউটগোয়িং কল সাসপেন্ড করা হয়েছে বলেও অভিযোগ তোলেন মুফতি।

এদিন ভোট শুরুর আগে এক্স হ্যান্ডেলে নারী ও নতুন প্রজন্মের ভোটারদের ভোটদানে উৎসাহ দেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তিনি লেখেন, ‘গণতন্ত্র তখনই বিকশিত হয়, প্রাণবন্ত দেখায় যখন জনসাধারণ নির্বাচন প্রক্রিয়ায় উৎসাহের সাথে অংশগ্রহণ করে।’

এদিন গোটা দেশজুড়ে একাধিক সেলিব্রেটি ভোটাররা তাদের নিজেদের ভোট প্রদান করেন। সকাল সকাল দিল্লিতে ভোট গ্রহণ কেন্দ্রে ভোট দেন দেশটির রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু, উপরাষ্ট্রপতি জগদীপ ধনকর ও তার স্ত্রী সুদেশ ধনকর, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শংকর, কংগ্রেস সাংসদ সোনিয়া গান্ধী, রাহুল গান্ধী, দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী ও আম আদমি পার্টির প্রধান অরবিন্দ কেজরিওয়াল, সিপিআইএম সাবেক সভাপতি প্রকাশ কারাত, দলের নেত্রী বৃন্দা কারাত, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হারদীপ পুরি, দেশটির প্রধান নির্বাচন কমিশনার রাজীব কুমার, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি ডি.ওয়াই চন্দ্রচূড়, দেশটির তিন বাহিনীর প্রধান ‘চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ’ (সিডিএস) জেনারেল অনিল চৌহান, ভারতের সাবেক ক্রিকেটার কপিল দেব বাইট প্রদান করেন। এ ছাড়াও ভোট দিতে দেখা যায় ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়ক, হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রী নায়েব সিং সাইনি, সাবেক মুখ্যমন্ত্রী মনোহর লাল খাট্টার প্রমুখ।

এদিকে নিজের ভোট দিয়ে একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে দেশের মানুষকে ভোট দেওয়ার আহ্বান জানান কেজরিওয়াল। তিনি বলেন, আমি, আমার বাবা, স্ত্রী এবং সন্তানরা ভোট দিয়েছি। শরীর অসুস্থ থাকায় মা ভোট দিতে পারেননি। আমি ভোট দিয়েছি একনায়কতন্ত্র, মুদ্রাস্ফীতি ও বেকারত্বের বিরুদ্ধে। সাধারণ মানুষ, ভোটারদেরকেও বলব তারা যেন ঘরে না থেকে ভোটগ্রহণ কেন্দ্রে এসে একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধ ভোট দেন।’

উল্লেখ্য, ভারতের লোকসভা নির্বাচনে ৫৪৩টি লোকসভা আসনের মধ্যে ইতিমধ্যেই ছয় দফায় ৪৮৬ আসনে ভোট নেওয়া সম্পন্ন হলো। আগামী ১ জুন সপ্তম ও শেষ দফার ভোট নেওয়া হবে। গণনা আগামী ৪ জুন।

বিডি প্রতিদিন/এমআই



এই পাতার আরো খবর