ঢাকা, শনিবার, ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

আজকের পত্রিকা

ধর্ষণকাণ্ড: প্রশ্নবিদ্ধ মমতা, আন্দোলন চলছে
দীপক দেবনাথ, কলকাতা

পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি কেন দ্বিচারিতা করছেন? একদিকে ন্যায় বিচার চেয়ে তিনি রাস্তায় নামছেন আবার অন্যদিকে আন্দোলন যাতে না হয় তার চেষ্টা করছেন। মুখ্যমন্ত্রীর দ্বিচারিতা কোনোভাবেই মেনে দিতে রাজি নয় ধর্ষণকাণ্ডের শিকার হওয়া ছাত্রীর বাবা-মা। 

৯ আগস্ট আর জি কর মেডিকেল কলেজ এবং হাসপাতালে এক মেডিকেল শিক্ষার্থীকে ধর্ষণ ও খুন করার অভিযোগ ওঠে। এরপর থেকেই ন্যায় বিচারের দাবি জানিয়ে গত কয়েকদিন ধরে টানা আন্দোলন চালিয়ে আসছে শিক্ষার্থীরা। দোষীদের ফাঁসি চেয়ে পথে নেমেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিও। গত বুধবার রাত দখলে নেমেছিল নারীরাও। আর সেদিন মধ্যরাতেই হাসপাতালে তাণ্ডব ও ভাঙচুর চালায় একদল মানুষ। তারপর থেকে নিরাপত্তা বাড়ানো হয় আর জি কর হাসপাতাল। এরই মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় রবিবার থেকে আর জি কর হাসপাতাল চত্বরে 'ভারতীয় ন্যায় সংহিতা'র অধীনে ১৬৩ ধারা জারি করা হয়েছে। আর তা নিয়ে যত বিতর্ক। পাশাপাশি ওই হাসপাতাল সংলগ্ন এলাকায় বেআইনিভাবে জমায়েতে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে কলকাতা পুলিশ। সেক্ষেত্রে আগামী ২৪ আগস্ট- এক সপ্তাহ পাঁচজন বা তার বেশি মানুষের বেআইনি জমায়েত করা যাবে না। আর তা নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন ওই  ছাত্রীর বাবা-মা। ওয়াকিবহাল মনে করছে পুলিশ চাইছে না যে আরজিকরের সামনে আর কোন আন্দোলন গড়ে উঠুক। 

এই ইস্যুতে ওই শিক্ষার্থীর বাবা বলেন, 'মুখ্যমন্ত্রী এত কথা বলছেন, মৃতার বিচার চাই বলে রাস্তায় নামছেন, আন্দোলন করছেন। আবার অন্যদিকে আন্দোলন যাতে না হয় সেটা বন্ধ করার চেষ্টা করছেন। উনি কেন দ্বিচারিতা করছেন? উনি কি সাধারণ জনগণকে ভয় পাচ্ছেন? এটা নিয়ে আমাদের মনে প্রশ্ন আছে।' 

বাবার অভিমত স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন কোথাও গিয়ে যেন বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। তার সরাসরি অভিযোগ 'যারা মুক্তকণ্ঠে প্রতিবাদ করছে, মুখ্যমন্ত্রী তাদের কণ্ঠ রোধ করার চেষ্টা করছেন। উনি নিজে রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করছেন, আবার প্রতিবাদ যাতে না হয় তারও ব্যবস্থা করছেন।' 

রবিবার গণমাধ্যমের সামনে এই মারাত্মক অভিযোগ করেছেন ওই শিক্ষার্থীর বাবা-মা। এমনকি রাজ্যবাসীর কাছে তার মায়ের বার্তা '...যারা রাজ্য সরকারের কন্যাশ্রী প্রকল্প, লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের সুবিধা নিচ্ছেন, তারা যেন সেটা নেওয়ার আগে নিজেরা সুরক্ষিত কিনা একবার ভেবে দেখেন।' 

বাবা-মা'য়ের এমন মন্তব্যকে ঘিরেই উঠছে প্রশ্ন। তবে কি এই আন্দোলনকে কোনভাবে দাবিতে রাখতে চাইছে রাজ্য সরকার বা প্রশাসন? অন্তত এমনটাই মনে করছেন বুদ্ধিজীবীরাও। 

অভিনেতা ও নাট্যকর্মী নীল বলছেন, 'পাওয়ার ডমিনেশন চলছে। এরও প্রতিবাদ করা উচিত। দরকার পড়লে আবার মিছিল করব।' 

আইনজীবী ও সিপিআইএমের রাজ্যসভার সংসদ সদস্য বিকাশ রঞ্জন ভট্টাচার্য বলছেন 'কোন আন্দোলনকেই ওরা আর মেনে নিতে পারছে না। নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে মোহনবাগান ও ইস্টবেঙ্গলের মধ্যে ফুটবল ম্যাচও বন্ধ করেছে। কলকাতা পুলিশও তার ব্যর্থতা স্বীকার করে নিয়েছে, সেক্ষেত্রে পুলিশ মন্ত্রীর পদত্যাগ করা উচিত।’

এদিকে ওই ঘটনায় যেমন মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবিতে সরব হচ্ছেন বিরোধীরা। তেমনি আর জি কর কাণ্ডে দ্রুত বিচার চেয়ে সরব হচ্ছে বিভিন্ন জগতের সেলিব্রেটিরাও। রাজ্যপাল ড. সি ভি আনন্দ বোস এবং মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিকে চিঠি লিখে দ্রুত বিচার চেয়েছেন ভারতের সাবেক ক্রিকেটার ও আপের রাজ্যসভার সংসদ সদস্য হরভজন সিং। 

আরজিকরের ঘটনা প্রসঙ্গে ২০১২ সালে দিল্লিতে গণধর্ষণের বলি নির্ভয়ার মা আশা দেবীও মুখ খুলেছেন। এই ঘটনাকে দুর্ভাগ্যজনক আখ্যায়িত করার পাশাপাশি এই ইস্যুতে যেভাবে রাজনৈতিক দোষারোপের পালা চলছে তার তীব্র নিন্দা করেন নির্ভয়ার মা। স্বাস্থ্য এবং পুলিশ মন্ত্রী হয়েও মমতা ব্যানার্জি কিভাবে ফাঁসির দাবিতে পথে নামতে পারেন তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন তিনি। আশাদেবী বলেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং পুলিশ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মুখ্যমন্ত্রীর হাতে। আমি জানি না কার বিরুদ্ধে তিনি প্রতিবাদে নামছেন বা কার ফাঁসির দাবি করছেন। পুরো শাসনব্যবস্থাটাই তো তার হাতে। সরকার একটা বিষয়ে আশ্বাস দেওয়া উচিত যে এই মামলাটি নিম্ন আদালতে উত্থাপন করা হয়েছে।' 

তার দাবি 'যদি এই ঘটনায় একের বেশি ব্যক্তি জড়িত থাকে তাদের অবিলম্বে গ্রেফতার করা ও শাস্তি দেওয়া উচিত। এটা এখনো পরিষ্কার নয় যে ওই নির্যাতিতা তরুণীকে একজন শ্লিলতাহানি করেছ না গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন। কর্মরত অবস্থায় একজন ডাক্তারের সাথে এই ধরনের ঘটনা জঘন্যতম অপরাধ। হাসপাতালে ভিতরে যদি একজন ডাক্তার নিরাপদ বোধ না করেন, সেক্ষেত্রে সাধারণ নারী বা তরুণীদের নিরাপত্তা কোথায়?' 

এই ঘটনার প্রতিবাদে দেশজুড়ে যখন বিক্ষোভ চলছে, তখনই দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে চিঠি লিখেছে 'ইন্ডিয়ান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন' (আইএমএ)। চিঠিতে ৯ আগস্ট ঘটনার বিস্তারিত উল্লেখ করার পাশাপাশি বিমানবন্দরের মত হাসপাতালগুলিতে নিরাপত্তা ব্যবস্থা রাখার আর্জি জানানো হয়েছে। 

এদিকে আরজিকরের ঘটনায় নড়ে চড়ে বসলো কেন্দ্রীয় সরকারও। কেন্দ্রের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তরফে সমস্ত রাজ্যের পুলিশ প্রশাসনকে প্রতিবাদ কিংবা আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত পরিস্থিতি জানাতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। চিকিৎসক, নার্স বা অন্য যেকোনো সংগঠনের তরফে আর জি কর সম্পর্কিত কোন প্রতিবাদ, বিক্ষোভের ঘটনা ঘটলে প্রতি ২ ঘণ্টা অন্তর সেই রিপোর্ট যেন ফ্যাক্স বা ইমেইল মারফত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়। 

ইতোমধ্যেই কলকাতা পুলিশের হাত থেকে এই মামলার তদন্তভার হাতে নিয়েছে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা সিবিআই। তদন্তভার হাতে নিয়ে ঘটনাস্থল আর জি কর হাসপাতাল, কলকাতা পুলিশের সদর দপ্তর লালবাজার ও ওই ছাত্রীর নাটাগড়ের বাড়িতেও আসে সিবিআই'এর প্রতিনিধি দল। যদিও এখনো পর্যন্ত কোনো উল্লেখযোগ্য সাফল্য আসেনি। স্বভাবতই চাপ বাড়ছে। 

এদিকে প্রশাসনের তরফ থেকে গুজব বা নির্যাতিতার নাম ও ঠিকানা না ছড়ানোর অভিযোগে বিজেপি নেত্রীর লকেট চ্যাটার্জি, চিকিৎসক ডা: কুণাল সরকার এবং ডা: সুবর্ণ গোস্বামীকে তলব করেছে কলকাতা পুলিশ। নির্যাতিতার পরিচয় প্রকাশ এবং ভুল তথ্য ছড়ানো- এই দুটি ভিন্ন মামলায় তাদেরকে কলকাতা পুলিশের সদর দপ্তর লালবাজারে ডেকে পাঠানো হয়। 

এর পাশাপাশি তৃণমূলের রাজ্যসভার সংসদ সদস্য সুখেন্দুশেখর রায়কেও লালবাজারে হাজিরা দেওয়ার জন্য নোটিশ পাঠানো হয়েছে। তার বিরুদ্ধেও ডাক্তারি ছাত্রীর ধর্ষণ ও খুনের মামলার তদন্ত নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় ভুয়া তথ্য ছড়ানোর অভিযোগ উঠেছে। 

 

বিডি প্রতিদিন/নাজমুল



এই পাতার আরো খবর