রাত তখন ১টা। সাধারণত এই সময় কলকাতার প্রাণকেন্দ্র ধর্মতলার রানী রাসমণি অ্যাভিনিউ সুনসান নীরব হয়ে যায়। রাস্তায় বাস, সিএনজি বা অন্য পাবলিক ট্রান্সপোর্ট তেমন থাকে না বললেই চলে। মানুষের আনাগোনা তো থাকেই না। কিন্তু রবিবারের রাত ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। থিকথিক করছিল ধর্মতলা চত্বর। চারদিকে অসংখ্য মানুষ। সবারই একটাই দাবি ন্যায়বিচার।
ন্যায়বিচারের দাবিতে গতকাল রাত দখলে নেমেছিল নাগরিক সমাজ। সাধারণ মানুষের পাশাপাশি রাত দখলে শামিল হয়েছিলেন টলিউডের তারকারাও। সোহিনী সরকার, উষসী চক্রবর্তী, বিদিপ্তা চক্রবর্তী, বিরসা দাশগুপ্ত, দেবলীনা দত্ত, স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়- কে নেই।
সেই মঞ্চ থেকেই মিউজিক সিস্টেমে বেজে উঠল ইথুন বাবুর লেখা সেই প্রতিবাদী গান। ‘ও দেশটা তোমার বাপের নাকি করছো ছলাকলা, কিছু বললেই ধরছো চেপে জনগণের গলা।’ সেই গানের তালে তালে কেউ গলা মেলালেন, কেউবা হাততালি দিয়ে অন্য আন্দোলনকারীদের উৎসাহিত করলেন।
গান গাওয়ার পাশাপাশি পথনাটিকা, সড়কের উপর স্লোগান লিখে, মোবাইলের ফ্ল্যাশলাইট জ্বালিয়ে আন্দোলনের মাত্রাকে আরো তীব্রতর করতে দেখা গেল। কেউ কেউ আবার গেয়ে উঠলেন ‘উই শ্যাল ওভারকাম, আমরা করব জয়।’ অর্থাৎ প্রতিবাদের ভাষা কখনও স্লোগান, গান, পথনাটিকা। তবে এই রাত দখলে কোনো দলীয় পতাকা ছিল না। তবে অনেকের হাতেই দেখা গেছে ভারতের জাতীয় পতাকা।
আন্দোলনকারীদের হাতে ছিল পোস্টার, প্ল্যাকার্ড- যেখানে লেখা ‘শেষ না দেখে ছাড়ব না’, ‘আমাদের একটাই স্বর, জাস্টিস ফর আরজিকর’, ‘বিচার চাইতে লড়াই করো, আরজিকরের মাথা ধরো,’ আমার রাতটা আমার থাক, ধর্ষকরা নিপাত যাক’।
গত ৯ আগস্ট কলকাতার আরজিকর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কর্তব্যরত অবস্থায় মৃত্যু হয় এক তরুণী ডাক্তারের। ওই ঘটনার পর প্রায় ২৪ দিন কেটে গেলেও এখনো ন্যায়বিচার অধরা। রাজ্যজুড়ে প্রতিবাদ, আন্দোলন, বিক্ষোভ চলছেই।
তারই মাঝে গতকাল রবিবার এই রাত দখল কর্মসূচিতে যোগদান করে নাগরিক সমাজ। এর আগে গত ১৪ আগস্ট মধ্যরাতে রাত দখলের লড়াইয়ে নেমেছিল গোটা বাংলা।
স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘আমাদের হয়তো খুব বেশি বুদ্ধি নেই। কিন্তু যেটুকু বুদ্ধি আছে তা দিয়ে এইটুকু বিশ্বাস করছি না যে ওই একটা লোকই পুরো কাণ্ডটা ঘটিয়েছে। তাই এই আইওয়াশকে আমরা কেউই বিশ্বাস করছি না। যেটা ঘটেছে সেই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের বিচার চাই। যে নির্যাতিতা মারা গেছে তার বাবা-মায়ের প্রতি সরকারের একটা দায়িত্ব ও দায়বদ্ধতা আছে যে অন্তত বিচারটা হোক।’
ঊষসী চক্রবর্তী বলেন, ‘আমাদের রাজপথ ছাড়লে চলবে না। এটা আমার, আপনার, আমাদের সকলের বেঁচে থাকার লড়াই। সরকারি হাসপাতালে কর্তব্যরত চিকিৎসকের যদি সুরক্ষা না থাকে তবে আমার আপনাদের বাড়ির নারীদের কোনো সুরক্ষা নেই। আমরা যদি রাজপথে না থাকি, এই ঘটনার যদি বিচার না হয়, তবে আমাদের বেঁচে থাকাটাই কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। ন্যায়বিচার পেয়ে তবেই আমরা থামব।’
দেবলীনা দত্ত বলেন, ‘এখন একজন দাবার বোড়েকে (সৈন্য) লেভেনজুসের মতো ঝুলিয়ে আমাদের শান্ত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। এটাতে আমরা শান্ত হবো না। আমরা চাই, রাজা, রানী, হাতি, ঘোড়া, জাহাজ সবাইকে ধরা হোক। সেটাই আমাদের দাবি। এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হোক।’ সেই ন্যায়বিচার যতদিন না হচ্ছে ততদিন আমাদের আন্দোলন চলবে।’
বিদিপ্তা চক্রবর্তী বলেন, ‘২৪ দিন হয়ে গেছে, গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে আমরা প্রতিকার চাইছি, সুবিচার চাইছি। আর কতদিন আমাদের রাস্তায় বসে থাকতে হবে, এটাই এখন দেখার।’
অভিনেত্রী সোহিনী সরকার বলেন, ‘সরকারের তরফে মুখ বন্ধ করে সকলে বসে আছে। আমাদের রাজ্যের নারীদের সুরক্ষা নিয়ে যে সমস্যা সেটা নিয়ে তারা একটাও কথা বলছে না।’ তার অভিমত ‘শুধু কলকাতা নয় নারীদের জন্য কোনো জায়গাই নিরাপদ নয়।’
বিডি প্রতিদিন/জুনাইদ