২০২৪ সালে শান্তিতে নোবেল জয়ী সংগঠন নিহন হিদাঙ্কিও'র সহকারী প্রধান বলেছেন, গাজার শিশুদের বর্তমান অবস্থা ৮০ বছরের আগের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী জাপানের শিশুদের মতোই। তোশিউকি মিমাকি নোবেল জয়ের পর টোকিওতে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘গাজা বর্তমানে শিশুদের রক্তে লাল হচ্ছে, ৮০ বছর আগে যেমনটা হয়েছিল জাপানে।'
আজ শুক্রবারই শান্তিতে নোবেল পায় জাপানের পরমাণু অস্ত্রবিরোধী সংগঠন নিহন হিদাঙ্কিও। এটি জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে মার্কিন পারমাণবিক বোমা হামলার কারণে ভয়ংকর ভোগান্তির শিকার মানুষদের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠনও।
তোশিউকি মিমাকির কথাই আবার নতুন করে সবার নজর ফিরিয়েছে গাজায়। ফিলিস্তিনের এই উপত্যকাতেও ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের পর থেকে নির্বিচারে বোমা ফেলেছে ইসরাইল। সেই বোমা পারমাণবিক ধ্বংসযজ্ঞ সম্পন্ন না হলেও বিস্ফোরকের হিসাবে হিরোশিমাকে ছাড়িয়ে গেছে।
যুদ্ধের প্রথম ৮৯ দিনেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানের হিরোশিমার যে পরিমাণ বোমা ফেলা হয়েছিল তার চেয়ে তিনগুণ বেশি বোমা ফেলা হয় ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায়। প্রথম ৮৯ দিনে ৬৫ হাজার টনেরও বেশি ওজনের প্রায় ৪৫ হাজারেরও বেশি ক্ষেপণাস্ত্র ও বোমা ইসরায়েল গাজায় নিক্ষেপ করে। হিরোশিমাতে ১৩ থেকে ১৫ হাজার টন বিস্ফোরক ফেলেছিল যুক্তরাষ্ট্র।
গাজার মিডিয়া অফিস জানিয়েছিল, এই সময়ে বেসামরিক নাগরিক, শিশু ও নারীদের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের প্রায় নয়টি আন্তর্জাতিকভাবে নিষিদ্ধ বোমা ও ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার নথিভুক্ত করা হয়েছে। মিডিয়া অফিস ইসরায়েলের যেসব বোমা চিহ্নিত করেছে তার মধ্যে আছে বাংকার-বাস্টিং বোমা অব টাইপ (বিএলইউ-১১৩), (বিএলইউ-১০৯), (এসডিবিএস), আমেরিকান টাইপ (জিবিইউ-২৮), অবকাঠামো ধ্বংস করার জন্য জিপিএস সিস্টেম পরিচালিত এই বোমা, সাদা ফসফরাস, স্মার্ট বোমা এবং হালবার্ড গুডুম মিসাইল।
২০২৪ সালের ৭ অক্টোবর এক বছর পার করে গাজা যুদ্ধ। এ উপলক্ষে প্রকাশিত প্রতিবেদনে ব্রাউন ইউনিভার্সিটির কস্ট অব ওয়ার প্রজেক্ট জানায় গত বছরের সাত আক্টোবর থেকে ইসরায়েলকে ১৭ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলারের সামরিক সহায়তা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ইসরায়েলকে আয়রন ডোম এবং ডেভিডের স্লিং ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ব্যবস্থার জন্য চার বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এছাড়া তারা অস্ত্র ও জেট ফুয়েলের জন্যও অর্থ সহায়তা দিয়েছে।
গাজা অভিযানে ইসরায়েলি বাহিনী অব্যাহতভাবে দুই হাজার পাউন্ডের এমকে-৮৪ বোমা ব্যবহার করছে। মার্কিন এ বোমা নিমিষেই যেকোনও ভবনকে ধসিয়ে দিতে পারে। এছাড়া এ বোমার প্রভাবে শত শত মিটার এলাকাজুড়ে থাকা মানুষকেও হত্যা করা যায়।
মার্কিন এ বোমাগুলো এফ-১৫ বা এফ-১৬ সিরিজের যুদ্ধবিমান থেকে ফেলা হয়েছে। এটি মার্ক-৮০ সিরিজের বর্ধিত সংস্করণ। দুই হাজার পাউন্ডের এ বোমা এক হাজার ফুট এলাকাজুড়ে ধ্বংসলীলার স্বাক্ষর রেখে যায়। এটির ফলে মাটির গভীরে ৩৩ থেকে ৫০ মিটার গভীর খাদের সৃষ্টি করে। গত এক বছরে ইসরায়েলি হামলায় গাজায় ৪২ হাজারে বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। এরমধ্যে প্রায় ১৭ হাজার শিশু রয়েছে। এছাড়া নারী রয়েছেন প্রায় ১২ হাজার। এমনকি ইসরায়েলি বাহিনীর তাণ্ডবে দেড় শতাধিক গণমাধ্যমকর্মীও প্রাণ হারিয়েছেন।
ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজায় এক বছর ধরে অব্যাহত ইসরায়েলি হামলায় সৃষ্ট ধ্বংসস্তূপ পরিষ্কার করতে অন্তত ১৫ বছর সময় লাগবে। এজন্য প্রতিদিন ১০০টি লরি ব্যবহার করতে হবে। জাতিসংঘের হিসাবমতে, গাজায় ভবন ধসে এ পর্যন্ত ৪২ মিলিয়ন টনেরও বেশি ধ্বংসস্তূপ জমা হয়েছে। এ ধ্বংসস্তূপগুলো যদি একসঙ্গে এক জায়গায় রাখা যায়, তাহলে তা মিশরের ১১টি গ্রেট পিরামিডের সমান হবে। এ ধ্বংসস্তূপ সরাতে ব্যয় হবে ৫০০ থেকে ৬০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
বিশ্লেষকরা বলছেন, গাজায় ইসরায়েল যেসব বোমা ফেলছে তার কোনোটা সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রের বানানো, কোনোটি আবার তৈরি হচ্ছে মার্কিন অর্থ ও প্রযুক্তির সহায়তায়। সেই দিক থেকে বিচার করলে, গাজায় ইসরায়েলের এমন নির্বিচার হত্যাকাণ্ড ও ধ্বংসযজ্ঞের পেছনে সেই যুক্তরাষ্ট্রই দায়ী, যারা জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিকে বোমা মেরে নরকে পরিণত করেছিল।
বিডি প্রতিদিন/নাজমুল