ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৩ জুলাই, ২০২৪

আজকের পত্রিকা

ভ্রাতৃত্ববন্ধন ও উদারতার শিক্ষা দেয় রমজান
মুফতি আমজাদ হোসাইন হেলালী

রমজান মাস শুরু হলেই আমাদের মাঝে এক ধরনের ইবাদতের আমেজ কাজ করে। ইবাদতের শিডিউল তৈরি হতে থাকে। ইবাদত নিয়ে প্রতিযোগিতা শুরু হয়। ভ্রাতৃত্ববন্ধন এক উত্তম ইবাদত। এর দ্বারা সমাজের মধ্যে ইসলামী পরিবেশ তৈরি হয়, দীনি হাওয়া চালু হয়। একে অন্যের প্রতি মায়া-মমতা ও মহাব্বত তৈরি হয়। ধীরে ধীরে মানুষ আল্লাহর প্রতি ধাবিত হতে থাকে। কেননা ভাতৃত্ববন্ধনে মানুষ একে অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল-নম্রতাশীল হয়। একে অন্যের প্রতি যত্নবান হয়। প্রত্যেকে চায় তার দ্বারা যেন অন্য ভাইয়ের কোনো অসুবিধা-কষ্ট না হয়। আর এটি মুমিনের অন্যতম একটি গুণ। হাদিসে এসেছে, ‘কোনো মুমিন পরিপূর্ণ ইমানদার হতে পারবে না যতক্ষণ না তার হাত-মুখ থেকে অন্য মুসলমান ভাই নিরাপদ থাকে। (বুখারি, মুসলিম)। পবিত্র  কোরআনে আল্লাহতায়ালা এরশাদ করেন, ‘মুমিনগণ পরস্পর ভাই ভাই। সুতরাং তোমরা তোমাদের দুই ভাইয়ের মাঝে মীমাংসা করে দাও।’ (সুরা হুজুরাত : ১০)। আরেক আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, ‘মুমিন নর ও মুমিন নারী সবাই একে অন্যের বন্ধু।’ (সুরা তাওবা : ৭১)। আয়াতদ্বয় দ্বারা কোরআনে বর্ণিত ভাতৃত্ববন্ধনের পরিচয় জানা যায়। রমজান মাসে এই ভাতৃত্ববোধ নিজেদের মধ্যে জেগে ওঠে। অনেকেই তার আশপাশের লোকদের খোঁজখবর নিয়ে থাকে। তার প্রতিবেশী কীভাবে ইফতার করছে, রমজান মাস তাদের কীভাবে কাটছে? তখন নিজেদের সাধ্যমতো তাদের সহোযোগিতা করে থাকে। পবিত্র রমজান মাসে কাউকে ইফতার করানোর ফজিলত সম্পর্কে হাদিসে এসেছে, ‘যাইদ ইবনু খালিদ আল-জুহানি (রা.) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- কোনো রোজা পালনকারীকে যে লোক ইফতার করায় সে লোকের জন্যও রোজা পালনকারীর সমপরিমাণ সওয়াব রয়েছে। কিন্তু এর ফলে রোযা পালনকারীর সাওয়াব থেকে বিন্দুমাত্র কমানো হবে না।’ (সহিহ ইবনু মাজাহ : ১৭৪৬) সুবহানাল্লাহ। মক্কায় অবস্থিত সাহাবায়ে কেরাম যখন রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশে মদিনাতে হিজরত করেন, তখন মদিনার আনসার সাহাবিগণ মুহাজিরদের সঙ্গে ভাতৃত্ববন্ধনের যে নিদর্শন স্থাপন করেছিলেন, পৃথিবীর ইতিহাসে আজ পর্যন্ত ভাতৃত্বের এই অনুপন দৃশ্য আর কোনো জাতি দেখাতে পারেনি। মদিনার মুসলমানগণ সহযোগিতা ও সহানুভূতির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। তারা নিজেদের প্রয়োজন ও দারিদ্র্য থাকা সত্ত্বেও সহায়-সম্বলহীন মুহাজির মুসলমান ভাইদের জন্য ধনসম্পদ ও আপন স্বার্থ পর্যন্ত ত্যাগ করেছিলেন। যাদের দুটি বাড়ি ছিল তারা নিজেদের জন্য একটি রেখে অন্য মুহাজির ভাইয়ের জন্য আরেকটি ছেড়ে দেন। তাদের ত্যাগ ও  কোরবানির এ গুণটি পছন্দ করে আল্লাহতায়ালা কালামে পাকে ইরশাদ করেন- ‘তারা (আনসারেরা) নিজেদের ওপর (মুহাজিরদের) প্রাধান্য দেয়। যদিও নিজেদের প্রয়োজন ও অভাব থাকে।’ (সুরা হাশর : ০৯)। এই গুণের অধিকারীদের সম্পর্কে অন্য জায়গায় ইরশাদ হচ্ছে, ‘(তারাই এসব নেয়ামত লাভ করবে যারা...) এবং যারা মিসকিন, এতিম ও বন্দিদের খাবার দান করে তার প্রতি (নিজেদের) আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও। (আর বলে) আমরা তো তোমাদেরকে খাওয়াই কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে। তোমাদের থেকে আমরা কোনো প্রতিদান বা কৃতজ্ঞতা কামনা করি না।’ (সুরা দাহর : ৮-৯)। এক হাদিসে রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিজ সাথীদের প্রতি উদারতার একটি ঘটনা বর্ণিত আছে। হজরত সাহল বিন সাদ (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘এক নারী সাহাবি নবীজির জন্য সুন্দর কারুকার্যখচিত একটি নতুন কাপড় হাদিয়া এনে আরজ করলেন, আমি এটি স্বহস্তে তৈরি করেছি। আপনি তা পরিধান করলে খুশি হব। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কাপড়টি গ্রহণ করলেন। তাঁর কাপড়ের প্রয়োজনও ছিল। যখন তিনি তা লুঙ্গি হিসেবে পরিধান করে ঘরের বাইরে এলেন, এক ব্যক্তি তা দেখে বলল, খুব চমৎকার কাপড় তো! আমাকে তা দান করবেন কি? তখন নবীজি ঘরে ফিরে গিয়ে পোশাক পরিবর্তন করে ওই কাপড়টি ভাঁজ করে লোকটির জন্য পাঠিয়ে দিলেন। এ দৃশ্য দেখে অন্যান্য সাহাবি ওই ব্যক্তিকে তিরস্কার করে বলতে লাগলেন, আরে মিয়া! তুমি কি জানো না, কাপড়টি নবীজির প্রয়োজন রয়েছে। আর তিনি কোনো কিছু চাইলে ‘না’ বলেন না। ওই লোকটি জবাবে বলল, আমি সবই জানি। এরপরও চেয়েছি, যাতে তাঁর মুবারক শরীর-স্পর্শে ধন্য কাপড় দিয়ে আমি নিজের কাফন বানাতে পারি। বর্ণনাকারী সাহাবি বলেন, ওই ব্যক্তির মৃত্যুর পর সেই কাপড়েই তাকে দাফন করা হয়েছিল।’ (সহিহ বুখারি : ১২৭৭, ২০৯৩)। সিরাতের কিতাবগুলোতে এই জাতীয় বহু ঘটনা বণিত আছে। ভাতৃত্ববন্ধন ইসলামের অন্যতম একটি বড় গুণ। এর দ্বারা মানুষ মানুষকে মূল্যায়ন করতে শিখে। নিজেদের মধ্যে ঝগড়াঝাটি, মনের অমিল ও দূরত্ব কমে গিয়ে এক উত্তম আদর্শ সৃষ্টি হয়। আল্লাহপাক এই রমজানে আমাদেরকে ভাতৃত্বের এই মহৎ গুণ পরিপূর্ণভাবে অর্জন করার তৌফিক দান করুন।



এই পাতার আরো খবর