ঢাকা, শনিবার, ৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

আজকের পত্রিকা

হিজরি সনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য
আসআদ শাহীন

সেকেন্ড থেকে ঘণ্টা, ঘণ্টা থেকে দিন, আর এভাবেই মাস ও বছর পর্যন্ত রুটিনের সঠিক ও উপযুক্ত বিভাজনকে আরবিতে তাকবিম, উর্দুতে নিজামুল আওকাত, ইংরেজিতে ক্যালেন্ডার এবং বাংলায় বর্ষপঞ্জি বলা হয়। আর সময় এমন একটি বস্তু, যা তার অক্ষের ওপর ঘুরতে থাকে। সেই সময় থেকে যাবতীয় ঘটনা লিপিবদ্ধ হয়ে অতীতের রেফারেন্সে পরিণত হয়, যেখান থেকে মানুষ শিক্ষা ও উপদেশ গ্রহণ করে তার ভবিষ্যতের বিষয় নির্ধারণ করে। এ ছাড়া প্রত্যেক মানুষের রাজনৈতিক, সামাজিক বিষয়, সামাজিক অনুষ্ঠান ও ধর্মীয় দায়িত্ব পালনের জন্য একটি সুশৃঙ্খল ব্যবস্থা প্রয়োজন, যা ছাড়া একজন মানুষের ওপর আরোপিত দায়িত্ব পালন করা শুধু কঠিনই নয়, অসম্ভব।

এই উদ্দেশ্য সামনে রেখেই বিশ্বে বিভিন্ন সময়সূচি ব্যবস্থা ব্যবহার করা হয়। এর মধ্যে দুটি ব্যবস্থা সাধারণত পরিচিত : ১. সৌর—জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর, ২. চান্দ্র—মহররম থেকে জিলহজ পর্যন্ত। (লিসানুল আরব, খণ্ড-৩, পৃষ্ঠা-৪) সৌর তারিখ খ্রিস্টাব্দের সঙ্গে সম্পর্কিত [ঈসা (আ.)-এর জন্ম থেকে] আর চান্দ্রের তারিখ রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর হিজরতের সঙ্গে সম্পর্কিত। (আত-তাওকিত ওয়া আত-তাকবিম, পৃষ্ঠা-১০৯)

বর্তমান যুগে সাধারণত সব সরকারি-বেসরকারি, সামরিক-বেসামরিক অফিস-আদালত ইত্যাদি বিষয় সৌর তারিখের পরিপ্রেক্ষিতে করা হয়।

তবে ইসলামী বিধি-বিধান ও ফরজ ইবাদতগুলো চান্দ্র ব্যবস্থার সঙ্গে সম্পর্কিত। যেমন—রোজা, জাকাত, হজ, ঈদ ইত্যাদি।

চান্দ্র বর্ষের তাৎপর্য আরবিতে চাঁদকে ‘কামার’ বলা হয়, আর সে জন্যই এটিকে কামারি বা চান্দ্র বলা হয়। কারণ এই পুরো ব্যবস্থাটি চাঁদের উত্থান ও পতনের ওপর নির্ভর করে।

উল্লেখ্য, এই ঐতিহাসিক চান্দ্র ক্যালেন্ডার শেষ নবী (সা.)-এর পবিত্র আমল হিজরতের সঙ্গে জড়িত। (আত-তারিখুল হিজরি, পৃষ্ঠা-২৯)

আল্লামা মুফতি শফি উসমানি (রহ.) বলেন, ইসলামে চান্দ্র মাসের যে বিন্যাস পদ্ধতি প্রচলিত আছে, তা আল্লাহ তাআলা কর্তৃক সুবিন্যস্ত। কেননা তিনি নির্দিষ্ট মাসগুলোর নির্দিষ্ট নির্দেশাবলি এই চান্দ্র হিসেবেই নাজিল করেছেন। এ থেকে বোঝা যায়, আল্লাহ তাআলার কাছে ইসলামের বিধি-বিধান পালনের ক্ষেত্রে চান্দ্র বছরই গ্রহণীয় ও পছন্দনীয়। অতএব, চান্দ্র হিসাব তথা আরবি বর্ষপঞ্জি স্মরণ রাখা ও হেফাজত করা ফরজে কিফায়া।

তাই সমগ্র মুসলিম উম্মাহ যদি চান্দ্র হিসাব স্মরণ না রাখে বা পরিহার করে চলে, তাহলে তারা গুনাহগার হবে। সুতরাং চান্দ্র গণনা সংরক্ষিত থাকলে তবেই সৌর তারিখ ব্যবহার করা জায়েজ। (মাআরিফুল কোরআন, খণ্ড-৪, পৃষ্ঠা-৩৭৩)

হিজরতের মাধ্যমে ইসলামী সন নির্ধারণ করার কারণ

আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানি (রহ.) লিখেছেন, উমর ফারুক (রা.)-এর খিলাফতের চতুর্থ বা পঞ্চম বছরে যখন তারিখ নির্ধারণের বিষয়টি আলোচনা করা হয়, তখন সাহাবায়ে কিরামের সামনে এমন চার ধরনের ঘটনা ঘটেছিল, যা থেকে ইসলামী সন গণনা শুরু হয়।

১. রাসুল (সা.)-এর জন্ম।

২. রাসুল (সা.)-এর নবুয়ত।

৩. রাসুল (সা.)-এর হিজরত।

৪. রাসুল (সা.)-এর মৃত্যু।

তবে মহান সাহাবিরা বিশেষভাবে উমর, উসমান ও আলী (রা.) হিজরতকে বেশি অগ্রাধিকার দিয়েছেন। কারণ জন্ম ও নবুয়তের সময় নির্ধারণের ব্যাপারে বেশ মতভেদ ছিল আর মৃত্যুর বছরকে ইচ্ছাকৃতভাবেই এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। কেননা তা সর্বদা আফসোস ও শোক প্রকাশেরই কারণ। তাই রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর হিজরতের বছর থেকেই তারিখ গণনা নির্ধারিত হয়। (ফাতহুল বারি, খণ্ড-৭, পৃষ্ঠা-২৬৮)

চান্দ্র বছরের প্রথম মাস মহররম

মহররমের অর্থ সর্বোত্তম, সম্মানিত ও মর্যাদাবান। এই মাসটি আশহুরে হুরুম তথা হারাম মাসের অন্যতম, যার মহিমা ও শ্রেষ্ঠত্ব কোরআন ও হাদিসে বর্ণিত হয়েছে। এই মাসে নেক আমলের প্রতিদান ও সওয়াব দ্বিগুণ করা হয়। (লাতায়িফুল মাআরিফ, পৃষ্ঠা-৭৯)

মহররম নামকরণের কারণ

প্রথম কারণ : আরবরা এই মাসে যুদ্ধ-বিগ্রহকে হারাম মনে করত, তাই এ মাসের নামকরণ হয়েছে ‘মহররম’। (আল মুতলিয়ু আলা আলফাজিল মুকনিয়ি, পৃষ্ঠা-১৯১)

দ্বিতীয় কারণ : মহররমকে মহররম বলা হয় এর মহিমা ও শ্রেষ্ঠত্বের কারণে। কারণ এটি আশহুরে হুরুমের অন্যতম। তবে আল্লামা সাখাভি (রহ.) বলেন, জাহিলি যুগে আরবরা এই মাস নিয়ে খেল-তামাশা করত। কখনো তারা এ মাসে যুদ্ধ করাকে হারাম মনে করত আবার কখনো হালাল মনে করত। তাই এ মাসে যুদ্ধ নিষিদ্ধ করার প্রতি গুরুত্বারোপ করে একে মহররম বলা হয়েছে। (তাফসিরে ইবনে কাসির, খণ্ড-৪, পৃষ্ঠা-১৪৬; আল মুফাসসাল ফি তারিখিল আরব কাবলাল ইসলাম, খণ্ড-১৬, পৃষ্ঠা-৯৫)

মহররমের ফজিলত ও তাৎপর্য

মহররম মাস সেই চার মাসের একটি, যার শ্রেষ্ঠত্ব ও মহিমা আল্লাহ তাআলা মহাবিশ্ব সৃষ্টি করার সময়ই লিখে রেখেছেন। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন : ‘প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর কাছে আল্লাহর কিতাবে (অর্থাৎ লাওহে মাহফুজে) মাসের সংখ্যা ১২টি। সেই দিন থেকে, যেদিন আল্লাহ আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছিলেন। এর মধ্যে চারটি মাস মর্যাদাপূর্ণ। (সুরা : আত-তাওবা, আয়াত : ৩৬)

এই ১২ মাসের মধ্যে চারটি মাস সম্মানিত। তিনটি ধারাবাহিক—জিলকদ, জিলহজ, মহররম আর চতুর্থটি হলো রজব, যা জুমাদাল উখরা ও শাবান মাসের মধ্যবর্তী মাস। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৪৬৬২; সহিহ মুসলিম, হাদিস : ১৬৭৯)

কাতাদা (রা.) বলেন, সম্মানিত মাসগুলোতে নেক আমল করার সওয়াব অনেক বড়। তাই এই সব মাসে গুনাহর শাস্তিও অনেক বড়, যদিও গুনাহ প্রতিটি যুগে (মন্দের দিক থেকে) বেশি হয়। (তাফসিরে ইবনে কাসির, খণ্ড-২, পৃষ্ঠা-১৪১)

আল্লামা ইবনে রজব হাম্বলি (রহ.) বলেন, পূর্বসূরিরা তিন দশকের প্রতি খুব গুরুত্ব ও মনোযোগ দিতেন—১. রমজানের শেষ দশক, ২. জিলহজের প্রথম দশক, ৩. মহররমের প্রথম দশক। (লাতায়িফুল মাআরিফ, পৃষ্ঠা-৮০)

মহররমের রোজার ফজিলত

মহররম মাসে নফল রোজার গুরুত্ব অপরিসীম। কারণ এই মাসের সঙ্গে আল্লাহ তাআলার এক বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে এবং এই সম্পর্কই মহররম মাসের শ্রেষ্ঠত্বের পরিচায়ক। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘রমজানের পর সর্বোত্তম রোজা আল্লাহর মাস মহররমের রোজা।’

(সহিহ মুসলিম, হাদিস : ১১৬৩)

এই হাদিসে মহররমের সাধারণ নফল রোজা উদ্দেশ্য এবং এটিই সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য অভিমত।

আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে দ্বিনের সঠিক বুঝ দান করুন। আমিন।

বিডি-প্রতিদিন/সালাহ উদ্দীন



এই পাতার আরো খবর