আল্লাহর পছন্দনীয় কোরআন মাজিদে অধিক ব্যবহৃত একটি শব্দ ইহসান। এটি অত্যন্ত ব্যাপক ও গভীর অর্থবহ একটি শব্দ। হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানি (রহ.) সহিহ বুখারির ব্যাখ্যাগ্রন্থ ফাতহুল বারিতে বলেন, ইহসানের দুই অর্থ : এক. কাউকে উপকার পৌঁছানো। দুই. কোনো কাজ যথাযথ ও সুচারুরূপে আঞ্জাম দেওয়া।
(ফাতহুল বারি : ১/১৪৬)
ইহসান আল্লাহ তাআলার গুণ এবং তাঁর অতি পছন্দনীয় একটি বৈশিষ্ট্য। হাদিস শরিফে বর্ণিত হয়েছে, ‘আল্লাহ তাআলা মুহসিন, তিনি সব কিছুতে ইহসান পছন্দ করেন।’ (মুসান্নাফে আবদুর রাজজাক, হাদিস : ৮৬০৩)
এমনকি এ গুণ অর্জনকারী ব্যক্তিকে আল্লাহ ভালোবাসেন। এ মর্মে তিনি বলেন, ‘তোমরা ইহসান অবলম্বন করো। নিশ্চয়ই আল্লাহ ইহসান অবলম্বনকারীদের ভালোবাসেন।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ১৯৫)
অন্য আয়াতে বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তাদেরই সাথি, যারা তাকওয়া অবলম্বন করে এবং যারা ইহসানের অধিকারী হয়।’ (সুরা নাহল, আয়াত : ১২৮)
তা ছাড়া ইহসান সব নবী-রাসুলের বৈশিষ্ট্য। তালের মাঝে ইহসানের গুণ সর্বোচ্চ মাত্রায় বিদ্যমান ছিল।
কোরআন মাজিদে আল্লাহ তাআলা নবীগণের প্রশংসায় বহুবার মুহসিন শব্দ উল্লেখ করেছেন। সুরা আনআমে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘এটা ছিল আমার দলীল, যা আমি ইবরাহিমকে দান করেছিলাম তার কওমের মোকাবেলায়। আমি যাকে ইচ্ছা উচ্চ মর্যাদা দান করি। নিশ্চয়ই আপনার প্রতিপালক প্রজ্ঞাময়, সর্বজ্ঞ। আমি ইবরাহিমকে দান করেছিলাম ইসহাক (-এর মতো পুত্র) ও ইয়াকুব (-এর মতো পৌত্র)।
তাদের প্রত্যেককে আমি হিদায়াত দান করেছিলাম। আর নুহকে আমি আগেই হিদায়াত দিয়েছিলাম এবং তার বংশধরদের মধ্যে দাউদ, সুলায়মান, আইয়ুব, ইউসুফ, মুসা ও হারূনকেও। এভাবেই আমি মুহসিনদের প্রতিদান দিয়ে থাকি।’ (সুরা আনআম, আয়াত : ৮৩-৮৪)
আর নবীদের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ের মুহসিন ছিলেন আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সা.)। নবীজির আবির্ভাবের পর তাঁর শিক্ষা ও আদর্শ ব্যতীত মুহসিন হওয়া সম্ভব নয়। তাই কোরআন-হাদিসে বর্ণিত মুহসিনদের এসব বৈশিষ্ট্য অর্জনে অধিক মনোযোগী উচিত। নিচে এর কয়েকটি বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা হলো।
আল্লাহর ওপর দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপন
মুহসিনদের প্রথম বৈশিষ্ট্য হলো আল্লাহর ওপর ঈমান আনা, সালাত কায়েম করা ও যথাসময়ে জাকাত দেওয়া। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘এগুলো হিকমতপূর্ণ কিতাবের আয়াত, যা ইহসান অবলম্বনকারীদের জন্য হিদায়াত ও রহমতস্বরূপ। যারা সালাত কায়েম করে, জাকাত দেয় এবং আখিরাতের প্রতি পরিপূর্ণ বিশ্বাস রাখে।’ (সুরা লুকমান, আয়াত : ২-৪)
সব আমলে ইখলাস ও সুন্নতের অনুসরণ
ইহসান অবলম্বনে আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো সব ধরনের আমলে ইখলাস ও সুন্নতের অনুসরণ করা। ইরশাদ হয়েছে, ‘তার চেয়ে উত্তম দ্বিন আর কার হতে পারে, যে (তার গোটা অস্তিত্বসহ) নিজ চেহারাকে আল্লাহর সম্মুখে অবনত করেছে, সেই সঙ্গে সে (তার আমলে) ইহসান অবলম্বনকারী এবং একনিষ্ঠ ইবরাহিমের দ্বিন অনুসরণ করেছে।’ (সুরা নিসা, আাায়াত : ১২৫)
এই আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম ইবনে কাসির (রহ.) বলেন, এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, যে ব্যক্তি ঈমানের সঙ্গে সওয়াবের প্রত্যাশায় একমাত্র আল্লাহ তাআলার জন্যই ইবাদত করে।
আর ‘মুহসিন’ দ্বারা উদ্দেশ্য, যে তার আমলের ক্ষেত্রে আল্লাহ প্রদত্ত শরিয়ত এবং তাঁর রাসুলকে যে হিদায়াত ও দ্বিনে হক দিয়ে পাঠিয়েছেন, তার অনুসরণ করে। (তাফসিরে ইবনে কাসির : ১/ ৮৫০)
সাহাবায়ে কিরামের অনুসরণ
ইহসানের গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক হলো, খোলাফায়ে রাশেদিন, মুহাজির-আনসারসহ সাহাবিদের প্রতি অন্তরে মহব্বত রাখা এবং তাঁদের সুন্নাহ ও আদর্শকে নিজেদের মধ্যে ধারণ করা। ইরশাদ হয়েছে, ‘মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে যারা ঈমানে প্রথমে অগ্রগামী এবং যারা নিষ্ঠার সঙ্গে তাদের অনুসরণ করেছে, আল্লাহ তাদের সবার প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং তারাও তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছে।’ (সুরা তাওবা, আাায়াত : ১০)
সত্য ও ন্যায়ের পথের অনুসরণ
সত্য ও ন্যায়ের পথে থাকা এটি মুহসিনদের অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটি বৈশিষ্ট্য। কারণ হকের অনুসরণে তারা কখনো পিছপা হয় না। এমনকি সেটা তাদের পূর্বেকার চিন্তা-চেতনা ও নীতি-আদর্শের বিপরীত হলেও। মুহসিন ব্যক্তি সর্বদা সত্য ও সঠিক বিষয়ের সন্ধানে থাকে। বিষয়টি সত্য প্রমাণিত হলে তারা সঙ্গে সঙ্গে তা গ্রহণ করে নেয়। পূর্বে নাসারা ছিল পরে মুসলমান হয়েছেন—এমন ব্যক্তিদের সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, ‘আর আমরা আল্লাহ এবং যে সত্য আমাদের প্রতি নাজিল হয়েছে তাতে কেন ঈমান আনব না, অথচ আমরা প্রত্যাশা করি, আমাদের প্রতিপালক আমাদের সত্কর্মশীলদের অন্তর্ভুক্ত করবেন? সুতরাং তাদের এ কথার কারণে আল্লাহ তাদের এমন জান্নাত দান করবেন, যার তলদেশে নহর প্রবহমান থাকবে। তাতে তারা সর্বদা থাকবে। এটাই ইহসান অবলম্বনকারীদের প্রতিদান।’ (সুরা মায়িদা,আয়াত : ৮৩-৮৫)
আল্লাহর ভয় ও ধৈর্য ধারণ করা
অন্তরে আল্লাহর ভয় ও বিপদ-আপদে ধৈর্য ধারণ করা এটি ইহসান অবলম্বনকারীদের অনেক বড় বৈশিষ্ট্য। ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহ আমাদের প্রতি বড়ই অনুগ্রহ করেছেন। প্রকৃতপক্ষে যে ব্যক্তি তাকওয়া অবলম্বন ও ধৈর্য ধারণ করে, আল্লাহ সেরূপ সত্কর্মশীলদের প্রতিদান নষ্ট করেন না।’ (সুরা ইউসুফ, আয়াত : ৯০)
গুনাহ ও অশ্লীল কাজ থেকে বেঁচে থাকা
ইমাম ইবনে রজব (রহ.) বলেন, মুহসিন হলো সে যে কবিরা গুনাহে লিপ্ত হয় না। কখনো হয়ে গেলে তাওবা করে ফেলে। আর সগিরা গুনাহ করলে সেটা তার নেক আমলসমূহের মাধ্যমে মাফ হয়ে যায়। তবে বারবার সেই গুনাহ করা যাবে না। যেমনটি আল্লাহ তাআলা বলেন, আর তারা জেনেশুনে তাদের মন্দ কৃতকর্মে অবিচল থাকে না। (সুরা আলে ইমরান, আয়াত : ১৩৫)
রাগ দমন ও ক্ষমা করার বৈশিষ্ট্য অর্জন করা
ইরশাদ হয়েছে, এবং নিজ প্রতিপালকের পক্ষ থেকে মাগফিরাত ও সেই জান্নাত লাভের জন্য একে অন্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হও, যার প্রশস্ততা আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতুল্য। তা সেই মুত্তাকিদের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে, যারা সচ্ছল ও অসচ্ছল অবস্থায় (আল্লাহর জন্য অর্থ) ব্যয় করে এবং যারা নিজের ক্রোধ হজম করতে ও মানুষকে ক্ষমা করতে অভ্যস্ত। আল্লাহ এরূপ পুণ্যবানদের ভালোবাসেন। (সুরা আলে ইমরান,আয়াত : ১৩৩-১৩৪)
মাতা-পিতা ও আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করা
ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো ও তাঁর সঙ্গে কাউকে শরিক করো না। মাতা-পিতার প্রতি সদ্ব্যবহার করো। আত্মীয়-স্বজন, এতিম, মিসকিন, নিকট প্রতিবেশী, দূর প্রতিবেশী, সঙ্গে বসা (বা দাঁড়ানো) ব্যক্তি, পথচারী এবং নিজের দাস-দাসীর প্রতিও (সদ্ব্যবহার করো)। নিশ্চয়ই আল্লাহ কোনো দর্পিত অহংকারীকে পছন্দ করেন না।’ (সুরা নিসা, আয়াত : ৩৬)
আল্লাহর প্রিয় এসব বৈশিষ্ট্য অর্জনে আমাদের তাওফিক দান করুন।
বিডি প্রতিদিন/ ওয়াসিফ