ঢাকা, রবিবার, ১০ নভেম্বর, ২০২৪

আজকের পত্রিকা

মুসাম্মান বুর্জ: মুসলিম স্থাপত্যের নান্দনিক নিদর্শন
মো. আবদুল মজিদ মোল্লা

মুসাম্মান বুর্জ ভারতের মোগল স্থাপত্যের অন্যতম শৈল্পিক নিদর্শন। ভারতের উত্তর প্রদেশের আগ্রা দুর্গেরই অংশ এই বুর্জ। আগ্রা দুর্গে অবস্থিত সম্রাট শাহজাহানের দিওয়ানে খাসের কাছেই এর অবস্থান। একটি করিডোর বুর্জকে দেওয়ানে খাসের সঙ্গে যুক্ত করেছে। সম্রাট শাহজাহান তার প্রিয়তম স্ত্রী মমতাজ মহলের জন্য মুসাম্মান বুর্জ নির্মাণ করেন। মুসাম্মান বুর্জ থেকে তাজমহল দেখা যায়। আগ্রা দুর্গের সবচেয়ে আলঙ্কারিক ভবন মনে করা হয় এটিকে। পুরো ভবনটিই দামি পাথরে আচ্ছাদিত।

মুসাম্মান মহল যে স্থানে দাঁড়িয়ে আছে সেখানে সম্রাট আকবর সর্বপ্রথম মার্বেল পাথরের একটি ভবন নির্মাণ করেন। যা সম্রাট জাহাঙ্গীর ভেঙ্গে ফেলেন নতুন ভবন নির্মাণের জন্য। কিন্তু তিনি তা নির্মাণের সুযোগ পাননি। সম্রাট শাহজাহান স্ত্রী মমতাজ মহলের জন্য একটি বহুতল ভবন নির্মাণ করেন। তিনি তাতে মূল্যবান পাথর এবং নান্দনিক কারুকাজ করেন। মুসাম্মান বুর্জ তৈরি হতে সময় গেলেছিল প্রায় ১০ বছর (১৬৩১-১৬৪০ খ্রি.)।

মুসাম্মান বুর্জের বিশেষত্ব হলো এটি সূক্ষ্ম মার্বেল জালি দিয়ে তৈরি। সঙ্গে আছে আলঙ্কারিক কুলুঙ্গি। এটি এমনভাবে তৈরি করা হয়েছিল যেন হেরেমের নারীরা নিজেকে আড়াল করে বাইরের দৃশ্য উপভোগ করতে পারে। দেয়ালের নকশায় ‘পেত্রা দুরা’ পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। পেত্রা দুরা হলো পলিশকৃত রঙিন পাথর ব্যবহার করে নকশা তৈরির বিশেষ পদ্ধতি। পেত্রা দুরা পদ্ধতি ব্যবহার করে ফুল-লতা-পাতার চিত্রকে জীবন্ত করে তোলা হয়েছে। যা একই সঙ্গে মুসলিম ধর্মবিশ্বাসেরও প্রতিনিধিত্ব করে।

মুসাম্মান বুর্জের ওপর মার্বেল পাথরের একটি গম্বুজ স্থাপন করা হয়েছে। গম্বুজের উপরিভাগে সোনালি বর্ণের তামার আচ্ছাদন আছে। গম্বুজের অভ্যন্তরভাগে এক সময় স্বর্ণের প্রলেপসহ রঙিন ফুলের নকশা ছিল। ব্রিটিশ বাহিনী আগ্রা দখলের পর তারা স্বর্ণের প্রলেপগুলো খুলে নেয় বলে অভিযোগ আছে। নিজ তলার মেঝেতে মার্বেল পাথর ব্যবহার করা হয়েছে। এর মাঝে আছে পানির ফোয়ারা। পানির ফোয়ারাটি স্থাপন করা হয়েছে পদ্মের আকারে তৈরি জলাধারে।

বুর্জের বারান্দা বৃত্তাকার। বারান্দায় দাঁড়ালেই যমুনা নদী ও তাজমহল দেখা যায়। নকশায় আছে ‘পচ্চিসি’ খেলার (১৬ গুটি জাতীয় একটি স্থানীয় খেলা) ছক। তাই অনেকের ধারণা, সম্রাট এখানে স্ত্রীর সঙ্গে ‘পচ্ছিসি’ খেলতেন। মুসাম্মান বুর্জের উল্লম্ব স্তম্বে করা হয়েছে অনুভূমিক ‘সাচ্চা’ (কয়েক স্তর বিশিষ্ট) নকশা। আবাসিক সুযোগ-সুবিধার বিচারে মুসাম্মান বুর্জ একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ ভবন। এর আছে নিজস্ব উঠান ও গোসলখানা। উঠানে এক সময় একটি মার্বেল আচ্ছাদিত ছোট কক্ষ ছিল। যাকে ফোয়ারা ও পানির ধারার মাধ্যমে গ্রীষ্মকালে শীতল রাখা হতো।

সম্রাট শাহজাহান জীবনের শেষ কয়েকটি বছর এখানে বন্দি জীবন কাটান। তখন সঙ্গে ছিলেন তাঁর প্রিয় কন্যা জাহানারা বেগম। ছেলে আওরঙ্গজেব তাঁদের দুজনকে বন্দি করে রাখেন। মুসাম্মান বুর্জে মৃত্যুশয্যায় শুয়ে সম্রাট শাহজাহান তাজমহলের দিকে তাকিয়ে থাকতেন। যেখানে প্রিয়তমা মমতাজ মহলকে দাফন করা হয়েছে। অসহনীয় বন্দি জীবনে এতটুকুই ছিল তাঁর ব্যথাতুর হৃদয়ে প্রশান্তির প্রলেপ, ভালোবাসার দাওয়াই। মানুষ রসিকতা করে বলে, প্রেমিক শাহজাহানের জন্য এর ভালো বন্দিশালা আর কিই বা হতে পারত!

সূত্র : ইস্তাম্বুল ইউনিভার্সিটি প্রেস কর্তৃক প্রকাশিত জার্নাল ‘আর্ট সানাত’, আগ্রা ইন্ডিয়া ডটঅর্গ ও উইকিপিডিয়া।

বিডি প্রতিদিন/জামশেদ



এই পাতার আরো খবর