ঢাকা, মঙ্গলবার, ৫ নভেম্বর, ২০২৪

আজকের পত্রিকা

দুবাইয়ে পালানোর আগে আরাভের ঠিকানা ছিল কলকাতার বস্তি!
দীপক দেবনাথ, কলকাতা
ফরতাবাদ এলাকার উদয় সংঘ ক্লাবের পাশেই এক বস্তিতে ছিলেন আরাভ খান। স্থানীয় বাসিন্দার ভাঙাচোরা এই বাসার দোতলায় স্ত্রীকে নিয়ে থাকতেন তিনি। ইনসেটে উপরে আরাভ খান, নিচে তার ভারতীয় পাসপোর্ট

বাংলাদেশের পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) পরিদর্শক মো. মামুন এমরান খান হত্যা মামলার অন্যতম আসামি আরাভ খান অবৈধভাবে সীমান্ত অতিক্রম করে গা ঢাকা দিয়েছিলেন দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার অধীন রাজপুর-সোনারপুর পুরসভার ফরতাবাদ এলাকায়।

আসল পরিচয় গোপন করে পাঁচ-ছয় বছর ফরতাবাদ এলাকার উদয় সংঘ ক্লাবের পাশেই এক বস্তিতে ছিলেন তিনি। স্থানীয় বাসিন্দা জাকির খানের ভাঙাচোরা বাসার দোতলায় মাসিক ২ হাজার রুপিতে ঘর ভাড়া নিয়ে থাকতেন আরাভ ও তার স্ত্রী সাজেমা নাসরিন। 

এরপর জাকির খান ও তার স্ত্রী রেহানা বিবি খানের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তোলেন তারা। আর সেই সম্পর্ককে কাজে লাগিয়েই জাকির ও রেহানার ভারতীয় আধার কার্ড সংগ্রহ করে তাদের উভয়কেই কথিত বাবা-মায়ের পরিচয় দিয়ে আরাভ ভুয়া ভারতীয় পাসপোর্ট তৈরি করেন বলে অভিযোগ। এরপর সেই পাসপোর্ট দিয়েই দুবাইয়ে পালিয়ে যান পুলিশ খুনের আসামি  আরাভ। এরপর থেকে গত কয়েক বছর ধরে দুবাইতেই অবস্থান করছেন দুবাইয়ের গোল্ড বাজারে অবস্থিত আরাভ জুয়েলারি শোরুমের মালিক আরাভ খান।

দিন কয়েক আগে এক ভিডিও বার্তায় দুবাইয়ে আরাভ জুয়েলারি নামে একটি শোরুমের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অংশ নিতে আমন্ত্রণ জানাতে দেখা যায় বাংলাদেশের তারকা ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানকে। সাকিবের এই ভিডিও বার্তাটি ওই জুয়েলারির স্বত্বাধিকারী আরাভ খানের ফেসবুক পেজ থেকেই গত ৩ ফেব্রুয়ারি শেয়ার করা হয়।

এরপর গত ১৫ মার্চ আরাভ জুয়েলারি শোরুমের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দেন শাকিব খানসহ দেশ বিদেশের একাধিক সেলিব্রেটি। কিন্তু কার ডাকে তারা দুবাইয়ে পাড়ি দেন? কে এই আরাভ খান? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজ করতে গিয়ে বেরিয়ে আসে চাঞ্চল্যকর তথ্য।

জানা গেছে, আরাভ খান ওরফে রবিউল ইসলাম ওরফে আপন ওরফে সোহাগ ওরফে হৃদয় নামের ব্যক্তিটি আদতে বাংলাদেশের গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ার আশুতিয়া গ্রামের বাসিন্দা। তার বাবার নাম মতিউর রহমান মোল্লা।

যদিও আরাভ ভারতীয় পাসপোর্ট ব্যবহার করেই গত কয়েক বছর ধরে দুবাইয়ে অবস্থান করছেন বলেই অভিযোগ। তার ভারতীয় পাসপোর্ট নাম্বার ইউ ৪৯৮৫৩৮৯। ওই পাসপোর্টেই পশ্চিমবঙ্গের নরেন্দ্রপুরের ঠিকানা দেওয়া রয়েছে।

শুধু তাই নয়, তার স্ত্রী ভারতীয় নাগরিক (আসাম) সাজেমা নাসরিনের পাসপোর্টটিও ভারতীয়। এমনকি আরাভের কথিত বাবা-মা জাকির খান ও রেহানা বিবি খানের পাসপোর্টেও তাদের উভয়ের ঠিকানা হিসেবে উল্লেখ রয়েছে কন্দর্পপুর, উদয় সংঘ ক্লাব, রাজপুর-সোনারপুর, দক্ষিণ ২৪ পরগনা, কলকাতা-৭০০০৮৪।

কলকাতার ইস্টার্ন মেট্রোপলিটন বাইপাস (ইএম বাইপাস) ধরে সোজা ফরতাবাদ মোড় থেকে বাম দিকে ৮০০ মিটার ভেতরে ঢুকলেই কন্দর্পপুর উদয় সংঘ ক্লাব। সেখানে জাকির খানের নাম বলতেই এক নারী এসে তার বাড়ি দেখিয়ে দিলেন। বোঝাই গেলো, ওই এলাকায় যথেষ্ট পরিচিত নাম জাকির খান। যদিও বছর দুয়েক আগে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান জাকির। তার বাড়িতে ঢুকতেই দেখা হলো তার স্ত্রী রেহানা বিবি খানের সাথে। প্রথম দিকে মুখ খোলার ব্যাপারে কিছুটা ইতস্তত বোধ করলেও গণমাধ্যমের কর্মী বলে পরিচয় দিতেই কিছুটা স্বাভাবিক হন রেহানা। মোবাইলে আরাভের ছবি দেখতেই রেহানা জানান ‘৫ বছর আগে আমাদের বাড়িতে ভাড়াটিয়া হিসেবে এসেছিল। আমাদের বাসায় এক বছর ভাড়া ছিল, এরপর চলে যায়। মাসিক ২০০০ রুপি করে ভাড়া দিত।

রেহানার দাবি ‘আমাদের আধার কার্ড নিয়ে আরাভ কী একটা ডকুমেন্টস তৈরি করবে বলেছিল। সেই কারণে আমি ও আমার স্বামী উভয়ই আরাভকে আমাদের আধার কার্ড দিয়ে দিই।’ 

আর সেই ভারতীয় আধার কার্ড দিয়েই নিজের স্ত্রীর ভারতীয় পাসপোর্ট তৈরি করেছিলেন আরাভ খান। যদিও তাকে কোনোদিনই সন্দেহ হয়নি বলেও জানান রেহানা। 

আরাভের কথিত মা হিসেবে পরিচয় দেওয়া রেহানা জানান, ‘মালিকের সাথে একজন ভাড়াটিয়ার যে সম্পর্ক থাকে আরাভ খানের সঙ্গে আমাদেরও সেই সম্পর্ক ছিল।’ 

রেহানার দাবি, ‘আজকে সকালেই আমি ইউটিউবে আরাভ খানের দুবাই যোগের বিষয়টি জানলাম। এলাকার লোকের সাথেও খুব একটা মেলামেশা করত না আরাভ। বাইরেও খুব একটা বের হতো না।’

যদিও এলাকায় খোঁজ নিয়ে দেখা গেল প্রত্যেকেই ব্যক্তিগতভাবে আরাভকে চিনতেন। বিএমডব্লিউ মোটরসাইকেলে করে এলাকায় স্টান্ট করতেও দেখা যেত তাকে। আরাভ নিজেকে একজন ফিল্ম আর্টিস্ট বলে পরিচয় দিতেন। এমনকি তার কথিত মা রেহানা বিবি খানও আরাভকে আর্টিস্ট বলেই জানতেন।

জানা গেছে, ২০১৮ সালে পুলিশ কর্মকর্তা মামুন ইমরান খানকে হত্যার পর পেট্রল ঢেলে লাশ পুড়িয়ে গাজীপুরে এক জঙ্গলের ভেতর ফেলে দেয় দুর্বৃত্তরা। ওই মামলার মূল অভিযুক্ত ছিলেন আরাভ খান। আর ওই সময় থেকেই পলাতক তিনি। পরে জানা যায় প্রকৃত আসামি আরাভের পরিবর্তে সে সময় কারাগারে যান আবু ইউসুফ লিমন নামে স্থানীয় এক যুবক। 

এদিকে ওই খুনের ঘটনার পরই অবৈধভাবে সীমান্ত পেরিয়ে সে বছরই ভারতে আশ্রয় নেন আরাভ খান। আসল পরিচয় গোপন করে আরাভ খান নামেই পরিচয় দিতে থাকেন তিনি। ভারতে এসেই আসামের গোয়ালপাড়ার বাসিন্দা সাজেমা নাসরিনকে বিয়ে করেন আরাভ।    বিডি প্রতিদিন/জুনাইদ আহমেদ  



এই পাতার আরো খবর