স্কুলে শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতিতে জড়িত সন্দেহে পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতাসীন দল তৃণমূল কংগ্রেসের বিধায়ক জীবনকৃষ্ণ সাহাকে গ্রেফতার করেছে ভারতের কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা সেন্ট্রাল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (সিবিআই)। গত শুক্রবার থেকে টানা ৬৫ ঘণ্টা ধরে টানা জিজ্ঞাসাবাদ ও তল্লাশি অভিযানের পর সোমবার ভোরে জীবনকৃষ্ণকে গ্রেফতার করা হয়। তিনি হলেন রাজ্যটির মুর্শিদাবাদ জেলার বড়ঞা কেন্দ্রের তৃণমূল বিধায়ক।
নিয়োগ দুর্নীতিকে কেন্দ্র করে ৩০০ কোটি রুপির লেনদেনের অভিযোগ রয়েছে জীবন কৃষ্ণের বিরুদ্ধে। চাকরি দেওয়ার নাম করে এই বিধায়কই সেই অর্থ তুলেছিলেন। তদন্তকারীদের ধারণা, কয়েক হাজার চাকরিপ্রার্থীর মাথা পিছু ৬ থেকে ১৫ লাখ রুপি করে নেওয়া হয়েছিল।
সোমবার দুপুরে তাকে কলকাতার আদালতে তুলে নিজেদের হেফাজতে চাইতে পারে সিবিআই। এরপর তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে এই দুর্নীতির আরও গভীরে প্রবেশ করতে চাইছে তদন্তকারী সংস্থা।
তদন্ত শুরুর প্রথম দিন, শুক্রবার বেলা সাড়ে বারোটায় বিধায়কের বাড়িতে দুটি গাড়িতে আসেন সিবিআইয়ের তদন্তকারী কর্মকর্তারা। তদন্তে গতি আনতে এরপর আরও দুটি গাড়িতে আসেন সিবিআই কর্মকর্তারা। নিজের বাড়ি ছাড়াও রঘুনাথগঞ্জে অবস্থিত বিধায়কের শ্বশুর বাড়িতেও তল্লাশি চালায় সিবিআই। এমনকি জীবন কৃষ্ণ সাহা বাড়ির পেছনের দিকে থাকা একটি পুকুরেও তল্লাশি অভিযান শুরু করে তদন্তকারী কর্মকর্তারা।
সোমবার ভোররাতে (২.৩৫ নাগাদ) আরও একটি গাড়িতে সিবিআইয়ের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা আন্দি গ্রামে বিধায়কের বাড়িতে ঢোকেন। তাদের সঙ্গে আসেন কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানরাও। অবশেষে এদিন ভোর ৫.১৫ নাগাদ জীবনকৃষ্ণকে বাড়ি থেকে বের করে সিবিআইয়ের গাড়িতে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। এসময় বিধায়কের পরিবারের লোকজন কান্নায় ভেঙে পড়েন।
অভিযোগ প্রথম থেকেই তদন্তে অসহযোগিতা করছিলেন তৃণমূল বিধায়ক। এবং তার বাসায় সিবিআইয়ের অভিযান চলাকালীন একাধিক নাটকীয় ঘটনা ঘটতে দেখা যায়। শুক্রবার তদন্ত শুরুর প্রথম দিন সিবিআই-এর জেরার মুখে পড়ে অভিযুক্ত বিধায়ক জীবনকৃষ্ণ সাহা, তার কাছে থাকা মোবাইল ফোনটি ছুড়ে ফেলেন বাড়ির পেছনে থাকা ওই পুকুরে আর তাতেই কার্যত বেজায় ক্ষিপ্ত ওঠেন সিবিআই কর্মকর্তারা। এরপর ওই মোবাইলের সন্ধানে শনিবার মোটর পাম্প চালিত যন্ত্র এনে পুকুরের পানি সরিয়ে তল্লাশি অভিযান শুরু করা হয়। পরে আরও একটি মোবাইল ফোন পানিতে ফেলে দেন তিনি। অভিযোগ তথ্য প্রমাণ লোপাটের চেষ্টায় বাড়ির পেছনের পুকুরে নিজের দুটি মোবাইল ফোন ফেলে দেন তিনি। টানা ৩৮ ঘণ্টা ব্যয় করে পুকুরের পানি তুলে সিবিআই কর্মকর্তারা একটি মোবাইল ফোনের সন্ধান পান।
আর ওই ঘটনার পর থেকেই অভিযুক্ত বিধায়ককে কড়া নজরদারিতে রাখেন তদন্তকারী কর্মকর্তারা। এমনকি তদন্তকারী সংস্থার নজরদারির মধ্যেই বাড়ির দেয়াল টপকে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন বলেও অভিযোগ ওঠে জীবনকৃষ্ণ সাহার বিরুদ্ধে।
তদন্ত শুরুর মুখেই বিধায়কের বাড়ির পেছনে রাইস মিলের দেয়াল সংলগ্ন জঙ্গল থেকে পাঁচটি ব্যাগ ভর্তি নথি উদ্ধার করেন সিবিআই কর্মকর্তারা। সেই ব্যাগগুলো থেকে তারা শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতির একাধিক নথি বাজেয়াপ্ত করেছেন বলে জানা গেছে। এছাড়াও বিধায়কের শোয়ার ঘরের বিছানার নিচে থেকে বেশ কয়েকটি ফাইল ও ঠাকুর ঘরের সিঁদুরের কৌটা থেকে একটি পেনড্রাইভ পাওয়া গেছে বলেও জানা যায়।
শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় জীবনকৃষ্ণের আগে দুজন বিধায়ক গ্রেফতার হয়েছিলেন। তারা হলেন-পার্থ চট্টোপাধ্যায় এবং মানিক ভট্টাচার্য। স্বাভাবিকভাবে এ ঘটনায় বেশ কিছু ব্যাকফুটে মমতা ব্যানার্জির দল ও সরকার।
উল্লেখ্য, গত বছরের জুলাই মাসে প্রথম গ্রেফতার হন পশ্চিমবঙ্গের সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ও তৃণমূল কংগ্রেস বিধায়ক পার্থ চট্টোপাধ্যায় এবং তারই ঘনিষ্ঠ অর্পিতা চ্যাটার্জি। তাদের গ্রেফতার করে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা ইডি। সেসময় অর্পিতা চ্যাটার্জির টালিগঞ্জ ও বেলঘড়িয়ার দুইটি অভিজাত ফ্ল্যাট থেকে উদ্ধার হয় প্রায় ৫০ কোটি রুপি, গহনা, শিক্ষক নিয়োগ সম্পর্কিত বিভিন্ন নথি। এরপর থেকে এই দুর্নীতিতে জড়িত থাকার অভিযোগে গত প্রায় এক বছর ধরে বিভিন্ন সময়ে গ্রেফতার হয়েছেন তৃণমূলের বিধায়ক, প্রভাবশালী নেতা, রাজ্যের সচিবরা। তারা প্রত্যেকেই এখন কারাগারে বন্দিদশা কাটাচ্ছেন।
বিডি প্রতিদিন/এমআই