ঢাকা, মঙ্গলবার, ৫ নভেম্বর, ২০২৪

আজকের পত্রিকা

অমর্ত্য সেনের প্রতি বিশ্বভারতীর আচরণে বিশিষ্টজনদের নিন্দা
দীপক দেবনাথ, কলকাতা
অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন। ফাইল ছবি

নোবেলজয়ী ভারতীয় অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক অমর্ত্য সেনকে হেনস্তা করার অভিযোগ তুলে খোলা চিঠি দিয়েছে বাম সমর্থিত পশ্চিমবঙ্গের প্রায় শতাধিকের বেশি বিশিষ্টজন। অভিনেতা থেকে শিল্পী, লেখক, সাহিত্যিক, কবি, শিক্ষাবিদ-সকলেই অমর্ত্য সেনের পাশে দাঁড়িয়েছেন। এমনকি, অমর্ত্য সেনের বিতর্কিত জমি সংক্রান্ত বিষয়ে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকায় আচার্য তথা দেশটির প্রধানমন্ত্রী এখনো নীরব কেন, সেই প্রশ্নও তোলা হয়েছে খোলা চিঠিতে।

‘পশ্চিমবঙ্গ গণতান্ত্রিক লেখক শিল্পী সংঘ ও ভারতীয় গণনাট্য সংঘ’র পক্ষে ১২৮ জন বিশিষ্টজন বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে খোলা চিঠি প্রকাশ করেন গত ২১ এপ্রিল। শিক্ষাবিদ পবিত্র সরকার থেকে শুরু করে অভিনেতা বাদশা মৈত্র, বিপ্লব চট্টোপাধ্যায়, পরান বন্দ্যোপাধ্যায়, নাট্য ব্যক্তিত্ব চন্দন সেন, পরিচালক রাজা সেন, অনীক দত্ত, সংগীতশিল্পী ও সুরকার কল্যাণ সেন বরাট, দেবজ্যোতি মিশ্র, চলচ্চিত্রকার অনিন্দিতা সর্বাধিকারীর মতো ব্যক্তিরা অমর্ত্য সেনের পাশে দাঁড়িয়েছেন। তেমনি পাশে দাঁড়িয়েছেন সাবেক সিপিআইএম সাংসদ মালিনী ভট্টাচার্য, কলকাতার সাবেক মেয়র ও আইনজীবী বিকাশ রঞ্জন ভট্টাচার্য, কবি শুভেন্দু মাইতি, রাজ্যের সাবেক মন্ত্রী অঞ্জন বেরা, কবি মন্দাক্রান্তা সেনের মতো ব্যক্তিরাও।

ওই খোলা চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, গত কয়েকমাস ধরে বিশ্ববিশ্রুত অর্থনীতিবিদ ও দার্শনিক নোবেলজয়ী অধ্যাপক অমর্ত্য সেনের সঙ্গে বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ যে আচরণ করে চলেছে, আমাদের কাছে দুর্বোধ্য ও নিন্দাজনক মনে হয়েছে। 

আরও লেখা হয়েছে, উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত কিছু জমি তিনি ভোগ করছেন-এটাকে তার সজ্ঞান অপরাধ ধরে নিয়ে বিশ্বভারতী তাকে অপরাধী সাব্যস্ত করেছে এবং তার প্রতি নানা অপমানজনক ব্যবহার করে চলেছে। যে বিষয়টি আদালতের মাধ্যমে নিষ্পত্তি হওয়া প্রয়োজন, সেই বিষয়টি নিয়ে বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ অশোভন ব্যগ্রতা দেখাচ্ছে ও অধাপক সেনকে তার পৈতৃক গৃহ থেকে উৎখাত করতে উদ্যত হয়েছে। এই ঘটনা শুধু বাঙালি নয়, সমস্ত ভারতীয় এবং বিশ্ববাসীর কাছেও আমাদের মাথা হেঁট করে দিয়েছে। তাকে লেখা বিশ্বভারতীর পত্রগুলোর ভাষাও অত্যন্ত আপত্তিকর বলে আমরা মনে করি।

আরও লেখা হয়, অধ্যাপক অমর্ত্য সেনের প্রতি এই দুর্ব্যবহারকে আমরা ধিক্কার জানাই এবং বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষকে অবিলম্বে এই উদ্যোগ থেকে প্রতিনিবৃত্ত হতে বলি। সেই সঙ্গে বিশ্বভারতীর আচার্য ভারতের প্রধানমন্ত্রীর এই বিষয়ে গভীর মৌনতা আমাদের বিস্মিত করে।

ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের সাবেক প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টা অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসু টুইট করে জানিয়েছেন ‘শান্তিনিকেতনের বিশ্বভারতীর পক্ষে অমর্ত্য সেনকে যে ধরনের হয়রানি ও উচ্ছেদের নোটিশ দেওয়া হয়েছে, তা ভারতের জন্য বিব্রতকর। অমর্ত্য সেন একজন ভারতীয় নাগরিক এবং গোটা বিশ্বের আইকন। বিশ্বভারতীর এই পদক্ষেপ ভারতের গণতন্ত্রের জন্য একটি নিম্নমানের উদাহরণ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে।

পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার শান্তিনিকেতনে অমর্ত্য সেনের বাড়ির ওই জমি নিয়ে বিতর্ক দীর্ঘদিনের। অমর্ত্য সেনের ‘প্রতীচী’ বাড়িতে মোট জমির পরিমাণ ১.৩৮ একর জমি। বিশ্বভারতীর দাবি ওই জমির পরিমাণ ১.২৫ একর। সে অর্থে বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষের অভিযোগ ছিল ‘প্রতীচী’ বাড়িতে ১৩ শতক (ডেসিমেল) জমি দখল করে রেখেছেন অমর্ত্য সেন। তিনটি চিঠি দিয়ে সে জমি ফেরতও চায় বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

এই পরিস্থিতিতে অমর্ত্য সেনের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। গত জানুয়ারি মাসের শেষে শান্তিনিকেতনে গিয়ে অমর্ত্য সেনের সাথে দেখা করে জমি সম্পর্কিত বিভিন্ন নথি অমর্ত্য সেনের হাতে তুলে দেন মমতা। অমর্ত্য সেনের পাশে দাঁড়িয়ে, প্রয়াত পিতা আশুতোষ সেনের উইল অনুযায়ী ১.৩৮ একর জমিই অমর্ত্য সেনের নামে রেকর্ড করে দেওয়ার নির্দেশ দেন মমতা। সেই মোতাবেক বোলপুর ভূমি ও ভূমি সংস্কার দপ্তর ওই জমি অমর্ত্য সেনের নামে রেকর্ড করে দেয়।

এরই মধ্যে গত ১৭ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের যুগ্ম কর্মসচিব ও এস্টেট বিভাগের কর্মকর্তার উদ্দেশে একটি চিঠি দিয়ে অমর্ত্য সেন জানান, ইজারার (লিজ) মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে কেউ তার ‘প্রতীচী’ জমি দাবি করতে পারে না।

কিন্তু বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও তাদের সিদ্ধান্তে অনড় থাকে। গত ২০ এপ্রিল বিশ্বভারতীর যুগ্ম কর্মসচিব ও এস্টেট কর্মকর্তা অশোক কুমার মাহাতো’র স্বাক্ষর করা ছয় পাতার চিঠিতে বিস্তারিত উল্লেখ করে কঠোর পদক্ষেপের কথা জানিয়ে দেয়। সেখানে অমর্ত্য সেনকে তার ‘প্রতীচী’ বাড়ির ১৩ শতক জমি খালি করার জন্য ১৫ দিনের সময়সীমা বেঁধে দেয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। সেক্ষেত্রে আগামী ৬ মের মধ্যে জমি খালি করতে বলা হয়েছে। অন্যথায় বলপ্রয়োগ করা হবে বলেও হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে।

কিন্তু জমি ফেরত চেয়ে অমর্ত্য সেনকে বিভিন্ন সময়ে বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষের পক্ষে যে চিঠি দেওয়া হয়েছে, তাতে বহু অসম্মানজনক শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে বলে অভিযোগ। একইসঙ্গে এরকম একজন বিশ্ব বরেণ্য ব্যক্তিকে হেনস্তা করারও অভিযোগ উঠেছে-আর তা নিয়েই এবার সরব বাম সমর্থিত বিশিষ্টজনরা।

বিডি প্রতিদিন/এমআই



এই পাতার আরো খবর