ঢাকা, সোমবার, ২৬ আগস্ট, ২০২৪

আজকের পত্রিকা

তিন বন্ধুর মিলন হলো দীর্ঘ ৫৫ বছর পর কলকাতার বইমেলায়
দীপক দেবনাথ, কলকাতা
স্মৃতি রোমন্থন করেন তিন বন্ধু

কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলায় এসে কেউ নতুন প্রেমে পড়েছেন, বইকে ভালো বেসেছেন। বই মেলায় এসে হারিয়ে যাওয়ার দুই একটি ঘটনাও হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে। কিন্তু এই বইমেলাই যে হারানো বন্ধুদের ফিরে পাওয়ার নতুন ঠিকানা হতে পারে তা হয়তো অনেকেরই অজানা ছিল। যেটা হলো শনিবার। বলা যেতে পারে দুই বাংলার বন্ধুত্বের সেতুবন্ধন রচিত হলো আন্তর্জাতিক কলকাতা বইমেলায়। 

তিনজনেরই জন্ম পশ্চিমবঙ্গে। কলেজে পড়ার সময় তাদের গড়ে ওঠে বন্ধুত্ব। পরে জীবিকা সূত্রে কেউ রয়ে গেলেন ভারতে, কেউ পাড়ি দিলেন বাংলাদেশে। কার্যত তখন থেকেই বন্ধু-বিচ্ছেদ! দীর্ঘ প্রায় ৫৫ বছর পরে সেই বইমেলা'ই মিলিয়ে দিল তিন বন্ধুকে। 

শনিবার বিকালে কলকাতা বইমেলা প্রাঙ্গণে নিজেদের মধ্যে দেখা হতেই উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়েন তিন বন্ধু গৌতম রায়- সফিউদ্দিন আহমেদ এবং দীপক চৌধুরী। চিৎকার করে ছুটে এসে কলকাতার দুই বন্ধুকে বুকে টেনে নিলেন সফিউদ্দিন। তিন বন্ধুর মধ্যে ফিরে আসলো ৫ দশক আগেকার বাল্যকালের সেই স্মৃতি। তুই-তাকারি করে একে অপরকে সম্বোধন করলেন। দীর্ঘদিন জমে থাকা কথা শেয়ার করলেন। এরপর কলকাতা দুই বন্ধুকে বাংলাদেশের টি-শার্ট, টেবিল ক্যালেন্ডার এবং ডাইরি তুলে দিলেন সফিউদ্দিন। তাদের এই বিরল মুহূর্তের সাক্ষী ছিল কলকাতার বেশ কিছু গণমাধ্যম কর্মীরাও। সবাই মিলে বেশ কিছু সময় কাটালেন বইমেলা প্রাঙ্গণে। পরে চায়ের ভাড়ে চুমুক দিতেও দেখা যায় তিন বন্ধুকে। 

১৯৬৪ সালে কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজে একসাথে ভর্তি তিন বন্ধু। সেখানেই আলাপ, পরে সেই সম্পর্ক আরো গাঢ় হয়। এরপর ১৯৬৭ পর্যন্ত ইংরেজি অনার্সে স্নাতক এবং পরের দুই বছর স্নাতকোত্তর- টানা ছয় বছর তিনজনই ছিলেন হরিহর আত্মা। কলেজ থাকাকালীন তিন বন্ধু মিলে দুষ্টুমিও করে বেরিয়েছিলেন। কিন্তু ১৯৬৯ সালে স্নাতকোত্তর পরীক্ষা দেওয়ার পর থেকেই কার্যত বন্ধুত্বের ছেদ পড়ে তাদের। 

সফিউদ্দিনের জন্ম পশ্চিমবঙ্গের হাওড়ার মৌড়িগ্রামে। পড়াশোনার পাট চুকিয়ে কর্মসূত্রে চলে যান বাংলাদেশে। শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনায় যোগ দেন। তারপর সেখানেই থেকে গিয়েছেন। 

অন্যদিকে দীপক চৌধুরী থাকেন হাওড়ার রামরাজাতলায়। ভারতের কেন্দ্রীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে কাজ করতেন। আর কলকাতার একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে কাজ করতেন গৌতম রায়। বর্তমানে টালিগঞ্জের বাসিন্দা। যদিও এখন তিন বন্ধুই তাদের নিজ নিজ কর্মক্ষেত্র থেকে অবসর নিয়েছেন। তিনজনেরই বয়স ৭৫ এর কোটায়।

একদিন বইমেলার প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে সেই পুরনো স্মৃতি টেনে সফিউদ্দিন জানান, আমার মায়ের বাড়ি পশ্চিমবঙ্গে, বাবার বাড়ি বাংলাদেশে। তাই আমার দুই দেশেই সমান অধিকার রয়েছে। ফলে কলকাতা শহর নতুন কিছু নয় শফিউদ্দিনের কাছে। বছরে চারবার এই কলকাতা শহরে আসলেও কোনোবারই দেখা মেলেনি বন্ধুদের। তবে একবার উদ্যোগী হয়ে কলেজ বন্ধুর খোঁজে টালিগঞ্জ পর্যন্ত চলে গিয়েছিলেন সাফিউদ্দিন। আশেপাশের লোকজনকে জিজ্ঞাসাও করেন কিন্তু কিন্তু খালি হাতে ফিরে আসতে হয়।

শেষমেষ কলকাতা বইমেলাকেই সাক্ষাৎ কেন্দ্র হিসেবে কেন বেছে নিলেন এই প্রশ্নের উত্তরে সাফিউদ্দিন জানান, ৪ ফেব্রুয়ারি আমার আসার কথা ছিল। কিন্তু বইমেলা ও বন্ধুদের সাথে দেখার কর্মসূচি থাকায় আজই কলকাতায় চলে আসি। আগামী ২৯ জানুয়ারি পর্যন্ত কলকাতায় থাকবেন সাফিউদ্দিন। ততদিন বন্ধুদের সাথে চুটিয়ে মজা করা, খাওয়া-দাওয়া, দর্শনীয় স্থান ঘুরে দেখা এমনকি কলকাতার ঐতিহ্যবাহী কফি হাউজেও যেতে পারেন তিন বন্ধু।

এ প্রসঙ্গে সফিউদ্দিন জানান, ১৯৬৪ সালে আমরা ৩৫ পয়সা করে কফি খেয়েছি। সেসময় কফি তৈরির প্রক্রিয়াও ছিল আলাদা ধরনের। ট্রেতে করে গরম পানি, চিনি, দুধ ও কফি আলাদা আলাদা ভাবে আসতো। আর তা থেকে যে দুধটা বেঁচে যেত পরে সেই দুধটা তিন বন্ধু মিলে ভাগাভাগি করে খেতাম। 

সফিউদ্দিনকে কাছে পেয়ে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়া  গৌতম রায় জানান, পুরনো বন্ধুকে ফিরে পাবো এমন আশা ছেড়েই দিয়েছিলাম। বারে বারে মনে হচ্ছিল বন্ধুদের যদি খুঁজে পাওয়া যেত! আমার একার পক্ষে শফিকে খোঁজা কার্যত অসম্ভব ছিল। এরপরেই গত ২৪ ডিসেম্বর আমি হ্যাম রেডিও’র সাথে যোগাযোগ করি। তাদের কাছে সফির ৫৫ বছর আগেকার একটি সাদাকালো ছবি ও ডিটেলস পাঠাই। এবং কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই অসাধ্য সাধন হয়। বাংলাদেশ থেকে সফির একটা ছবি পাঠানো হয় এবং সেই হাসি দেখেই তাকে চিনতে কোনো অসুবিধাই হয়নি। ভিডিও কলে আমি সফির নাম ধরে চিৎকার করে উঠি, সেও আমার নাম ধরে চিৎকার করে ওঠে। 

সুতরাং, সফিউদ্দিনের সাথে কলকাতার দুই বন্ধুর মিলনের পিছনে বড় অবদান রয়েছে দুই বাংলার হ্যাম রেডিওর। এ কথা স্বীকার করে নিয়েছেন তিন বন্ধুই। এমনকি বাংলাদেশের ওই বন্ধুকে ফিরে পেতে এতটাই উদগ্রীব হয়ে উঠেছিলেন যে, এক সময় নিজের সম্পত্তির ভাগও দিতে রাজি হয়েছিলেন গৌতম রায়। 

গত ডিসেম্বরেই সফিউদ্দিনের সঙ্গে গৌতম রায়ের যোগাযোগ করিয়ে দেন হ্যাম রেডিও’র পশ্চিমবঙ্গ পার্টের সম্পাদক অম্বরীশ নাগ বিশ্বাস এবং অ্যামেচার রেডিও সোসাইটি অব বাংলাদেশের কার্যকরি সম্পাদক শামসুল হুদা।  মূলত তাদের সৌজন্যেই প্রায় ৫৫ বছর পর স্কটিশের বন্ধু সফিউদ্দিনের খোঁজ পান গৌতম-দীপকরা। এর পরই তিন বন্ধু মুখোমুখি হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। আসলে যে সুতো ছিঁড়ে গিয়েছিল কালের স্রোতে, সেটাই আবার জুড়ল শনিবার। কলেজের বন্ধু গৌতম ও দীপক’এর সঙ্গে দেখা করতেই বাংলাদেশ থেকে কলকাতা বইমেলায় আসেন সফিউদ্দিন। জমিয়ে আড্ডা দিলেন স্কটিশের সেই তিনমূর্তি। 

অম্বরিশ জানান, চেষ্টা করলেই সফলতা আসে। গৌতম নামে একজন প্রবীণ নাগরিক আমায় ফোন করে বললেন তার বন্ধুকে ফিরে পেতে গাঁটের পয়সা খরচ করতেও রাজি। এরপরে এসে বন্ধুকে খুঁজে পেতে অ্যামেচার রেডিও অব বাংলাদেশ’র সাথে যোগাযোগ করি। এরপর সফলও হই। তার অভিমত, মেলা মানেই মিলন। হ্যাম রেডিওর পক্ষ থেকে আমরা খুবই গর্বিত যে, মেলায় ৫৫ বছর পর দুই বন্ধুকে পেল। এটা একটা ইতিহাস। 

অন্যদিকে শামসুল হুদা জানান, আমি যখন জানতে পারলাম যে তিন বন্ধু বইমেলাতে মিলিত হচ্ছেন, তখন আমিও ঠিক করলাম ওই সন্দীক্ষণে আমাকেও থাকতে হবে। আমাকে ওই ঐতিহাসিক মুহূর্তের সাক্ষী হতে হবে। আর তাই ঢাকা থেকে আমিও কলকাতায় চলে আসি। শামসুল হুদা এটাও জানান, গৌতম বাবুর মোবাইল টেক্সটে একটি লাইন ছিল তা হলো, জীবনের শেষ বেলা আমি আমার বন্ধুকে দেখতে চাই। ওই টেক্সট পাওয়ার তিন ঘণ্টার মধ্যে আমি তার বন্ধু সফিউদ্দিনকে খুঁজে বের করি। 

উল্লেখ্য, বৃহস্পতিবার মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির হাত ধরে উদ্বোধন হয় কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলার। মেলা চলবে ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত। মেলার দ্বার খোলা থাকবে প্রতিদিন দুপুর ১২ টা থেকে রাত ৮ টা পর্যন্ত। ভিড় ও উন্মাদনায় এ যেন বাঙালির ‘দ্বিতীয় দুর্গোৎসব’। সেই সাথে উৎসব এই ‘থ্রি ইডিয়টস’রও। হবেই না বা কেন? এদিন চায়ের ভাড়ে চুমুক দিতে দিতেই নিজেদেরকে ‘থ্রি ইডিয়টস’ বলে সম্বোধন করলেন গৌতম রায় নিজেই।  

বিডিপ্রতিদিন/কবিরুল



এই পাতার আরো খবর