ঢাকা, মঙ্গলবার, ১৬ জুলাই, ২০২৪

আজকের পত্রিকা

বাংলাদেশ প্রতিদিনে সমরেশ মজুমদার
অনলাইন প্রতিবেদক

রবীন্দ্রজয়ন্তীতে প্রয়াণ হলো প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক সমরেশ মজুমদারের। উত্তরাধিকার,কালবেলা, কালপুরুষ, সাতকাহন, গর্ভধারিনীসহ অসংখ্য কালজয়ী উপন্যাস, গল্প, কবিতার স্রষ্টা তিনি। বাংলাদেশ প্রতিদিনের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক ছিল দুই বাংলার জনপ্রিয় এই সাহিত্যিকের। নিয়মিত লিখেছেন এখানে। বাংলাদেশ প্রতিদিনের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে প্রকাশিত তার শুভেচ্ছাবার্তাগুলো তুলে ধরা হলো এখানে-

 

আমিও সঙ্গে আছি

মাসদুয়েক আগে ঢাকা শহর থেকে বেরিয়ে সোনারগাঁও লোকশিল্প জাদুঘরের পথে যেতে একটি নির্জন চায়ের দোকানে গাড়ি থেকে নেমেছিলাম। চারপাশে ধু-ধু মাঠ, বাঁশের চর বেঞ্চি পাতা, বাখারির দেয়ালের মধ্যে বসে আমার অনুরোধে চা বানাচ্ছিলেন যিনি তিনি একগাল হেসে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ভালো চা না নরমাল?’ চা খাওয়ার আগে সে স্টলে খবরের কাগজটা দেখতে পেলাম চাওয়ালা তার পাশে ভাঁজ করে রেখেছেন। সকালে ওই কাগজটি পড়েছি ঢাকা ক্লাবের ঘরে বসে। প্রসঙ্গ তুলতেই চাওয়ালা বললেন, “পড়বেন?  ভেতরের পাতা ছেঁড়া আছে।

‘কেন?’ চায়ের কাপ হাতে নিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম।”

‘সবাই টানাটানি করে পড়লে যা হয়। এখন প্রায় দুপুর, তাই দোকান ফাঁকা।

‘এই কাগজটা কেন কেনেন?’

‘সত্যি কথা বলি। নামের আগে বাংলাদেশ দেখলে বুকটা কেমন করে। আর এই কাগজ আমাদের কথা বলে। কোনো রাজনৈতিক দল অথবা বিত্তবানদের দালালি করে না।একেবারে আমজনতার দুঃখ আর আনন্দের কথা বলে। কারও চামচামি করে না। দামটা দেখুন, কিনতে অসুবিধা হয় না। চাওয়ালা হাসলেন।

‘বাংলাদেশ প্রতিদিন’ সম্পর্কে এই বিশ্লেষণের সঙ্গে একমত হয়েছেন ঢাকার রিকশাওয়ালা, স্কুলের শিক্ষক, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। মনে মনে কপালে আঙ্গুল ছোঁয়ালাম, স্যালুট।

খবরের কাগজ মানুষ কেনেন পকেটের পয়সা খরচ করে। এই পাঠক অত্যন্ত সচেতন।তারা ঝোঝেন কোন কাগজ সংবাদ তৈরি করছে, কোন কাগজ যা ঘটছে তার সঠিক বিবরণ দিচ্ছে। যে কাগজ আওয়ামী লীগের পক্ষে কথা বলে সেই কাগজ বিএনপির সমর্থক পড়েন না, যে কাগজ কাব্য করে খবর ঘোরায় পাঠক দুই দিন পরে তাকে বাতিল করবে। শুধু খবর নয়, নাটক, চলচ্চিত্র,খেলার জগৎ সম্পর্কে পাঠকের যে ঔৎসুক্য তা মেটানোর দায়িত্ব থাকে খবরের কাগজের ওপর। যে চলচ্চিত্র অথবা বইকে খবরের কাগজের সমালোচক প্রশংসার বন্যায় ভাসিয়ে দিলেন, দর্শক বা পাঠক তাদের চটজলদি বাতিল করলে কাগজটি বিশ্বাসযোগ্যতা হারাবেই।

‘বাংলাদেশ প্রতিদিন’ আবির্ভাবের প্রথম দুই বছরেই সেই বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করেছে। সম্পাদক নঈম নিজাম দুই বছর পূর্তিতে জানিয়েছিলেন, বাংলাদেশ প্রতিদিনের প্রচার সংখ্যা ৬ লাখ। ১৬ কোটি বাঙালির দেশে এই সংখ্যা বাড়াতে তিনি বদ্ধপরিকর। আমার বিশ্বাস, এই পথে হাঁটলে তার স্বপ্ন সার্থক হবেই।

আজ চতুর্থ বছরে পা দিল ‘বাংলাদেশ প্রতিদিন’। মানুষ জন্মায়,হামাগুড়ি দেয়, টলটলে পায়ে হাঁটতে শেখে, শেষে দৌড়ায়। এই তিনটি পর্ব বাংলাদেশ প্রতিদিন তিন বছরে শেষ করেছে। এখন তার দৌড় ১৬ কোটির দিকে।

আমার আন্তরিক অভিনন্দন রইল। আমিও সঙ্গে আছি।

 

পাঁচে পা, নিশ্চিত আরও বড় চমক অপেক্ষা করছে

আমি স্কুলে ভর্তি হয়েছিলাম পাঁচ বছর বয়সে। তখন ওই বয়সটায় সবাই স্কুলে যেত। পাঁচ বছর বয়স হতে স্মৃতিরা মনে দিব্যি বেঁচে থাকে প্রায় আমৃত্যু। পাঁচ বছর বয়স হলে মানুষ নিজের কথা ভাবতে শেখে। বাড়ির বাইরে আশপাশে একা বের হওয়ার সাহস পায়। তাই পাঁচ বছর সময়টা খুব মূল্যবান।

খবরের  কাগজের জীবনে প্রথম পাঁচ বছর থাকে বেশ নড়বড়ে। অনেক বড় ছোট কাগজের ভিড়ে পাঠকের চোখ পড়তে হিমশিম খেতে হয়। স্টলে সাজানো অনেক কাগজের মধ্যে ওই শিশু কাগজটিকে তুলে নেবেন পাঠক এই আশা বুকে নিয়ে খবর সাজানো হয়। কিন্তু পাঠকের মন পাওয়া খুব মুশকিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর অনেক খবরের কাগজ জন্ম নিয়েছিল। তাদের মধ্যে এবং তার বহু আগে থেকে ইত্তেফাক পাঠকপ্রিয় ছিল। তার সঙ্গে লড়াই করে জায়গা নিতে সময় লাগছিল অনেক কাগজের। বছর তিনেক আগে নরসিংদী যাওয়ার পথে একটি গ্রাম্য চায়ের দোকানে চা খেতে গিয়ে একটি নতুন কাগজ দেখে কৌতূহলী হইনি। নতুনরা আসে-যায়ও। কিন্তু দুজন পাঠক দোকানের বেঞ্চে বসে ভাগাভাগি করে কাগজটা পড়ছেন দেখে জিজ্ঞাসা করেছিলাম নাম। বাংলাদেশ প্রতিদিন মানে প্রতিদিনের বাংলাদেশকে পাঠকের সামনে তুলে ধরার অঙ্গীকার। পরে জানলাম মূল্য মাত্র দুই টাকা। জিজ্ঞাসা করলাম দাম কম বলে কিনছেন? সঙ্গে সঙ্গে চা দোকানির প্রতিবাদ, না স্যার কাগজটা পড়ে দেখুন, তাহলে বুঝবেন কেন রাখছি। শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ প্রতিদিনের সঙ্গে আমি জড়িয়ে গেলাম। এত অল্পসময়ের মধ্যে দুই টাকা থেকে পাঁচ টাকা দাম হয়ে গেল যা খরচের চেয়ে অনেক কম। কিন্তু ভোরবেলায় গার্মেন্টসের মেয়েদের হাতে এই কাগজ দেখছি। চট্টগ্রামের অধ্যাপকের হাতেও এই কাগজ। সম্পাদক নঈম নিজাম এবং তার সঙ্গীরা যে লড়াই শুরু করেছেন তাতে পাঁচ বছরে পা দেওয়ার আগেই তাদের কাগজ বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রচারিত কাগজের সম্মান পেয়ে গেছে। আমার এই বন্ধুদের আমি সেলাম জানাচ্ছি। এখন আমি উদগ্রীব। পাঁচ বছরে পা দেওয়ার পর এই কাগজের বৃত্ত কতটা বাড়ে তা দেখার জন্য। আমি নিশ্চিত আরও বড় চমক আমার জন্য অপেক্ষা করছে।

 

সমুদ্র হতে আর এক বছর বাকি

সাতে সমুদ্র। সাতে পা দিতে অর্থাৎ সমুদ্র হতে আর এক বছর বাকি। এক হাজার আটশ পঁচিশ দিন যে তরতর করে পার হয়ে এসেছে তার কাছে আর তিনশো পঁয়ষট্টি দিন কিছুই না। লিখলাম বটে তরতর করে পার হয়ে এসেছে  কিন্তু একটি দায়িত্বশীল খবরের কাগজ যার কাছে লক্ষ লক্ষ পাঠকের অনেক প্রত্যাশা তাকে অনেক বাধা পেরিয়ে এগোতে হয়। সেই বাধাগুলো বাংলাদেশ প্রতিদিনের সম্পাদকের নেতৃত্বে প্রতিদিন পরিবারের সদস্যদের দমিয়ে রাখতে পারেনি বলেই এই কাগজ এখন শহর থেকে প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষের কাছে এত জনপ্রিয়। কলকাতায় আছি তবু মনে হচ্ছে আমিও প্রতিদিন পরিবারের সঙ্গে মিশে আছি। জন্মদিনে আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা রইল।

 

পাতায় পাতায় সাতকাহন

সাত শব্দটির সঙ্গে বাঙালির সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। যে কখনো সমুদ্র দেখেনি সেও গান গায় ‘সাত সাগর আর তেরো নদীর পারে’। রূপকথার সাতকাহন বাড়ির ছবি না দেখেও তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। হিন্দুদের স্বর্গ কতগুলো আছে তা জানি না কিন্তু পুরাণে সপ্তপাতালের বর্ণনা সেই কৈশোরেই পড়েছিলাম। যখন মাথা কাজ করে না তখন তো অনেক চেষ্টা করেও সাতসতের ভেবে পাই না। আর এড়িয়ে যাওয়ার কৌশল না পেলে ঘাড় নেড়ে বাঙালি বলে, ‘আমি সাতেপাঁচে নেই’। সেই সাতে পা রাখল বাংলাদেশ প্রতিদিন। গ্রামে, গঞ্জে, শহরে, হাটে অথবা ইন্টারনেটে বাঙালি বাংলাদেশ প্রতিদিনে খুঁজবে নিজেদের কথা। পড়তে চাইবে বাংলাদেশের মঞ্চে অথবা আনাচে কানাচে যেসব খবর প্রতিনিয়ত তৈরি হচ্ছে। তিল তিল করেই তাল হয়। গত ছয় বছরে এই কাগজের সাংবাদিক-অসাংবাদিক বন্ধুরা এ সত্য প্রমাণ করেছেন। তাদের আন্তরিক অভিনন্দন জানাচ্ছি। নিজের লেখা একটি উপন্যাসের নাম মনে এলো। সাতকাহন! বাংলাদেশের সাতকাহন ছড়িয়ে থাকুক এই কাগজের পাতায় পাতায়।

 

আত্মীয়তার বন্ধন চিরকাল থাকবে

আরও একটা বছর বয়স বাড়ল বাংলাদেশ প্রতিদিনের। এই একটা বছর পদ্মা দিয়ে অনেক জল বয়ে গিয়েছে, প্রচুর মানুষ পৃথিবীতে এসেছে, অনেকেই চলে গিয়েছেন। সময় কারও জন্য থেমে থাকে না। প্রতিটি মুহূর্তে সে এগিয়ে যায়। আর এই এগিয়ে চলা সময়ের সঙ্গে সমাজে পাল্লা দিয়ে চলেছে আপনাদের এই প্রিয় খবরের কাগজ। একবারও পিছিয়ে পড়েনি। অথচ বয়সের বিচারে সে এখন সদ্য শৈশব পেরিয়ে আসা বালক। কৈশোরের, যৌবনের অনেক বাকি। কিন্তু কী আশ্চর্য! আশ্চর্যজনক ঘটনাটা তো পৃথিবীতে বারংবার ঘটে থাকে। বালক রবীন্দ্রনাথের কলম থেকে যে কবিতা বেরিয়েছিল তা অনেক প্রবীণ লিখতে সক্ষম হননি। এই অল্প বয়সে আমার প্রিয় সংবাদপত্র যেভাবে দেশ-বিদেশকে পাঠকের সামনে উপস্থিত করে চলেছে তা অনেক সংবাদপত্র সক্ষম হয়নি। অনেক কারণের একটা হলো, এই কাগজ এখনো অসত্যের কাছে মাথানত করেনি। এই একটা বছরে বাংলাদেশের ওপর যে ঝড় বয়ে গিয়েছে তা সঠিকভাবে পাঠকের সামনে তুলে ধরেছে এই সংবাদপত্র। বিভ্রান্ত ছেলেগুলো, যাদের মস্তিষ্ক কিনে নিয়েছিল বিদেশি চক্রান্তকারীরা, কিন্তু বাংলাদেশকে ক্ষতবিক্ষত করতে কাজে লাগাতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছিল-গত বছরে তার নিখুঁত বিবরণ আমরা পড়েছি এই কাগজের পাতায়। রেস্তোরাঁয় খেতে আসা নিরীহ মানুষগুলোকে মেরে ঘাতকদের কী লাভ হলো জানি না কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ সতর্ক হলো। শত্রু শুধু বাইরেই থাকে না, ঘরেও তারা নখ বের করে। বাংলাদেশ প্রতিদিন ধীরে ধীরে একটি বিরাট সম্ভাবনাময় প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠবে। আমি আশা করব এই কাগজ সেসব তরুণ লেখককে আবিষ্কার করবে যারা ভবিষ্যতে বাংলা সাহিত্যের হাল ধরবে। আমি আশা করব সাধারণ মানুষের সুখ, দুঃখ, অত্যাচারিত হওয়ার কাহিনী যেমন এই কাগজে লেখা হবে তেমনই অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সোচ্চার হবে। এই কাগজের সঙ্গে আমার আত্মীয়তার বন্ধন চিরকাল থাকবে। জন্মদিনের উৎসব আনন্দমুখর হোক, এই প্রার্থনা।

 

এক দৌড়ে এগারোয়

একে চন্দ্র, দুই-এ পক্ষ, তিনে নেত্র...। এইভাবে শুরু করেছিলাম বছরগোনা। শৈশবে সবাই যেমন করে থাকে। কিন্তু মুশকিল হয়েছিল ওই তিনে নেত্র মুখস্থ করার সময়। নেত্র মানে চোখ। তাহলে তিনটে চোখের কথা বলা হয়েছে কেন? আমার চারপাশের সব মানুষের এখন বাড়ির পোষা প্রাণী বা পাখিদেরও দুটো চোখ। তাহলে তৃতীয় নেত্রটি পেল কোথায়? এক সহপাঠী সেই সাড়ে তিন বছর বয়সে বুঝিয়েছিল, তৃতীয় নয়ন বা নেত্র রয়েছে কপালের ঠিক মাঝখানে, দুই ভ্রুর কাছাকাছি। সেই বয়সে অনেক চেষ্টা করেছি দেখার। আমার এক সহপাঠী তো ঘষে ঘষে কপালে ক্ষত তৈরি করে ফেলেছিল কিন্তু তৃতীয় নয়নের দর্শন পায়নি। আমাদের বাংলার স্যার বলেছিলেন, সবার তৃতীয় নয়ন তৈরি হয় না, কারও কারও হয়। সেই তৃতীয় নয়নে শুধু তারাই দেখতে পান? কী দ্যাখেন? না, যা সাধারণ চোখে দ্যাখা যায় না।

তা তো হলো। একটার পর একটা ধাপ পেরিয়ে যখন দশে এসে দশ দিক উন্মোচিত হলো তখন কপালে আঙ্গুল বুলিয়ে বুঝলাম, নেত্র জেগে ওঠেনি। দশ পেরিয়ে যখন এগারোর দিকে পা বাড়াচ্ছি তখন সকাল বেলায় কাগজওয়ালা কাগজ দিয়ে গেল তখন অলস চোখে দেখতে গিয়ে যেন মস্তিষ্কে বিদ্যুৎ জানান দিল। বাংলাদেশ প্রতিদিন সামনে মেলে ধরে আবিষ্কারের আনন্দে পুলকিত হলাম, এই তো আমার তৃতীয় নয়ন। জন্মসূত্রে যে দুই নয়নের দৃষ্টি যেখানে থমকে যায়, এই তৃতীয় নয়ন তার পরের ভুবনটাকে প্রাণভরে দেখিয়ে দিচ্ছে প্রতিটি সকালে।

হ্যাঁ, সংবাদপত্র আমাদের তৃতীয় নয়ন, যে নয়ন সুদূরপ্রসারী, যে নয়ন সময়বিশেষে অন্তর্মুখী। এক থেকে দশে গড়গড়িয়ে পৌঁছাতে যেসব বিপত্তির সামনে পড়েছিল বাংলাদেশ প্রতিদিন তা স্বচ্ছন্দে অতিক্রম করে যখন একাদশে পা দিচ্ছে তখন আর বুঝতে অসুবিধে হয় না তার শিরদাঁড়ায় জোর আছে। খবরের কাগজের শিরদাঁড়া অথবা মেরুদণ্ড কী? এক কথায় বললে বলতে হয় সংবাদ পরিবেশনে সততা বজায় রাখা। প্রতিদিন যা ঘটছে তাই পাঠকদের সামনে তুলে ধরাই হলো সৎ সংবাদপত্রের অন্যতম কাজ। সেই ঘটনাগুলো ইচ্ছেমতো কাটছাঁট করে, সামান্য রং চড়িয়ে বা কমিয়ে পরিবেশন করলে হয়তো সাময়িক সাড়া পাওয়া যায় কিন্তু বালুর ওপর তৈরি সেই অট্টালিকা ভেঙে পড়ে যে কোনো মুহূর্তে।বাস্তবের ফটোগ্রাফি আর শিল্পীর তুলির টানে আঁকা সেই বাস্তবের ছবির মধ্যে প্রচুর পার্থক্য থাকে। সঠিক বাস্তব আর কল্পিত বাস্তবের সংঘর্ষে দ্বিতীয়টির পরাজয় অবশ্যম্ভাবী।

সময় বদলাচ্ছে। কয়েক দশক ধরে বাংলা সাহিত্য থেকে সাধুভাষা বিদায় নিয়েছে বলাই সঙ্গত। এখন কেউ সাধুভাষায় আধুনিক উপন্যাস লেখেন না। পাঠকও তা পড়তে চান না।কিন্তু বিষয় যদি ঐতিহাসিক হয় তাহলে ভাষায় প্রাচীনত্ব পাঠক উপভোগ করেন। কথ্য ভাষায় সংবাদ পরিবেশন করতে করতে অনেকেই অসচেতনভাবে এমন বাক্য ব্যবহার করেন যা পাঠক তার জীবনে বাতিল করেছেন। এই শব্দগুলো খবর পড়তে গিয়ে পড়লে পাঠক হোঁচট খান বিরক্তবোধ করেন। এখনো এই দুই হাজার কুড়িতে খবরের কাগজ ওই শব্দদূষণ থেকে মুক্ত হলো না।

কিন্তু এক দুই করে দশ দিক উন্মোচিত করে দশ বছর পেরিয়ে যেতে যেতে বাংলাদেশ প্রতিদিন শুধু সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রেই নয়, সেই সংবাদ যে ভাষায় পরিবেশন করা হচ্ছে তার সম্পর্কেও যথেষ্ট সতর্ক হয়েছে। ঢাকা শহর থেকে বেরিয়ে দূরবর্তী অঞ্চলে যাওয়ার পথে চায়ের দোকানে বাংলাদেশ প্রতিদিনে মুখ ডুবিয়ে থাকা পাঠকদের প্রশ্ন করে জেনেছি, সকাল বেলায় ওই কাগজ না পড়লে দিনটা খুব খারাপভাবে তাদের কাটে। দশ বছরে পাঠকের মনে এই জায়গাটা তৈরি করে নিতে পেরেছেন প্রিয় সম্পাদক নঈম নিজাম এবং তার সহযোদ্ধারা।

মানুষ এগারোতে পা দিলে তার নাবালকত্ব দূর হয়। কিন্তু বাংলাদেশ প্রতিদিন এখন তারুণ্যে টগবগ করছে।

 

ভাসাও তরণী হে কর্ণধার

শৈশববেলা যে শেষ হচ্ছে তা বোঝার আগে পিতামহ ডেকে বলেছিলেন, ‘শোন, আজ  থেকে তুমি আর শিশু নও। তোমার বয়স এখন বারো,আজ থেকে তোমার কৈশোর শুরু হলো।এই কিশোরবেলা হচ্ছে পৃথিবীকে চোখ দিয়ে দেখার,মন দিয়ে জানার সময়।’

তখন আমার বারো বছর বয়স। যে বয়সে পা দিলে শৈশব শেষ হয়ে যায়। কৈশোর শুরু হয়ে যায়।আর কে না জানে,কৈশোর কখন তরুণ বেলায় পৌঁছে যায় বুঝতে না বুঝতে যৌবন জানান দেয়। একটু আশাবাদী গলায় বলা যায়, কিশোর মানুষের জীবনের সিংহদ্বার।

বাংলাদেশ প্রতিদিন আজ শৈশব পেরিয়ে বালক বয়স ডিঙিয়ে কৈশোরে পা দিল। এখন তার সামনে পৃথিবীর সব দরজা খুলে যাবে, নিজে যেমন আলোকিত হবে তেমনি আলোয় ভরিয়ে দেবে তার পাঠকের মনোজগতে।

সঠিক সংবাদপত্রের চরিত্র কী হবে তা নিয়ে তর্কের কোনো কারণ নেই। কিন্তু মুশকিল হলো,নানান চাপ এবং বদ্ধ ধারণার কারণে সেই চরিত্র সব সময় সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। আমি বেশ অনেকটা সময় বাংলাদেশ প্রতিদিনের সঙ্গে জড়িয়ে আছি।কখন যে ওই পরিবারের একজন হয়ে গিয়েছি তা নিজেই জানি না। কিন্তু এই সময়ে আমি কখনো কোনো মালিন্য, কোনো সমঝোতার কালো ছায়া বাংলাদেশ প্রতিদিনের মানসিকতার ওপর পড়তে দেখিনি। এটা আমাদের গর্বিত করে, সে তার মুঠোয় আকাশ ধরেছে।

বাংলাদেশ প্রতিদিন আজ বারো বছরে পা দিল, সে এখন সজীব কিশোর-তরুণ। এই সময় এবং তার আগামী দিনের যৌবনকাল একটি সৎ সাহসী সংবাদপত্রের চরিত্র বজায় রাখুক, এই প্রার্থনা করছি। সামনে শান্তির পরিবার যে সব সময় থাকবেই, এমন কথা নেই। কিন্তু হে কর্ণধার, তবু তরণী ভাসাতে হবে সততার সঙ্গে।

 

ছায়াসঙ্গী হয়ে থাকব

১২ বছরের জন্মদিনে আমার পিতামহ একটা দামি কলম উপহার দিয়ে বলেছিলেন, ‘যত্ন করে রেখ;যখনই কাউকে চিঠি লিখবে, এই কলম ব্যবহার করবে।’

পিতামহের দেওয়া কলম খুব যত্নের সঙ্গে এতকাল রেখে দিয়েছিলাম। অত্যন্ত প্রয়োজন ছাড়া ব্যবহার করিনি। বড় হওয়ার পর বিশেষ কাউকে চিঠি লিখতে গেলে অথবা চেকে সই করলে আমি সেই ১২ বছরবয়সের কলমটাই ব্যবহার করে চলেছি। ওর দিকে তাকালেই ১২ বছর বয়সটাকে অনুভব করতে পারি। বাংলাদেশ প্রতিদিনের সঙ্গে আমার সম্পর্কের বয়স অনেক বছর হয়ে গেল। একটু একটু করে একটি দৈনিক পত্রিকা জনপ্রিয় হয়ে উঠল চোখের সামনে। গত বছরগুলোতে করোনার ভয়ংকর যুদ্ধ সামলেও বাংলাদেশ প্রতিদিন পায়ের তলার মাটি শক্ত রেখেছে। এটা কম কথা নয়।আজ বাংলাদেশ প্রতিদিন এক যুগ পাড়ি দিল।সেই ১২ বছর বয়সে মানুষ শৈশব-বাল্যবেলা পেরিয়ে কৈশোরে পা দেয়, পায়ের তলায় সরষে এসে জমে। মানুষের এই বিশ্বময় ছড়িয়ে যাওয়ায় বয়সে পা দিয়েছে বাংলাদেশ প্রতিদিন। এখন এই পত্রিকা সাবালক হওয়ার পথে,অন্তত বয়সের বিচারে। আমার আন্তরিক অভিনন্দন রইল। শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করা পর্যন্ত আমি ছায়াসঙ্গী হয়ে রইলাম।

 

বাংলাদেশ প্রতিদিনের মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর সময়

সেই শৈশব থেকে বালকবেলা, সেটা পেরিয়ে কৈশোরে এসে দুই হাত বাড়িয়ে মুঠোয় আকাশ ধরার বাসনা- এই করতে করতে বাংলাদেশ প্রতিদিনের এখন মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর সময় চলে এলো। কৈশোর পেরিয়ে গেছে, আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারের মতো যৌবন এলো বলে। আজ এই চৌদ্দতম জন্মদিনে আগামীকালের পায়ের আওয়াজ কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে। বাংলাদেশের খবরের কাগজের ইতিহাসে যে কোনো সংবাদপত্রের ভূমিকা তুলে ধরবে সম্মানের সঙ্গে,মানুষের শোক-দুঃখ,আনন্দ, গৌরবের কথা বলতে পারবে বুক ফুলিয়ে, সংবাদপত্রের স্বার্থেই করে যাওয়া হয়েছে গণতন্ত্রের অন্যতম স্তম্ভ হিসেবে। সেই স্তম্ভকে আরও শক্তিশালী করার যে প্রস্তুতি তা গত তেরো বছরে নেওয়া হয়ে গেছে।এখন বাংলাদেশ প্রতিদিন শক্ত পায়ে এগিয়ে যাবে যৌবনকালের দিনগুলোয়। যে কাজ তাকে শুধু গৌরবান্বিত করবে না, আম পাঠকের শ্রদ্ধাও তার প্রাপ্য হবে।

একজন সামান্য লেখক হিসেবে বাংলাদেশ প্রতিদিনে আমাকে লেখার সুযোগ দেওয়ার জন্য আমি সম্পাদকের কাছে কৃতজ্ঞ। যে কথা বলা অত্যন্ত প্রয়োজন,কোনোবারেই লেখার আগে আমাকে বলা হয়নি, কী লিখতে হবে, কী বা লিখাই ভালো।লেখককে শ্রদ্ধা জানিয়ে যে কাগজ নিজেদের শ্রদ্ধেয় করে তোলেন তাদের অন্তত ছিয়াশি বছর ধরে আমি সঙ্গী হয়ে থাকতে চাই। ছিয়াশি বছরপর বাংলাদেশ প্রতিদিনের বয়স একশ হবে। তার ভিত তারা নিজেই তৈরি করে নিয়েছে।



এই পাতার আরো খবর