'মনে ভয় নিয়ে দিনের পর দিন বাঁচা যায় না-কি! ইউপি, এমপি-তে কী করেছে বিজেপি দেখেছেন? ওদের ঠেকানোর জন্য তাই তৃণমূল ছাড়া অন্য কাউকে ভোট দেওয়ার কথা মাথাতেই আসেনি,' হাড়োয়ার আমিনপুর চকে চায়ে চুমুক দিতে দিতে বলছিলেন ইমানুল সর্দার।
অজানা আশঙ্কায় ভুগছেন বাদুড়িয়া শেখপাড়ার নিয়ামত আলি মোল্লা। 'এখানে বিজেপি জিতে গেলে আমাদের নিশ্চয়ই অনুপ্রবেশকারী বলে খেদিয়ে দিত। গোটা মহল্লা তাই তৃণমূলকে ভোট দিয়েছে। যাক, এখানে অন্তত বিজেপি জিতে যায়নি, স্বস্তির নিশ্বাস নিয়ামতের। বসিরহাটের মুরারিশাহ চৌমাথার শেখ রাজু মণ্ডলের মনে আবার হর্ষ-বিষাদের মিশেল। বলছিলেন, 'দিল্লিটা মোদি দখল করে নিল বটে। কিন্তু আল্লাহ মেহেরবান, এখানে তৃণমূল জিতেছে। নুসরাত না-জিতলে জিনা হারাম হয়ে যেত। হয়তো গুলি করেই মারত!
এমনটাই চেহারা বসিরহাট লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত বিভিন্ন সংখ্যালঘু পাড়াগুলোয়। ভোটপ্রয়োগের ক্ষেত্রে ধর্মীয় মেরুকরণে এ বার সারা দেশই আড়াআড়ি দুইভাগ হয়েছে লোকসভা ভোটে। বাংলাও তার ব্যতিক্রম নয়। তবে মোদি-বিরোধিতার ব্যাপারে যে ভাবে প্রায় ষোলো আনা মুসলিম ভোট একাট্টা হয়েছে বসিরহাট লোকসভা কেন্দ্রে, তেমনটা আর কোথাও হয়নি বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। কিন্তু কেন এমনটা হলো?
মুর্শিদাবাদ জেলা ছাড়া দক্ষিণবঙ্গের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যালঘু অধ্যুষিত লোকসভা কেন্দ্র বসিরহাট। এখানে ৪৮% মুসলিম ভোটার। ১০ মাস আগের গোষ্ঠী সংঘর্ষের ক্ষত এখনও সেখানে দগদগে। রবিবার সেই বসিরহাট কেন্দ্রের অন্তর্গত মিনাখাঁ, হাড়োয়া, সন্দেশখালি, উত্তর ও দক্ষিণ বসিরহাট, বাদুড়িয়া এবং হিঙ্গলগঞ্জ ঘুরে স্পষ্ট, স্বাধীন ধর্মাচরণের স্বার্থে না যতটা, তার চেয়ে ঢের বেশি আর্থসামাজিক সুরক্ষার কারণেই বিজেপি-কে রুখতে হাত উপুর করে তৃণমূলকে এবার ভোট দিয়েছে বসিরহাটের সংখ্যালঘুরা।
ফলে যে বিধানসভা এলাকায় যত বেশি সংখ্যালঘু ভোটার, সেই অঞ্চলে তত বেশি লিড পেয়েছেন বসিরহাটের নতুন তৃণমূল সাংসদ নুসরাত জাহান। কোনো বিধানসভা এলাকাই তাঁকে ১৫ হাজারের কম লিড দেয়নি। আর প্রায় ৭০% মুসলিম অধ্যুষিত হাড়োয়া তাই লাখ ছুঁইছুঁই মার্জিন দিয়েছে তৃণমূলকে। ভেবিয়ার ওস্তাগর রহমত মণ্ডলের কথায়, 'বলতে পারেন, ভয়ে থেকেই ভোট দিয়েছি জোড়াফুলে। সারা দেশে বিজেপির হুঙ্কার শুনতে শুনতে আমরা সেঁধিয়ে যাচ্ছিলাম। আর বসিরহাটের বিজেপি প্রার্থী যে ভাবে গুন্ডা, দাদাদের শায়েস্তা করার নামে কেন্দ্রীয় বাহিনীকে পায়ে নয়, বুকে গুলি করার পরামর্শ দিয়েছিলেন, তাতে আরো তটস্থ হয়ে পড়েছিলাম। যাঁদের কথা উনি বলেছিলেন, তাঁরা সকলেই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের। তাই তৃণমূল ছাড়া বিকল্প ভাবিইনি।
তাঁর মূল্যায়নের সঙ্গে হুবহু মিলে যায় মালঞ্চ বাজারের ব্যবসায়ী সাজ্জাদ মোল্লার ব্যাখ্যা। আদি মিনাখাঁর বাসিন্দা সাজ্জাদের কথায়, 'বিজেপি ক্ষমতায় এলে কী কী করতে পারে, বার বার তার ফিরিস্তি শুনিয়ে গিয়েছেন দিল্লির নেতারা। প্রতিটা কথায় প্রচ্ছন্ন একটা হুমকি রয়েছে সংখ্যালঘুদের প্রতি। গত বছর অশান্তির সময়ে আমাদের কত ক্ষতি হয়েছিল, তার খবর ক'জন রাখে! তৃণমূল সরকার কিন্তু দুই সম্প্রদায়ের ক্ষতিগ্রস্তদের পাশেই দাঁড়িয়েছিল। বিজেপি হলে, তা হতো না।' হাড়োয়ার আমতাখাটরা তালবেড়িয়ার বাসিন্দা আতাউর রহমান জানাচ্ছিলেন, তাঁদের মহল্লার একটা বড় অংশে বাম ও কংগ্রেসের সমর্থনকারীরা রয়েছেন যাঁরা এ বার ভোটে বিজেপি-কে রুখতে সকলে মিলেই তৃণমূলে ভোট দিয়েছেন।
অথচ টলিউড নায়িকা যে বসিরহাটের সংখ্যালঘু ভোটারদের মনের মানুষ, তা একেবারেই নয়। অনেকেই এ নিয়ে সরাসরি নিজের মত জানানোয় অকপট। তাঁদেরই অন্যতম মৌলবী ওহিদুল হক। পাইকপাড়া মসজিদে দুপুরের নামাজ সেরে এসে লাগোয়া ছিদ্দিকিয়া এতিমখানায় বসে তিনি বলছিলেন, 'বিশ্বাস করুন, তৃণমূলকে ভোট দিতে হবে বলে কোনো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান থেকে ফতোয়া দেওয়া হয়নি এ কেন্দ্রে। হবেই বা কেন? নুসরাত জাহান তো বেশির ভাগ মুসলমানেরই ঘোর না-পসন্দ! আমার ধারণা, তা-ও যে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রায় সব মানুষ নুসরাতকেই ভোট দিয়েছে, তার কারণ প্রার্থী নয়, দল। তৃণমূলই ঠেকাতে পারে বিজেপি-কে, সেই বিশ্বাসেই ভোট দিয়েছে সকলে।'
সূত্র: এইসময়
বিডি প্রতিদিন/কালাম