ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ জুলাই, ২০২৪

আজকের পত্রিকা

নির্যাতন চলছে ঘরে বাইরে
জিন্নাতুন নূর

করোনা মহামারীর কারণে সরকার ঘোষিত যাবতীয় বিধি-নিষেধ উঠে যাওয়ায় দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও অফিস-আদালত খুলেছে। ফিরেছে স্বাভাবিক কর্মব্যস্ততা। কর্মজীবী নারী ও ছাত্রীরা ঘরের বাইরে যাচ্ছেন। করোনার বিধি-নিষেধে দীর্ঘদিন ঘরবন্দী নারীরা নির্যাতিত হয়েছেন। এবার প্রয়োজনে ঘরের বাইরে গিয়ে তারা নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। 

এই নারীদের কেউ বাড়িতে স্বামীর সঙ্গে পারিবারিক কলহের জেরে নির্যাতিত হচ্ছেন, কেউ কেউ যৌতুকের কারণে নির্যাতিত। কেউ আবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাওয়ার পথে যৌন হয়রানি বা ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পারিবারিক নির্যাতন ও নারীর প্রতি সহিংসতা আগের চেয়ে কয়েকগুণ বেড়েছে। বিশেষ করে পারিবারিক সহিংসতা চরম আকার ধারণ করেছে। 

প্রান্তিক থেকে শুরু করে প্রশাসনে সম্পৃক্ত ইউনিফরমধারী নারীরাও নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। এমন বিরূপ প্রেক্ষাপটে আজ পালিত হবে বিশ্ব নারী নির্যাতন বিলোপ দিবস। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘ওরেঞ্জ দ্য ওয়ার্ল্ড : অ্যান্ড ভায়োলেন্স এগেইনস্টন উইম্যান নাউ’।

সরকারি তথ্যেও গত অর্থবছরের তুলনায় চলতি অর্থবছরে ধর্ষণ, নারী নির্যাতন বেড়েছে বলে জানানো হয়েছে। গত ২২ নভেম্বর মন্ত্রিসভার বৈঠকে মন্ত্রণালয় ও বিভাগসমূহের ২০২০-২১ অর্থবছরের কার্যাবলি সম্পর্কিত বার্ষিক প্রতিবেদনে জানানো হয়, গত বছর ধর্ষণ মামলা ছিল ৫ হাজার ৮৪২টি। এ বছর তা বেড়ে হয়েছে ৭ হাজার ২২২টি। আর নারী নির্যাতন সংক্রান্ত মামলা গত বছর ছিল ১২ হাজার  ৬৬০টি। চলতি বছর সেটি বেড়ে হয়েছে ১৪ হাজার ৫৬৭টি।

বিশেষজ্ঞদের মতে, মহামারীর কারণে নারী নির্যাতনের ঘটনায় এক ধরনের পরিবর্তন এসেছে। করোনার আগেও নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটত। মহামারীতে অর্থনৈতিক চাপ ও নির্যাতন একসঙ্গে হওয়ায় সেটিতে ভিন্নমাত্রায় রূপ নেয়। ফলে বর্তমান সময়ে নির্যাতনের ধরন বদলে গেছে। বিদেশফেরত অনেক প্রবাসী শ্রমিক এখন এক ধরনের অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মধ্যে রয়েছেন। তারা বিভিন্ন উছিলায় স্ত্রীর ওপর নির্যাতন করছেন। আবার নারী নির্যাতন প্রতিরোধে জড়িত বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থাগুলোও মহামারীর কারণে আগের মতো সক্রিয় ভূমিকা রাখছে না। এর ফলে নারী নির্যাতনের ঘটনাও বৃদ্ধি পাচ্ছে।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্যে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ১০ মাসে দেশে ১ হাজার ১৭৮ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে সংঘবদ্ধভাবে ২২০ জনকে ধর্ষণ ও ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় ৪৩ জনকে। এ ছাড়া ২৭৬ জনকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে। ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেন চারজন। স্বামীর নির্যাতনে ১৯৭ জনের মৃত্যু হয়। ৬৩ জন নারীর মৃত্যু হয় শ্বশুরবাড়ির লোকজনের অত্যাচারে। আর নিজ পরিবারের লোকজনের অত্যাচারে ৬৬ জন নারীর মৃত্যু হয়।

এছাড়া নির্যাতনের কারণে ১২৮ জন নারী আত্মহত্যা করেন। এই ১০ মাসে যৌন হয়রানির শিকার হন ১১৬ জন। এ জন্য ১০ জন নারী আত্মহত্যা করেন। যৌন হয়রানির জন্য বাধা দেওয়ায় চারজনকে হত্যা ও যৌন হয়রানি করার পর সহিংসতায় তিনজন নারীর মৃত্যু হয়। আর এ কারণে ৬৮ জন নারী আহত হন। একই সময়ে যৌতুকের জন্য ১০১ জন নারীকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হয়। নির্যাতনের জন্য মৃত্যু হয় ৬৩ জন। আর ১২ জন আত্মহত্যা করেন।

অ্যাসিড সারভাইবারস ফাউন্ডেশনের তথ্যে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ছয় মাসে অ্যাসিড নিক্ষেপের পাঁচটি ঘটনায় ১২ জন ঝলসে যান। গত ২১ নভেম্বর রাজধানীর বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজের এক ছাত্রীর সঙ্গে বাসের এক হেলপারের হাফ ভাড়া নিয়ে তর্কাতর্কি হয়। এক পর্যায়ে অশ্রাব্য ভাষায় গালাগাল করেন। পরে সেই ছাত্রীকে ধর্ষণের হুমকি দেওয়া হয়। 

এদিকে, গত ১৯ নভেম্বর রাতে চট্টগ্রামের বায়োজিদে ধর্ষণের শিকার হন নারী পোশাক শ্রমিক। ঘটনার দিন রাতে কর্মস্থল থেকে বাসায় ফেরার পথে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে বায়োজিদের পাহাড়ে নিয়ে যাওয়া হয় ভুক্তভোগীকে। অভিযোগ পেয়ে পুলিশ কয়েক ঘণ্টা চেষ্টার পর তরুণীকে উদ্ধার করে। 

অন্যদিকে যৌতুকের কারণে সম্প্রতি স্বামীর নির্যাতনের শিকার হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন গৃহবধূ বেবী বেগম। বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলার বাকাল গ্রামের জাফর বিয়ের পর থেকে বিভিন্ন অজুহাতে বেবীকে নির্যাতন শুরু করে। এ পর্যন্ত বাবার বাড়ি থেকে দেড় লাখ টাকার বেশি যৌতুক দেওয়া হয় জাফরকে। কিন্তু একাধিক পরকীয়ায় আসক্ত জাফরের সঙ্গে ১২ নভেম্বর পারিবারিক কলহ শুরু হয়। 

একপর্যায়ে যৌতুকের জন্য বেবীকে বেধড়ক পিটিয়ে গুরুতর আহত করে। নাটোর সদর উপজেলায় গত ২১ নভেম্বর সানজিদা আক্তার বীণা নামের এক এইচএসসি পরীক্ষার্থীকে বখাটেরা অ্যাসিড নিক্ষেপ করে। গুরুতর অবস্থায় তাকে প্রথমে রাজশাহী মেডিকেল ও পরে অবস্থার অবনতি হলে ঢাকায় স্থানান্তর করা হয়।

বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস অর্গানাইজেশনের প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোকেট এলিনা খান বলেন, জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় (এসডিসি) উন্নয়ন ও নারী নির্যাতন বন্ধের বিষয়টি স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে। সরকারও মাঝেমধ্যে এ বিষয়ে অগ্রগতির কথা বলছে। কিন্তু এর সঙ্গে বাস্তবতার মিল নেই। কিছুদিন আগে এক প্রতিবেদন থেকে জানতে পেরেছি যে পুলিশের ৪০ শতাংশ নারী সদস্য যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন। 

অথচ পুলিশ প্রশাসনের যেখানে জনসাধারণকে নিরাপত্তা দেওয়ার কথা। অর্থাৎ প্রান্তিক নারী থেকে শুরু করে প্রশাসনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ইউনিফরমধারী নারীরাও এখন নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। নারীরা ঘরে-বাইরে কোথাও সমমর্যাদা পাচ্ছে না। এই বিষয়টি নিয়ে সরকারকে নতুনভাবে ভাবতে হবে। বেসরকারি সংস্থার যারা নারীর উন্নয়ন নিয়ে কাজ করছে তাদেরও এ বিষয়ে ভাবতে হবে।

বিডি প্রতিদিন/আবু জাফর



এই পাতার আরো খবর