ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৮ জুলাই, ২০২৪

আজকের পত্রিকা

আজ বিশ্ব পরিবেশ দিবস
থামছে না পরিবেশের সর্বনাশ
বছরে কাটা পড়ছে সাড়ে ১১ লাখ গাছ, প্রতি মাসে ৮৮ হাজার
শামীম আহমেদ
ফাইল ছবি

উন্নয়নের নামে গত এক বছরে সারা দেশে সাড়ে ১১ লাখ গাছ কাটা হয়েছে। এসব গাছের কোনোটির বয়স পাঁচ বছর, কোনোটির আবার ২০ বছরের বেশি। প্রতি মাসে গড়ে কাটা পড়ছে ৮৮ হাজার ১৯০টি গাছ। 

সবচেয়ে বেশি গাছ কাটার ঘটনা ঘটেছে চট্টগ্রামে। চট্টগ্রামের লোহাগাড়াতেই কেটে ফেলা হয়েছে সংরক্ষিত বনাঞ্চলের প্রায় ৫ লক্ষাধিক গাছ। মহেশখালীর প্যারাবনের ২ লাখ গাছের গোড়ায় চালানো হয়েছে কুড়াল। আর গাছ কাটায় এককভাবে এগিয়ে রয়েছে বনভূমি রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত খোদ বন বিভাগ। 

গত এক বছরে দেশের গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারের (আরডিআরসি) করা গবেষণায় এমন ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে। এদিকে বৃক্ষনিধনের 

এমন ভয়াবহ বাস্তবতাকে সামনে রেখে বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আজ দেশব্যাপী পালিত হচ্ছে বিশ্ব পরিবেশ দিবস। এ বছর পরিবেশ দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ‘করবো ভূমি পুনরুদ্ধার, রুখবো মরুময়তা, অর্জন করতে হবে মোদের খরা সহনশীলতা’। দিবসটি উপলক্ষে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। আয়োজন করা হয়েছে নানা সভা-সেমিনারের। 

বৃক্ষনিধনের এ মহোৎসবে হুমকিতে পরিবেশ। বাতাসে অক্সিজেন কমছে, বাড়ছে কার্বন-ডাই অক্সাইডসহ গ্রিনহাউস গ্যাসের প্রভাব। বাড়ছে গরম। ইতোমধ্যে পরিবেশ বিপর্যয়ের নানামুখী বিরূপ প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। 

৭৬ বছরের রেকর্ড ভেঙেছে এবারের টানা তাপপ্রবাহ। যার নেতিবাচক প্রভাব দৃশ্যমান দেশের সামগ্রিক কৃষিতেও। বোরো ধান ১৫ দিন আগেই অপরিপক্ব অবস্থায় পেকে গেছে। মারা গেছে অনেক খামারের মাছ। দিনে প্রায় ১ লাখ পোলট্র্রি মুরগির মৃত্যু হয়েছে। ৫০-৬০ লাখ ডিমের উৎপাদন কমেছে। আম ও লিচুর ফলন কমে গেছে। হিটস্ট্রোকে মারা গেছে অনেক মানুষ।

গবেষণায় এক বছরে সাড়ে ১১ লাখ গাছ কাটার তথ্য উঠে এলেও প্রকৃত চিত্র আরও ভয়াবহ দাবি করে প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ২০২৩ সালের মার্চ থেকে এ বছরের মার্চ পর্যন্ত গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরের ভিত্তিতে গবেষণা করা হয়েছে। তবে প্রকৃতপক্ষে গাছ কাটা হয়েছে অন্তত তিন গুণ বেশি। কারণ একটা বড় গাছের সঙ্গে অন্তত ২-৩টা ছোট গাছ কাটা পড়ে। এ ছাড়া গাছ কাটার সব খবর গণমাধ্যমেও আসে না। ব্যক্তিখাতে ঘরবাড়ি বানানোর সময় যেসব গাছ কাটা হয় সেগুলোও খবরে আসে না। সেটা হিসাব করলে ১০ গুণও হতে পারে। 

মঙ্গলবার (০৪ জুন) রাতে গবেষণা প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে আরডিআরসি। এতে বলা হয় গত এক বছরে বাংলাদেশে ১১ লাখ ৪৬ হাজার ৪৬৫টি গাছ কাটা হয়েছে। সবচেয়ে বেশি গাছ কাটা হয়েছে চট্টগ্রামে। সেখানে ৫ লাখ ৬ হাজার ২২২টি গাছ কাটা হয়েছে। এরপর নীলফামারীতে কাটা হয়েছে ৪ লাখ ১৫২টি গাছ। সবচেয়ে কম গাছ কাটা হয়েছে রংপুরে। 

গত এক বছরে প্রতিদিন গড়ে ২৯০২টি গাছ কাটা হয়েছে। নীলফামারীর তিস্তা সেচ প্রকল্প বৃক্ষ নিধনে একক বৃহত্তম অবদানকারী হিসেবে ৪ লাখ গাছ কেটেছে। ঢাকায় গত এক বছরে কাটা হয়েছে ১ হাজার ৮১টি গাছ। ধানমন্ডিতে সড়কের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করতে গিয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ৫০০’ গাছ কেটেছে। প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো বাড়াতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫ শতাধিক গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন কেটেছে ৩০টি গাছ। 

চট্টগ্রামের লোহাগাড়া ও মহেশখালীর সংরক্ষিত প্যারাবনে ৭ লাখের বেশি গাছ কাটা হয়েছে। এ গাছপালা কাটার পেছনে বন বিভাগসহ স্থানীয় সরকার ইনস্টিটিউট, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ, সরকারের অন্যান্য বিভাগ এবং স্থানীয় প্রভাবশালীরা দায়ী।

বৃক্ষ নিধনের এমন চিত্রকে দুঃখজনক মন্তব্য করে জলবায়ু পরিবর্তন বিশেষজ্ঞ এবং ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও বর্তমানে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ইমেরিটাস ড. আইনুন নিশাত বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বৃক্ষ নিধন পরিবেশ বিপর্যয়ের বড় কারণ। গাছ কেটে নগরায়ণে হিটআইল্যান্ড বাড়ছে। ঢাকার তাপমাত্রা আশপাশের গ্রামের তুলনায় ৩ ডিগ্রি বেশি। সড়কে লেন বাড়াতে গিয়ে দুই পাশের বহু পুরাতন গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে। ন্যূনতম বুদ্ধি খাটালে আর সদিচ্ছা থাকলে একপাশে লেন বাড়ালে আরেকপাশের গাছ বাঁচানো যায়। সিঙ্গাপুরে স্থাপনা করতে একটি গাছও কাটার সুযোগ নেই। ভারতে ১০টা গাছ লাগিয়ে তা বড় করে একটা গাছ কাটতে হয়। 

বাংলাদেশের সংবিধানের ১৮ (ক) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রের কাজ প্রকৃতি পরিবেশ ও জলাভূমি রক্ষা করা। অথচ এখানে গাছ কাটার সঙ্গে জড়িত স্বয়ং প্রশাসন, রাজনীতিবিদ, জনপ্রতিনিধিরা। তথাকথিত উন্নয়নের নামে প্রকৃতির সর্বনাশ করছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫০০ গাছ কাটা হয়েছে। স্থপতি চাইলে ৩০০ গাছ রেখেও কাজটি করতে পারতেন। 

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আমিনুর রসুল বলেন, রক্ষক যখন ভক্ষক হয়, তখন আর কিছুই টিকে থাকে না। আরডিআরসির প্রতিবেদনের ভিত্তিতে গাছ কাটায় দায়ীদের শ্বেতপত্র প্রকাশ করে অভিযুক্তদের আইনের আওতায় আনা উচিত।

বিডি-প্রতিদিন/আব্দুল্লাহ



এই পাতার আরো খবর