ঢাকা, রবিবার, ২৮ জুলাই, ২০২৪

আজকের পত্রিকা

পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের বিবৃতি দুর্নীতিবাজদের উৎসাহিত করবে: পেশাজীবী পরিষদ
নিজস্ব প্রতিবেদক

সাংবাদিকতা নিয়ে পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের বিবৃতিতে গভীর উদ্বেগ ও প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশ সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদ (বিএসপিপি)। অ্যাসোসিয়েশনটির বক্তব্য স্বাধীন গণমাধ্যম ও নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার উপর প্রচ্ছন্ন হুমকি এবং দুর্নীতিবাজদের সুরক্ষা দেয়ার চেষ্টা বলে মনে করে বিএসপিপি। 

পেশাজীবীদের শীর্ষ এই সংগঠনের নেতারা বলেন, কেবলমাত্র পুলিশী রাষ্ট্রেই সাংবাদিকদের এমন হুমকি দিতে দেখা যায়। এ কথা বলতে আজ দ্বিধা নেই যে, পুলিশের উপর ভর করে বার বার রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের কারণে পুলিশের ঔদ্ধত্য এতোই বেড়েছে যে, তারা আজ ধরাকে সরা জ্ঞান করছে। সাংবাদিকদের হুমকি দিয়ে পুলিশ অ্যাসোসিয়েশনের বিবৃতি এটাই প্রমাণ করে- "দেশ ক্রমেই পুলিশী রাষ্ট্রের দিকে ধাবিত হচ্ছে"। তারা অবিলম্বে এই বিবৃতি প্রত্যাহারের দাবি জানান।

আজ সোমবার বিএসপিপির আহ্বায়ক প্রফেসর ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন ও সদস্য সচিব সাংবাদিক কাদের গনি চৌধুরী সই করা এক বিবৃতিতে এই উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়।

বিএসপিপির বিবৃতিতে বলা হয়, পুলিশের কয়েকজন সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অবৈধভাবে সম্পদ গড়ার পরপর কয়েকটি সংবাদ প্রকাশে ক্ষুব্ধ হয় পুলিশ ক্যাডার সার্ভিসের সংগঠন বাংলাদেশ পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন। তারা গণমাধ্যমকে 'সতর্ক' করে যে বিবৃতি দিয়েছে, সেখানে সাংবাদিকদের জন্য প্রচ্ছন্ন হুমকিও রয়েছে। যা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের সম্পূর্ণ এখতিয়ার বহির্ভূত। 

পুলিশের সাবেক ও বর্তমান সদস্যদের নিয়ে গণমাধ্যমে 'অতিরঞ্জিত' ও 'নেতিবাচক' সংবাদ প্রকাশ করা হচ্ছে দাবি করে সংগঠনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, 'কিছু মিডিয়া হাউজ ব্যক্তিগত আক্রোশ ও নিজস্ব স্বার্থ রক্ষায় কোনো কোনো পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অবমাননাকর নেতিবাচক সংবাদ প্রকাশ ও প্রচার করছে- যার মধ্য দিয়ে 'পুলিশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে'।

আমাদের জিজ্ঞাসা, কোনো একটি বাহিনী বা প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করলে সেটি কীভাবে ওই প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি নষ্ট করে? তার মানে এই নয় কি, তারা দুর্নীতি করেই যাবে গণমাধ্যম কিছুই লিখতে পারবে না! আমরা তাদের কাছে জানতে চাই, 'ব্যক্তির অপরাধের দায় কি বাহিনী বা প্রতিষ্ঠানের'? আর এভাবে বিবৃতি দেয়া দুর্নীতিবাজদের পক্ষে সাফাই গাওয়া নয় কি? এই বিবৃতি কি গোটা পুলিশ বাহিনীকে কলঙ্কিত করেনি?

আমরা আরও অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করলাম, পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের এই বিবৃতির একদিন পরই গণমাধ্যমে যাতে পুলিশের খবর প্রকাশের বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বন করে, সে বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দিয়েছে খোদ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়! চিঠিতে বলা হয়েছে, 'পুলিশ বাহিনীর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয় এ ধরনের খবর প্রকাশের ক্ষেত্রে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াসমূহের অধিকতর সতর্কতা অবলম্বনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।'  স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের এমন নির্দেশনা দেখে মনে হচ্ছে, দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে রিপোর্ট করে গণমাধ্যম মহাঅপরাধ করে ফেলেছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এমন চিঠি এটাই প্রমাণ করে "রাষ্ট্র দুর্নীতিবাজদের আশ্রয় ও প্রশ্রয় দিতে যাচ্ছে"?

বিবৃতিতে বলা হয়, আমরা পত্রিকায় আরও একটি খবর দেখলাম, পুলিশের কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এলে তা তদন্তের জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা সদর দপ্তরের অনুমতি নেওয়ার বিধান চান পুলিশ কর্মকর্তারা। শিগগিরই সরকারের কাছে প্রস্তাব আকারে পুলিশ এই দাবি জানাবে বলে একটি পত্রিকার খবর বের হয়েছে। আমরা মনে করি এই ধরনের উদ্যোগ দুর্নীতিকে আরও বেশি উৎসাহিত করবে। দুর্নীতিবাজরা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠবে। মোর্দ্দা কথা দুর্নীতিকে রাষ্ট্রীয়ভাবে অনুমোদন দেয়া হবে। যা একটি জাতিকে ধবংস করার প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়াবে।

সরকার ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণায়ের কাছে আমাদের জিজ্ঞাস্য পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের অ্যাসোসিয়েশন যে বিবৃতি দিয়েছে, একইভাবে যদি অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের সংগঠন থেকেও দাবি উঠে যে, তাদের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এলে তা তদন্তের জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা সদর দপ্তরের অনুমতি নিতে হবে! আর তাদের আবদার রক্ষার্থে এটি কার্যকর হলে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা বলে কি আর কিছু অবশিষ্ট থাকবে? দেশ কি দুর্নীতিতে প্লাবিত হবে না? 

এটা অস্বীকার করার সুযোগ নেই যে, পুলিশের মধ্যে অনেক ভালো লোকও আছেন। তবে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো সদস্য যখন মাজারের টাকা আত্মসাৎ করে, গাড়ি থামিয়ে সোনা লুট, ব্যবসায়ীকে অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়, ব্যাংক থেকে টাকা তুলে ব্যবসায়িক প্রতষ্ঠানে যাওয়ার সময় টাকা ছিনতাই বা কাউকে বিনা বিচারে ক্রসফায়ারে হত্যা করে অথবা নারায়ণগঞ্জে সেভেন মার্ডারে জড়িত থাকে, তখন নাগরিক সমাজ এসব ঘটনার ব্যাপক নিন্দা না করে যেমন পারে না; গণমাধ্যমও প্রচার না করে পারে না। এ সমালোচনা ও নিন্দা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সংশ্লিষ্ট সদস্যদের প্রাপ্য।

ক্ষমতার অপব্যবহার করে বিপুল বিত্তবৈভবের মালিক হওয়ার বিষয়টি নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে প্রথম বিতর্কিত হন পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদ- যার সম্পদের পরিমাণও বিস্ময়কর। সম্পদ অর্জনে তিনি যে নজির স্থাপন করেছেন, সেটি শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বের জন্যই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতির একটি বড় উদাহরণ বললেও অত্যুক্তি হবে না। এই বিপুল সম্পদ তিনি যে বৈধ আয় দিয়ে গড়ে তুলেছেন, সেটি বিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই। তা হলে বেনজীরের নজিরবিহীন দুর্নীতি নিয়ে লেখার কারণে পুলিশ বাহিনীকে ক্ষুব্দ হতে হবে কেন? 

সম্প্রতি সংবাদ শিরোনাম হয়েছেন পুলিশের বরিশাল রেঞ্জের ডিআইজি জামিল হাসানও। একটি জাতীয় দৈনিকের সংবাদ শিরোনাম: 'ডিআইজি জামিল হাসান যেন আরেক ভূস্বামী।' ডিএমপির সাবেক কমিশনার মো. আছাদুজ্জামানের বিপুল সম্পত্তি অর্জনের খবরও গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছে। শিরোনাম হয়েছেন চট্টগ্রাম নগর পুলিশের সাবেক ট্রাফিক পুলিশ পরিদর্শক আবুল কাশেম চৌধুরী ও তার স্ত্রী ফাতেমা বেগম। তারা তিন কোটি টাকার সম্পদ আয় বহির্ভূতভাবে অর্জন  করেছেন।

পুলিশের কনস্টেবল পদে নিয়োগে দেড় কোটি টাকার ঘুষ লেনদেনসহ দুর্নীতিতে জড়িয়েছেন বাংলাদেশ পুলিশের রংপুর রেঞ্জ ডিআইজি কার্যালয়ের পুলিশ সুপার সুব্রত কুমার হালদারসহ ৫ জন। তাদের বিরুদ্ধে চার্জশিট অনুমোদন দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ওসি প্রদীপের দুর্নীতি ও নৃশংসতার কাহিনি জাতি এখনো ভুলেনি।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) ‘সেবা খাতে দুর্নীতি : জাতীয় খানা জরিপে বার বার দুর্নীতিতে শীর্ষে রয়েছে পুলিশ। টিআইবির প্রতিবেদনে দেখা যায়, পুলিশের কাছে সেবা নিতে গিয়ে ৭২.৫ শতাংশ খানা দুর্নীতি-অনিয়মের অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছে। বছরে টাকার অঙ্কে, যা ২ হাজার ১০০ কোটি টাকারও বেশি।

পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, গ্রেফতার, ট্রাফিক সংক্রান্ত বিষয়, পাসপোর্টের পুলিশ ভেরিফিকেশন, মামলা দায়ের, চার্জশিট এমনকি জিডি করতে গিয়েও ৭০ শতাংশেরও বেশি মানুষ খানা দুর্নীতির শিকার হয়েছেন।

জরিপে দেখা যায়, সবেচেয়ে বেশি দুর্নীতি হয় চার্জশীট সংক্রান্ত বিষয়ে। টাকার অঙ্কে, যা গড়ে ২১ হাজার টাকারও বেশি। হাইওয়ে পুলিশ, স্পেশাল ব্রাঞ্চ, থানা পুলিশসহ সব সংস্থাতেই কমবেশি দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে টিআইবির ওই জরিপে। এটি পুলিশ বাহিনীকে লজ্জিত না করলেও আমরা লজ্জা পাই।

বিবৃতিতে বলা হয়, পুলিশ প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী ও জনগণের সেবক। কিন্তু এখন তারা সেটি ভুলে গেছে। পুলিশের কাজ হচ্ছে 'দুষ্টের দমন, শিষ্টের পালন’। রাষ্ট্রের সফলতার অন্যতম নিয়ামক হলো দুষ্টকে দমন করে শিষ্টকে পালন করে রাষ্ট্রের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা এবং সমৃদ্ধ করা। উন্নত বিশ্বে এই নীতি এখনো চর্চায় থাকলেও বাংলাদেশে এই নীতিকথার চর্চা তো হচ্ছেই না বরং হচ্ছে তার উল্টো।' 

দুষ্টের পালন, শিষ্টের দমন' নীতির কারণে দুষ্টরা একটি অপরাধ করে পার পেলে দ্বিতীয় অপরাধ করতে কুণ্ঠাবোধ করছে না। দুষ্টের লালন করে আজ দুর্নীতিবাজ অফিসাররা বিস্তর অর্থ -সম্পদের মালিক বনে যাচ্ছেন। এভাবে ব্যক্তি নানা অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়ছে এবং নানা অপরাধ চক্র গড়ে উঠছে।অপরাধী বেপরোয়া হয়ে ওঠার পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ পুলিশের নির্লিপ্ততা ও প্রভাবশালীদের আশ্রয়-প্রশ্রয়। আর এসব হচ্ছে দেশে গণতন্ত্র না থাকার কারণে। 

আমরা পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের সাংবাদিকদের পেছনে না লেগে, সর্বোচ্চ পেশাদারিত্ব বজায় রেখে দেশ রক্ষার কাজে ছড়িয়ে পড়ার আহ্বান জানাচ্ছি।



এই পাতার আরো খবর