ঢাকা, মঙ্গলবার, ১২ নভেম্বর, ২০২৪

আজকের পত্রিকা

মমতা গণতন্ত্র শব্দটির অর্থ জানেন না
কলকাতার চিঠি
নিজস্ব প্রতিবেদক

গত সাড়ে চার বছরে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর আমলে যে চারটি নির্বাচন হয়েছে, চারটিতেই ব্যালট নয়, বুলেটের যুদ্ধ হয়েছে। অঙ্গরাজ্যের ভোটাররা ভোট দিতে গিয়ে তৃণমূলের বুলেটের মুখোমুখি হয়েছেন। বুলেট-যুদ্ধই যে হবে তা নির্বাচনের আগেই বিরোধীরা এককাট্টা হয়ে বলেছিলেন। তাদের অভিযোগ শতকরা একশভাগই মিলে গেল। ভোর ৭টার আগে পোলিং বুথ খোলার আগেই যৌথভাবে তৃণমূলের গুণ্ডাবাহিনী ও পুলিশ ভোটারদের ভোটকেন্দ্রের আশপাশে যেতে দেয়নি। বাংলার মানুষ এসবই টিভিতে দেখেছেন।

ক্ষুব্ধ-উত্তেজিত বাংলার সুশীল সমাজ ইতিমধ্যেই এর প্রতিবাদ করতে রাস্তায় নেমে পড়েছেন। জেলায় জেলায় আন্দোলন শুরু হয়েছে। নেতৃত্বে আছেন সুপ্রিমকোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি অশোক গাঙ্গুলী, হাইকোর্টের বেশ কিছু আইনজীবী, ত্রিপুরার প্রাক্তন অ্যাডভোকেট জেনারেল বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য প্রমুখ। আগামী বছর মে মাসে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার নির্বাচন হওয়ার কথা। বিরোধীদের অভিযোগ, ইতিমধ্যেই মমতা তার মাস্তান বাহিনী ও পুলিশকে নিয়ে দল বানিয়ে ফেলেছেন যারা ওই নির্বাচনেও সন্ত্রাস করে ভোট লুট করবে।

যত বোমা-পিস্তল গত সাড়ে চার বছরে মজুদ হয়েছে তা সবই সরকারের মদদে। ইতিমধ্যে সদ্য সমাপ্ত বুলেট পর্বের বিচার চেয়ে কলকাতা হাইকোর্টে একটি মামলাও দায়ের হয়েছে। এ ধরনের ঘটনা যে ঘটবে তা আঁচ করে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল, কেশরীনাথ ত্রিপাঠী, সবকটি বিরোধী দল এমনকি নির্বাচন কমিশনারও ভারত সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংকে অনুরোধ করেছিলেন বিশেষ বাহিনী পাঠিয়ে ভোট করাতে। রাজনাথ সিং রাজ্য বিজেপিকে জানিয়েছিলেন, কেন্দ্রীয় বাহিনী ভোটের ৭২ ঘণ্টা আগে আসবে। কিন্তু তারই মধ্যে মমতা দিল্লি গিয়ে নরেন্দ্র মোদিকে ওই বাহিনী পাঠাতে নিষেধ করেন। তার দাবি মেনে নিয়ে শেষ পর্যন্ত কেন্দ্রীয় বাহিনী পাঠায়নি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ফলে কার্যত বিনাবাধায় তৃণমূল ভোট লুট করে গেছে।

’৪৭ সালে দেশ স্বাধীন। ’৫০ সালে ভারতের সংবিধান মোতাবেক প্রতি পাঁচ বছর অন্তর লোকসভা এবং রাজ্যের বিধানসভাগুলোতে নির্বাচন হওয়ার কথা। বস্তুত, মমতার আমলে যে চারটি নির্বাচন হয়ে গেছে তাকে গণতান্ত্রিক নির্বাচন বলা যাবে না। কারণ মমতা নিজেই গণতন্ত্র শব্দটির অর্থ জানেন না। কোনো কোনো ভোটকেন্দ্রে মাস্তানদের মধ্যেও গোলমাল লেগে যায়। পুরুষ এবং মহিলা ভাড়াটে ভোটারদের মধ্যে খণ্ডযুদ্ধের খবরও এসেছে কোনো কোনো বুথ থেকে।

প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে পেশাগত কারণে পৃথিবীর অন্তত ১০-১২টি গণতান্ত্রিক দেশের নির্বাচন আমি কভার করেছি। কিন্তু এবার যে দৃশ্য দেখেছি তা বিশ্বের কোনো দেশে কোনো নির্বাচনে দেখিনি। বিশিষ্ট লোকরা বলছেন, পশ্চিমবঙ্গের গণতন্ত্রকে বঙ্গেশ্বরী মমতা টুঁটি চেপে মেরে ফেলেছেন। ভবিষ্যতে লোক ভোট দিতে যাবে কিনা, তা নিয়ে বিভিন্ন সেমিনারে আলোচনা শুরু হয়েছে। নরেন্দ্র মোদিও এখন মমতার সঙ্গে আঁতাত করে সংবিধান প্রদত্ত মানুষের ভোটাধিকার খর্ব করছেন। ভারতের গণতন্ত্র দিনে দিনে কলঙ্কিত হচ্ছে। বিরোধীরা দাবি করেছেন, জনগণ এবার ভোট না দিতে পেরে ভবিষ্যতে মমতার অধীনে কোনো নির্বাচন হলে হয় তারা মোকাবিলা করবেন, আর না হয় ভোট দিতেই যাবেন না। এর প্রমাণ মিলেছে দ্বিতীয় দফার ভোটে। সন্ত্রাসের জেরে কয়েকটি বুথে ভোট বাতিল হয়ে গিয়েছিল। সেই বুথগুলোতে পুনর্নির্বাচনের সময় প্রায় ৮০ শতাংশ ভোটারই ভোট দিতে যাননি।

ত্রিস্তরীয় যে পঞ্চায়েত ভোট হয়, তা আটের দশকে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী প্রয়াত রাজীব গান্ধী সারা দেশে চালু করেছিলেন।  তার আগে ’৭৮ সালে পশ্চিমবঙ্গে তা চালু করেছিলেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী প্রয়াত জ্যাতি বসু। এবার বিরোধীরা স্লোগান দিয়েছিল- নিজের ভোট নিজে দেবেন। কিন্তু হায় কপাল।  মমতার সমাজবিরোধীদের দাপটে সে ভোট কার্যত প্রহসনে পরিণত হয়।

লেখক : ভারতীয় প্রবীণ সাংবাদিক।  

 

 

 



এই পাতার আরো খবর