প্রতিবার মুক্তচিন্তার মানুষকে হত্যা বা মুক্তচিন্তার ওপর হামলার ঘটনা ঘটলে আমি ভয়ে কেঁপে উঠি। বাংলা একাডেমির সামনে, টিএসসির সামনে, বাসার সামনে, বাসার ভিতরে, অফিসের ভিতরে ঢুকে কুপিয়ে খুন করে নির্বিঘ্ন চলে গিয়ে হামলাকারীরা বারবার বুঝিয়ে দিয়েছে; তাদের হাত কতটা লম্বা, আর আমরা কতটা নিরাপত্তাহীন পরিবেশে বাস করি। মুক্তচিন্তার ওপর হামলা শুরুর পর আমরা যারা টুকটাক লেখালেখি করি, তারা সবাই একটু সতর্ক থাকি। একজন আরেকজনকে সাবধান করি, একা চলাফেরা করবেন না। কিন্তু শনিবার দুপুরে লালমাটিয়ায় ‘শুদ্ধস্বর’-এর চারতলার অফিসে ঢুকে তিনজন মুক্তচিন্তার মানুষকে একসঙ্গে কুপিয়ে জখম করে তারা যখন চলে গেল, যেন বলে গেল, সাবধানে থেকে বা দল বেঁধে থেকেও লাভ হবে না। টুটুলদের ওপর হামলার পর থেকে সেই ভয়টা আবার কাঁপিয়ে দিচ্ছিল আমাকে, আমাদের। কিন্তু সন্ধ্যায় যখন শুনলাম টুটুলদের ওপর হামলার সময়ই আরেকটি টিম শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেটের তিনতলায় জাগৃতি প্রকাশনীর ফয়সাল আরেফিন দীপনের গলা কেটে অফিস বাইরে থেকে তালা মেরে নিরাপদে চলে গেছে, তখন আমার নিরাপত্তা বোধের ভিতটাই নড়ে গেছে। সাধারণ ভয় নয়, ভয়ঙ্কর একটা আতঙ্ক আমাকে গ্রাস করছে। জঙ্গিরা রীতিমতো তালিকা করে, ঘোষণা দিয়ে মুক্তচিন্তার মানুষদের বাসায়-অফিসে ঢুকে খুন করছে। তারা এতটাই বেপরোয়া যে, তালিকার বাইরের কারও ওপর হামলা করে বিভ্রান্ত বা ক্যামেফ্লেজ তৈরিরও কোনো চেষ্টা করছে না। নিজেদের আড়াল করারও কোনো চেষ্টা করছে না। তারা তাদের লক্ষ্যে অবিচল। বরং তাদের প্রতিটি অপারেশন আগেরটার চেয়ে নিখুঁত, ঘাতকরা কাজ সারছে নিপুণ দক্ষতায়।
নব্বই দশকের শুরুর দিকে যাত্রা শুরু আজিজ সুপার মার্কেটের। শুরু থেকেই এটি হয়ে ওঠে বাংলাদেশের মুক্তচিন্তার সৃজনশীল মানুষের প্রাণকেন্দ্র। ইদানীং বইয়ের দোকান কমে টি-শার্টের দোকান বেড়ে গেছে বটে, তবে এখনো মুক্তচিন্তার প্রগতিশীল মানুষের অনেকেরই বিকাল কাটে আজিজে। নব্বই দশকের শুরু থেকে অনেক বছর বিকালে আজিজে না গেলে রাতে ভালো ঘুম হতো না। আমি জানি এখনো অনেকের এই রোগ আছে। আজিজ সুপার মার্কেট নিছক একটি বাণিজ্যিক মার্কেট নয়। আজিজ সুপার মার্কেট একটি নিশ্চিন্তি, একটি আশ্রয়। আজিজ সুপার মার্কেটের ফুটপাথে বসে কত স্বপ্ন ডানা মেলে; কত গান, কত কবিতা, কত গল্প, কত সিনেমার ভ্রমণের গল্প আজিজ সুপার মার্কেটের দেয়ালে দেয়ালে। সেই আজিজ সুপার মার্কেটের তিনতলার অফিসও যখন নিরাপদ নয়, তখন আর কোথায় নিরাপত্তা খুঁজব আমরা? আতঙ্ক এতটাই ভয়ঙ্কর যে, আজিজ মার্কেটের গোড়াপত্তনকারী এক প্রকাশক এ বিষয়ে ক্যামেরার সামনে কিছু বলতেই রাজি হলেন না ভয়ে। প্রথমে তার আচরণে বিরক্ত হলেও পরে বুঝেছি, জানের মায়া তো তারও আছে।
বাংলাদেশে ইদানীং বারবার মুক্তচিন্তার মানুষের ওপর ইসলামের নামে হামলা হচ্ছে। কিন্তু ইসলামের কোথাও তো ভিন্নমতের ওপর হামলার কথা লেখা নেই। বরং ইসলামে তো পরমতসহিষ্ণুতার কথা বলা আছে। আমি একটু মুখ্যু-সুখ্যু মানুষ। ব্লগের জগতে আমার বিচরণ নেই। ব্লগারদের সেভাবে আমি চিনিও না। যে কয়জন ব্লগার মারা গেছেন, মৃত্যুর আগে তাদের কাউকে আমি চিনতাম না। তাদের কারও লেখাও পড়িনি। মৃত্যুর পর দুয়েকজনের কিছু লেখা পড়েছি। তাদের অনেক লেখার সঙ্গে আমি একমত নই। কিন্তু তাদের ওপর হামলা চালাতে হবে কেন, এটা আমার মাথায় ঢোকে না। আমি বিশ্বাস করি মতের পাল্টা ভিন্নমত, যুক্তির পাল্টা যুক্তি। কিন্তু কলমের জবাব যখন চাপাতি দিয়ে দেবেন, যখন আপনি হামলা করে ভিন্নমতকে দমন করতে চাইবেন, তখন বুঝতে হবে আপনার যুক্তি ফুরিয়ে গেছে। মুক্তমনা ব্লগারদের কোনো লেখা আপনার পছন্দ না হলে আপনি তার পাল্টা একটা লেখা লেখেন। বাঁশের কেল্লা ব্লগের কোনো লেখা তো আমার কখনো পছন্দ হয় না। বাঁশের কেল্লার তো জš§ই হয়েছে প্রগতিশীল মানুষদের ওপর সাইবার আক্রমণের জন্য। কই কখনো তো বাঁশের কেল্লার কারও ওপর তো কেউ হামলা চালায়নি। মক্কায় এক বুড়ি প্রতিদিন ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর চলার পথে কাঁটা বিছিয়ে রাখতেন। একদিন মুহাম্মদ (সা.) দেখলেন, তার চলার পথে কোনো কাঁটা নেই। তিনি খুঁজে খুঁজে বুড়ির বাড়ি গেলেন, জানতে চাইলেন, বুড়ি অসুস্থ কিনা। এই হলো ইসলাম। আর আজ ইসলামের নামে চলে পরমত দমন, সন্ত্রাস, হিংস্রতা। ইসলাম অন্য ধর্ম পালনে বাধা দেয় না। ধর্ম মানে বিশ্বাস। যে যার বিশ্বাস নিয়ে থাকুক না। নাস্তিক হওয়া কোনো অপরাধ নয়, এটা তার বিশ্বাস। কিন্তু আইন হাতে তুলে নিয়ে নাস্তিককে হত্যা করা অপরাধ।
কয়েক দিন আগে সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামের এক অনুষ্ঠানে সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক বলেছেন, বাংলাদেশ সবার জন্য। সবার কথাই আমাদের শুনতে হবে। সবাই যে যার ধর্ম পালন করতে পারে। এমনকি যে ধর্ম মানে না, দেশটি তারও। আল্লাহ কিন্তু তাকেও খাওয়াচ্ছেন, পরাচ্ছেন, প্রতিপালন করছেন, সে কথাগুলো আমাদের মনে রাখতে হবে। এটাই আমাদের বাংলাদেশ। একটি অসাম্প্রদায়িক, উদার, মুক্তচিন্তার, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের স্বপ্ন নিয়েই একাত্তরে স্বাধীন হয়েছে বাংলাদেশ। কিন্তু যত দিন যাচ্ছে, ততই ধূসর হয়ে যাচ্ছে স্বপ্ন, পরিণত হচ্ছে দুঃস্বপ্নে। বাংলাদেশে এখন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি ক্ষমতায়। কিন্তু তারপরও একের পর এক হামলার ঘটনা ঘটছে। একের পর এক খুন হচ্ছে। সরকারকে খুব অসহায় মনে হচ্ছে। আমি বিশ্বাস করি সরকারও খুব আন্তরিকভাবে খুনিদের ধরতে চাইছে। কিন্তু পারছে না। এখন পর্যন্ত ব্লগার খুনের কোনো ঘটনারই রহস্য উম্মোচিত হয়নি। যেন মৌলবাদী জঙ্গিরা খুন করে হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। আমাদের র্যাব-পুলিশ-গোয়েন্দারা কী করছে? অপরাধীদের ধরতে না পেরে সরকারের কেউ কেউ ঠারেঠুরে মত প্রকাশের ব্যাপারে সংযত থাকার পরামর্শ দিচ্ছেন। আইসিটি আইনে ৫৭ ধারায় মত প্রকাশের গলাটিপে ধরতে চাইছেন।
সাম্প্রতিক সময়ে সব স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীই একটা না একটা ঐতিহাসিক বাণী দিয়েছেন। প্রেসক্লাবে সাংবাদিকদের ওপর পুলিশের হামলার পর বিএনপির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মতিন চৌধুরী বলেছিলেন, অন্ধকারে পুলিশ দেখতে পায়নি। আলতাফ হোসেন চৌধুরীর ‘আল্লার মাল আল্লায় নিয়ে গেছে’ তো বাণী চিরন্তনীতে ঠাঁই পেয়েছে। লুৎফুজ্জামান বাবরের ‘লুকিং ফর শত্র“জ’ এখনো মানুষের মন ভালো করে দেয়। অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন ঈদে বাড়ি যাওয়ার সময় তালা দিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়ে ইতিহাসে ঠাঁই পেয়েছেন। আর ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর তো সাভারের রানা প্লাজা ধ্বংসের পর বিএনপির নাড়াচাড়া তত্ত¡ দিয়ে আরেকটি ‘ডক্টরেট’ পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করে ফেলেছেন। বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বোধহয় তার সেই ঐতিহাসিক বাণীটি দিয়ে দিয়েছেন। এক প্রকাশক খুন এবং আরও তিনজন আহত হওয়ার পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দাবি করলেন, এসবই বিচ্ছিন্ন ঘটনা। দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো।
আমি আগেও অনেকবার বলেছি, জঙ্গিবাদ দমন শুধু পুলিশের কাজ নয়। বাংলাদেশে নজরদারির বাইরে হাজার হাজার মাদ্রাসা রেখে জঙ্গিবাদ দমন করা যাবে না। একটা ছেলে যখন জানে নাস্তিক কাউকে খুন করতে পারলেই তার বেহেশত নিশ্চিত, তখন থানা-পুলিশ দিয়ে তাকে ঠেকিয়ে রাখা যাবে না। আগে গোড়ায় পরিচর্যা করতে হবে। গোড়া কেটে আগায় পানি ঢাললে লাভ হবে না। মৌলবাদীরা যাতে আমাদের সন্তানদের বিভ্রান্ত করতে না পারে, ভুল বোঝাতে না পারে; সেটা খেয়াল রাখতে হবে আগে।
প্রতিদিন সকালে আমি ফেসবুকে কোনো একটা ফুলের ছবি দিয়ে সবাইকে শুভ সকাল জানাই। কিন্তু আজ সকালে ফুলের ছবি দিতে মন সায় দিচ্ছিল না। বারবার মনে পড়ছিল সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতা ‘প্রিয় ফুল খেলার দিন নয় অদ্য, ধ্বংসের মুখোমুখি আমরা...’। সত্যি আমাদের সব অগ্রগতি, উন্নয়ন, প্রগতি ধ্বংস হয়ে যাবে; যদি এ ভয়ঙ্কর দানবদের নির্মূল করা না যায়। আফজাল হোসেনের আজ সকালে লেখা একটি কবিতায় ফুটে উঠেছে এখনকার বাংলাদেশের সত্যিকারের চিত্র। তার কবিতাটি পড়ে মন খারাপ হয়ে যায়। আবারও ভাবি আফজাল হোসেন পেশাদার বিজ্ঞাপনচিত্র নির্মাতা হলেও তিনি হতে পারতেন পেশাদার অভিনেতা, পেশাদার লেখক, চিত্রশিল্পী, এমনকি কবিও। অন্ধকার বিষয়ক কবিতায় তিনি লিখেছেন ‘সূর্য উঠেছে তবুও অন্ধকার’।
লেখক : সাংবাদিক।