টাঙ্গাইল-৪ (কালিহাতি) উপনির্বাচনে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর নির্বাচনের প্রার্থিতা ব্যাংকের ঋণখেলাপির জন্য নির্বাচন কমিশন বাতিল করে দিয়েছিল। উচ্চতর আদালতে মামলা করে তিনি নির্বাচন করার সুযোগ পেলেন। তবে ঋণখেলাপিদের নির্বাচনে অযোগ্য করা একটি ভালো বিধান বলে আমি মনে করি। আমি নিজেও ঋণখেলাপি হওয়ার কারণে ২০০৮ সাল থেকে নির্বাচন করতে পারছি না তবু আমি আইনটির পক্ষে। একজন ঋণখেলাপি মানে যিনি তার অঙ্গীকার রক্ষা করতে পারেননি এবং সেই অঙ্গীকার রক্ষা করতে না পারার যতই যুক্তিপূর্ণ কারণ থাকুক না কেন তারপরেও অঙ্গীকার ভঙ্গকারীকে জনপ্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ দেওয়া যায় না। এটি নৈতিকতা ও দায়িত্বশীলতার প্রশ্ন। এখানে আপস করলে রাষ্ট্রের ভিত্তি দুর্বল হয়ে যাবে। তবে ঋণ গ্রহীতাকে শুধু একা শাস্তি দিয়ে রাষ্ট্র ও সমাজ তার দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে পারে না।
একদিক দিয়ে রাষ্ট্র ঋণখেলাপি গ্রহীতাকে শাস্তি দেবে অন্যদিকে ঋণ আদায় করার যে সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষকে সেরা কর্তৃপক্ষ বলে রাষ্ট্র মাথায় তুলে নাচবে তা কখনোই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। ঋণখেলাপির জন্য শুধু ঋণ গ্রহীতাই এককভাবে দায়ী তা হতে পারে না। ঋণখেলাপির জন্য ঋণদাতা ব্যাংক ও তাদের তদারকি কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশ ব্যাংকও সমভাবে দায়ী। বাংলাদেশ ব্যাংকের কার্যাবলিতে দেখা যায় বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি অন্যতম কাজ ‘Other functions include credit control’ অর্থাৎ ঋণ নিয়ন্ত্রণ করা। তাহলে বলা যায় ঋণখেলাপির জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের ঋণ নিয়ন্ত্রণ নীতিমালায় যথেষ্ট ফাঁকফোকর রয়েছে যার জন্য দিন দিন খেলাপি ঋণের মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। ঋণখেলাপির একটি অন্যতম ত্রুটিপূর্ণ ঋণ অনুমোদন প্রক্রিয়া এবং সেই প্রক্রিয়ায় সিদ্ধান্ত গ্রহণে দীর্ঘ কালক্ষেপণ করা। ঋণ অনুমোদনের এখন একক ক্ষমতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিষদের অথচ তারা সার্বক্ষণিক ব্যাংকের দায়িত্ব পালন করেন না। ফলে সময়মতো ঋণ অনুমোদন হয় না যে কারণে ঋণ গ্রহণের প্রকৃত প্রয়োজনে ঋণ ব্যবহৃত হয় না বা ঋণ নিয়ে যে ব্যবসা করা হতো সে সুযোগ নষ্ট হয়ে যায়। যেটি ঋণখেলাপির একটি অন্যতম কারণ। তার উপরে আছে ডিউ ডিলিজেঞ্চের অপপ্রয়োগ। এর পরে মড়ার উপরে খাঁড়ার ঘা উচ্চ হারে সুদ। এসব কারণে খেলাপি ঋণ দিন দিন বাড়ছে। সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী সংসদে এক প্রশ্নোত্তরে বলেছেন, বাংলাদেশে চালু ৫৬টি ব্যাংকের মোট ঋণখেলাপির পরিমাণ ৫৪ হাজার ৬৫৭ কোটি টাকা।
ব্যবসা-বাণিজ্যে যেমন স্টক লট বা ওজনে কমে যাওয়া বা বাকিতে বেচা-কেনার টাকা আটকে যাওয়া বা অনাদায়ী থাকা তেমনি ব্যাংকিং ব্যবসায় খেলাপি ঋণ। কিন্তু ঋণখেলাপি বলে ব্যাংকিং খাতের ব্যবসায় একটি ধারণার চরম অপব্যবহার করা হচ্ছে। যেহেতু ঋণ একটি পারস্পরিক লাভ লোকসানের ব্যবস্যা তাই ঋণ কখনোই খেলাপি হতে পারে না। ব্যাংকিং ব্যবসায় ঋণ একটি পণ্য যা দুজন ক্রেতা-বিক্রেতার মধ্যে উভয়ের লাভজনক শর্তে বিনিময় হয়ে থাকে। এখানে একপক্ষ তার লাভ বৃদ্ধি বা নিশ্চিত করার কারণে যদি অন্যপক্ষকে ক্ষতিগ্রস্ত করে তাহলে তা ঋণখেলাপি হতে পারে না। বিষয়টি লাভ লোকসানের খেলা। এখানে একপক্ষকে আইন দ্বারা রক্ষা করা হবে এবং অন্যপক্ষকে সেই আইন দিয়ে জব্দ করা হবে তা কখনো আইনের ন্যায়বিচার হতে পারে না। ব্যাংক যদি তার লাভ নিশ্চিত করার জন্য যে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে তাহলে ঋণ গ্রহীতা কেন তার লাভ বা স্বার্থ নিশ্চিত করার জন্য তার সুবিধামতো পদক্ষেপ নিতে পারবে না? তাছাড়া ঋণ দেওয়া ও নেওয়া একটি চলমান প্রক্রিয়া। মানুষ সাধারণত দুটি কারণে ঋণ নেয়। প্রথমত তার বিনিয়োগের বর্ধিত চাহিদা পূরণ করতে এবং দ্বিতীয়ত তার আর্থিক সমস্যার সমাধানের জন্য। কাজেই ঋণ অন্তহীন কাল বিরাজিত একটি অর্থনৈতিক কার্যক্রম যার প্রয়োজনীয়তা কখনোই শেষ হতে পারে না। তাই ঋণ কখনোই খেলাপি হতে পারে না। যেমন একজন বিনিয়োগের জন্য ঋণ নিয়ে পরে কোনো কারণে আর্থিক সমস্যায় পতিত হয়ে গৃহীত বিনিয়োগের দায়দেনা পরিশোধ করার জন্য আবার ঋণ নিতে হয়। এভাবে অনেকে পরিস্থিতির কারণে নতুন করে আর্থিক সমস্যার কারণে বাধ্য হয়ে ঋণের পরে ঋণ নিয়ে ক্রমান্বয়ে তার আর্থিক সমস্যার সমাধান করে যাচ্ছে এবং এর জন্য ক্রমবর্ধিত ঋণ দিলে ব্যাংকেরও কোনো আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে না। কারণ ব্যাংক তার ঋণের সুদ পাছে। পুনঃপুন ঋণে ব্যাংকের কোনো ক্ষতি ছিল না এবং ঋণও চলমান থাকে যার ফলে ঋণ কখনো খেলাপি হয় না। কিন্তু সমস্যা হয়েছে সরকারকে নিয়ে। সরকার তার কায়েমি স্বার্থের কারণে সবসময় ব্যাংকের পক্ষে অবস্থান নিয়ে থাকে এবং জনগণের অর্থের রক্ষক হিসেবে খেলাপ ঋণ নিয়ন্ত্রণের নামে খোদ ঋণকেই নিয়ন্ত্রণ করে ফেলে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ভ্রান্ত ঋণখেলাপি নিয়ন্ত্রণ নীতি প্রচুর তারল্য থাকার পরেও ঋণ বিতরণ সংকোচিত হয়ে যায় এবং অর্থনীতিতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। তবে কোনো সরকার যদি ঋণ গ্রহীতার পক্ষে অবস্থান নেয় তাহলে আন্তর্জাতিক বানিয়াচক্র ও তাদের নিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা ওই সরকারের বিরুদ্ধে যায়। ১৯৯১ সালে বিএনপি সরকার যখন কৃষকদের পাঁচ হাজার টাকার কৃষিঋণ মাফ করেছিল তখন বিশ্বব্যাংকসহ অনেকেই বিএনপির তীব্র সমালোচনা করেছিল। একইভাবে সম্প্রতি আওয়ামী লীগ সরকার যখন বড় বড় ঋণগুলো পরিশোধের ব্যাপারে ইতিবাচক পদক্ষেপ নিতে চাচ্ছে তখন চতুর্দিক দিক থেকে সরকারের ওপর নানাবিদ চাপ সৃৃষ্টি করা হচ্ছে।
ঋণ স্বীকৃত একটি পণ্য। আর দশটি পণ্যের মতো ঋণও প্রতিনিয়ত ক্রয়-বিক্রয়ের বাণিজ্য হয়। বাণিজ্যে উভয়পক্ষ একসঙ্গে লাভ করে না। সব ধরনের বাণিজ্যে কখনো ক্রেতা লাভ করে আবার কখনো বিক্রেতা লাভ করে। বাজারে চাহিদা বেশি থাকলে বিক্রেতার পোয়াবারো এবং সরবরাহ বেশি থাকলে ক্রেতা বেশি উপকৃত হয়। এটি বাজার সংস্কৃতির চারিত্রিক রূপ। ঋণবাণিজ্যের বেলায় একই সূত্র কাজ করে। ব্যাংকের তারল্য বেশি থাকলে ঋণ সরবরাহ বেশি থাকবে এবং তখন ঋণ গ্রহীতা এর পূর্ণ সুযোগ নিবে এবং একইভাবে ব্যাংকের তারল্য কম থাকলে ব্যাংকের ব্যবসা ভালো হবে এবং ঋণ গ্রহীতার অবস্থা কঠিন থাকবে। ঋণ একটি স্বল্পমেয়াদি পণ্য। ঋণকে দীর্ঘমেয়াদি পণ্য হিসেবে ব্যবহার করতে গেলে ঋণ অবশ্যই অলাভজনক ব্যবসায় পরিণত হবে। ঋণ এবং বিনিয়োগ এক নয়। ঋণ স্বল্পমেয়াদি ব্যবসায়িক পণ্য এবং বিনিয়োগ দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক কার্যক্রম যার চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য সম্পূর্ণ ভিন্ন। বিনিয়োগে ঝুঁকি যেমন কম তেমনি লাভও কম, তাই সাধারণত বেনিয়া ব্যাংকার বিনিয়োগে অর্থ খাটাতে চায় না। তাছাড়া বিনিয়োগ করতে গেলে ব্যাংকারকে অনেক বেশি দক্ষ ও অভিজ্ঞ হতে হয়। তবে বিনিয়োগে জনগণের লাভ বহুমাত্রিক। দেশ ও জনগণের কল্যাণে বিনিয়োগের অবদান সবচেয়ে বেশি। বিনিয়োগ জিডিপি বৃদ্ধি করে এবং জনগণের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ায় ও দারিদ্র্য দূর করে।
পক্ষান্তরে ঋণ হলো ফটকাবাজি। ঋণ দ্রব্যমূল্য ও মুদ্রাস্ফিতি বাড়াতে সরাসরি সহায়তা করে। ঋণ উৎপাদনকে ব্যাহত করে, বাজার অর্থনীতিকে চাঙ্গা করে এবং ঋণ নিজেই ঋণখেলাপি সৃষ্টি করে। ঋণ বাজারকে বায়বীয় করে এবং ব্যবসায়িক ঝুঁকি বাড়ায়। তাছাড়া ঋণ বাজারে অসম প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করে যার মূল্য জনগণকেই দিতে হয়। দীর্ঘমেয়াদি ঋণ ঋণকে নিজে নিজেই কুঋণে রূপান্তরিত করে। তাই ঋণ প্রধানত ফটকাবাজি ব্যবসা। বেশিরভাগ ব্যাংকার বাজারের দ্রুত পরিবর্তনশীল উদ্বায়ী অবস্থার সুযোগ নিতে সবসময় ঋণের ব্যবসায়ে ঝুঁকে পড়ে। ঋণে অল্প পুঁজিতে বেশি লাভ। তাছাড়া ঋণের জন্য ডকুমেন্ট বা দলিল দস্তাবেজ ও গ্রহীতার সম্মানকে জামানত হিসাবে ধরা হয় যা সব সময়ই ঝুঁকিপূর্ণ। পণ্য ও সম্পদের প্রকৃত মূল্যের কোনো মূল্যায়ন থাকে না। তাছাড়া বাজারের আকস্মিক চাহিদাও ঋণকে প্রভাবান্বিত করে কিন্তু চাহিদা পড়ে গেলে ঋণ ক্ষতিগ্রস্ত হয় কিন্তু ব্যাংক সে ক্ষতির দায়িত্ব না নিয়ে সবকিছু গ্রহীতার ওপর ফেলে দেয়, যার ফলে গ্রহীতার পক্ষে নতুন ঋণ ছাড়া পুরনো ঋণ পরিশোধ করা সম্ভব হয় না। শুরু হয় ঋণ আদায়ের জটিলতা। আমদানি রপ্তানি ঋণে এ ধরনের জটিলটা অনেক বেশি হয়। তাছাড়া সরকারের নীতি পরিবর্তন, শুল্কহার পরিবর্তন, আকস্মিক রাজনৈতিক অস্থিরতা, দৈবদুর্বিপাক ও বীমা কোম্পানির স্বার্থপরতা ঋণ আদায়ে সবসময় জটিলতা সৃষ্টি করে থাকে। তাছাড়া ব্যবসায়িক লেনদেনে কোনো একপক্ষের অসহযোগিতাও ঋণ আদায়ের জটিলতা আরও বাড়ায়। বিনিয়োগের বেলায়ও এ ধরনের জটিলতা দেখা দেয় কিন্তু সর্বদা সবাই সব ব্যাংক ঋণ পরিশোধের সব দায়দায়িত্ব ঋণ গ্রহীতার ওপর চাপিয়ে দেয়। এরকম একটি অস্বাস্থ্যকর আর্থিক অবস্থাকে আরও বেশি দুরারোগ্য করে তুলছে ঋণখেলাপি শব্দের অপব্যবহার এবং ঋণখেলাপি রোধে একপেশে আইনি ব্যবস্থা। ঋণখেলাপি অর্থাৎ যে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান সময়মতো ঋণ পরিশোধ করতে পারবে না তাকে আর কোনো ঋণ দেওয়া যাবে না। এবং তাদের সঙ্গে সব প্রকার আর্থিক কার্যক্রম বন্ধ করে মামলা মোকদ্দমায় লড়াই করতে বাধ্য করা। অথচ আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ঋণ আদায়ের পরিমাণও তেমন উল্লেখযোগ্য নয়। আজকে তাই স্বাভাবিকভাবেই সচেতন মহলে প্রশ্ন দেখা দিচ্ছে এ ঋণখেলাপি নামক পথ্যে গত ২০ বছরে দেশের আর্থিক খাতের কতটুকু লাভ হয়েছে?
যেহেতু ঋণ স্বল্পমেয়াদি পণ্য তাই এর কার্যক্রম স্বল্প সময়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে হবে। ঋণকে বছর বছর আবর্তিত করা যাবে না। ঋণখেলাপি কমাতে হলে ঋণকে এক বছরের মধ্যেই নিয়ন্ত্রিত রাখতে হবে। বছরের লাভ-লোকসানের খতিয়ানের মধ্যেই ঋণের হিসেবে সমন্বয় করে দিতে হবে। তাই ঋণ কার্যক্রমের হিসাব সমন্বয় করার প্রয়োজনীয়তা সবার সদয় বিবেচনার জন্য এখানে দেওয়া হলো। একজন কলা ব্যবসায়ী বছরে ১০০ টাকার ১০০টি কলা কিনে ৯০টি কলা ১১০ টাকায় বিক্রি করে প্রথম বছর ১০ টাকা লাভ করল, পরের বছর আবার ১০০ টাকার ১০০টি কলা কিনে আবারও ৯০টি কলা ১১০ টাকায় বিক্রি করে কোনো লাভ করতে পারল না এবং একইভাবে ব্যবসা করে তৃতীয় বছর ১০ টাকা লোকসান দিল। আরেকজন কলা ব্যবসায়ী একইভাবে ব্যবসা করে প্রতি বছর ১০ টাকা করে লাভ করল। এটি কী করে সম্ভব? কিন্তু সম্ভব এ জন্য, প্রথম ব্যবসায়ী তার প্রতিবছরের ১০টি করে অবিক্রীত কলা ফেলে না দিয়ে স্টকে রেখে দিয়েছে যার ফলে প্রতিবছর তার ক্রয়মূল্য বেড়ে গেছে। যেমন প্রথম বছরের অবিক্রীত ১০টি কলা পরের বছরের সঙ্গে যোগ করাতে কলার পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ১১০টি এবং ক্রয়মূল্য হয় ১১০ টাকা। তাই দ্বিতীয় বছর ১১০ টাকায় ৯০টি কলা বিক্রি করেও তার কোনো লাভ হয়নি। একইভাবে তৃতীয় বছর কলার পরিমাণ হয় ১২০টি এবং ক্রয়মূল্য দাঁড়ায় ১২০ টাকা। তখন ৯০টি কলা ১১০ টাকায় বিক্রি করে তার ১০ টাকা লোকসান হয়। অথচ অন্য ব্যবসায়ী প্রথম বছরের অবিক্রীত ১০টি কলা ফেলে দেয় (সে কিছু পচা কলা ফেলে দেয়, কিছু কম দামে বিক্রি করে এবং কিছু নিজে খায়) যার ফলে দ্বিতীয় বছরে তার কলার পরিমাণ থাকে ১০০টি এবং ক্রয়মূল্যও ১০০ টাকা, ফলে ৯০টি ১১০ টাকায় বিক্রি করে মুনাফা হয় ১০ টাকা। তৃতীয় বছরে একইভাবে অবিক্রীত কলা ফেলে দিয়ে ওই বছরও তার লাভ হয় ১০ টাকা এবং কিছু কলা কম দামে বিক্রি করে, কিছু নিজে খেয়ে একদম পচাগুলোকে ফেলে দেয়। এটি বুদ্ধিমান ব্যবসা নীতি। এখন খেয়ে ফেলা, কম দামে বেচে দেওয়া বা ফেলে দেওয়ার জন্য নয়ছয় করলে ক্ষতি ছাড়া কিছু হবে না। সমাজ ও রাষ্ট্রে কেউ কেউ যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হবে তেমনি কেউ কেউ অতিরিক্ত সুবিধা ভোগ করবে। এটা নিয়ে আমাদের হিংসায় পেট ফুলালে দেশ ও জনগণের কোনো উপকার হবে না। সব কিছুতেই সিস্টেম লস আছে।
বিনয়ের সঙ্গে বলতে চাই, বর্তমান ঋণ অনুমোদন প্রক্রিয়া খুবই ত্রুটিপূর্ণ এবং অতিমাত্রায় দুর্নীতিপ্রবণ। বর্তমানে ব্যক্তিগত সুসম্পর্ক বা লেনদেন ছাড়া কোনো ঋণই পাওয়া সম্ভব নয়। তার ওপরে আছে বাংলাদেশ ব্যাংকের খবরদারি। যদিও ঋণ প্রক্রিয়া স্বচ্ছ করার জন্য আইএমএফের উপদেশে বাংলাদেশ ব্যাংকের অধীনে ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরো সংক্ষেপে সিআইবি নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয় যেখানে সব ঋণ ও বিনিয়োগের তথ্য সরবরাহ করতে ব্যাংকগুলোর জন্য বাধ্যবাধকতা করে সরকার আইন করে দেয়। পরবর্তীতে বাংলাদেশ ব্যাংক সময়ে সময়ে তার ঋণ নিয়ন্ত্রণের কার্যক্রমের আওতায় বিভিন্ন ঋণ ও বিনিয়োগ নীতিমালা সিআইবি ভিত্তিক প্রণয়ন করে থাকে। প্রথমদিকে সিআইবি নীতিমালার আওতায় ঋণ ও বিনিয়োগ কার্যক্রম করতে গিয়ে ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে যায়। প্রতিবছর এই খেলাপি ঋণ সঞ্চিত হওয়ার কারণে ব্যাংকের প্রভিশন বেড়ে যেতে থাকে যার ফলে প্রথম কলা ব্যবসায়ীর মতো ব্যাংকের লাভ কমে লোকসানের দিকে যেতে থাকে। ফলে বাজারের ব্যাংকের শেয়ার মূল্য হ্রাস পায়। তখন আবার ব্যাংকগুলোর এ অবস্থা থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্য দ্বিতীয় কলা ব্যবসায়ীর পথ ধরে বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণ অবলোপন বা রাইট অফ করার নীতিমালা করে দেয়। সিদ্ধান্তটি সঠিক কিন্তু সমস্যা দেখা দিয়েছে এখন জনগণের প্রত্যাশা নিয়ে। বড় বড় অঙ্কের ঋণখেলাপির হিসাব বা রাইট অফের পরিমাণপত্র পত্রিকায় বা সংসদে প্রকাশিত হলে তখন জনমনে ব্যাপক বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় এবং সরকারের ওপর একটি নৈতিক চাপ সৃষ্টি করে যা সরকার মেনে নিতে চায় না। এ ধরনের একটি ত্রিশঙ্কু অবস্থায় ঋণখেলাপির সব দায়দায়িত্ব ঋণ গ্রহীতার মাথার ওপরে পড়ে এবং কেউ এই বেচারাদের সাহায্য করতে চায় না।
আমি তাই ঋণ গ্রহীতাদের পক্ষে কথা বলছি। ঋণের সব দায়দায়িত্ব একপেশে ঋণগ্রহীতার মাথায় চাপিয়ে দেওয়া ঠিক হচ্ছে না। ঋণ আদায় নীতিমালায় বাস্তবমুখী কার্যোপযোগী নীতিমালা গ্রহণ করতে হবে। আমি বলছি না অনাদায়ী ঋণ মাফ করে দেওয়া হোক। তবে ঋণ আদায়ে আরও বেশি প্র্যাগমেটিক সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রয়োজন, যেমন ঋণ পরিশোধের জন্য প্রয়োজনে বাড়তি ঋণ বা ঋণ পরিশোধের সময়সীমা বর্ধিতকরণ, সব প্রকার সুদ মওকুফ, প্রয়োজনে আংশিক আসল মওকুফ, ডিসকাউন্টে ঋণ বিক্রয় বা হস্তান্তর ইত্যাদি বিভিন্ন ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করলে ঋণখেলাপি কমে যেতে বাধ্য। ঋণখেলাপিকে সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে ধ্বংস না করে ঋণ গ্রহীতাকে ইতিবাচক সুযোগ দিলে আমার বিশ্বাস ঋণখেলাপিরা নিজে থেকেই ঋণখেলাপি হতে বেরিয়ে আসার জন্য নিজেরাই উদ্যোগী হবে। তার পরেও কিছু ঋণখেলাপি থেকেই যাবে যাদের ঋণ পৃথিবীর কোনো শক্তি বা প্রক্রিয়াই আদায় করতে পারবে না, যেমন সমাজকে কোনোভাবেই ১০০ ভাগ মাদক বা অপরাধমুক্ত করা সম্ভব নয়। এ ধরনের খেলাপিদের ঋণ ব্যবসায়িক লোকসান হিসেবে ধরে নিতে হবে। তাই ঋণ ও বিনিয়োগকে ব্যবসায়িক আলোকে মূল্যায়ন ও বিবেচনা করা উচিত। ঋণখেলাপিকে ঋণ দেওয়া যাবে না, এই নীতিমালা অবশ্যই পরিবর্তন করতে হবে না হলে খেলাপি ঋণ আরও বাড়বে। কাজেই ঋণ পরিশোধের জন্য ঋণই একমাত্র উপায়- এই নীতিমালায়ই ঋণখেলাপি ও রাইট অফের পরিমাণ কমাবে। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না ঋণ পাওয়া মানুষের অধিকার। ঋণ কার্যক্রম বন্ধ করে দিলে ব্যাংক অচল হয়ে যাবে, অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়বে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি হ্রাস পাবে। পৃথিবীর সব কাজেই ভালো-মন্দ আছে। শুধু মন্দ খুঁজলে ভগবানের মাঝেও মন্দ খুঁজে পাওয়া যাবে!
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য।
বিডি-প্রতিদিন/০৪ নভেম্বর, ২০১৫/মাহবুব