অতীত-ইতিহাস থাকে আনন্দ-বেদনার পাতায়। যেহেতু আত্মার বিনাশ নেই। তাই অমর আত্মা তা সবসময়ই বলে যাবে, যা স্রষ্টা অবশ্যই শুনবে, যদিও আমরা শুনতে পাই না। যিনি খুন করেন, তার কোনো অপরাধবোধ থাকে না। তার অন্তরাত্মা বা বিবেক ধ্বংস হয়ে যায়। হিংসার কাছে বিবেক শূন্য বা মৃত থাকে। খুনের মতো অপরাধী যে কত ভয়ঙ্কর হতে পারে তার প্রমাণ এ দেশেই আছে। যেভাবেই হোক এ ধরনের ভয়ঙ্কর অপরাধীদের সবসময় সুবিধাভোগী, স্বার্থান্বেষী, ক্ষমতালোভী সরকারের কাছাকাছি রাখা হয়। অনন্ত ইতিহাস তাই বলে।
আমি যার কথা বলতে যাচ্ছি, তিনি হলেন সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী। তিনি তখন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত মন্ত্রী। ১৯৮৭ সালের কথা। আমি তখন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের সহকারী অধ্যাপক। অধ্যাপক ফরিদউদ্দীন অধ্যক্ষ। মার্চের ২২ তারিখে এমবিবিএস শেষ পর্বের ফল প্রকাশ হলো। মেডিসিনে প্রায় শতভাগ পাস। গাইনিতে প্রায় শতকরা ৫৫ ভাগ এবং সার্জারিতে শতকরা ৬০ ভাগের কাছাকাছি। গড়ে প্রায় ৫২ ভাগ। ফেল করা ছাত্ররা একসঙ্গে মিলে সার্জারি এবং গাইনি ওয়ার্ডগুলোতে শিক্ষকদের রুম ভাঙচুর করেন এবং মেডিসিন বিভাগের শিক্ষকদের রুমের সামনে ফুলের তোড়া উপহার হিসেবে রাখেন। এই ঘটনা রাতের বেলার। পরদিন সকাল বেলায় জরুরি একাডেমিক কাউন্সিলের মিটিং। সেখানে আবার আক্রমণ। আমরা চারজন সহকারী অধ্যাপক ডা. ইমরান বিন ইউনুস, ডা. এহসান সোবহান চৌধুরী, ডা. হাসানুজ্জামান ভূঁইয়াসহ আমি ছুটে যাই সভাস্থলে এবং ছাত্রদের নিবৃত্ত করতে সফল হই। ছাত্ররা আমাদের দেখে চলে যাওয়ার পেছনে অন্যতম কারণ ছিল— শিক্ষার্থীদের কাছে আমাদের গ্রহণযোগ্যতা। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের তখনকার এক্সট্রা একাডেমিক একটিভিটির (বহিঃক্রীড়া, আন্তঃক্রীড়া, সাহিত্য, সংগীত) প্রাণ ছিলাম আমরা চারজন।
অধ্যক্ষ ফরিদউদ্দীন তখন ছিলেন অফিশিয়াল কাজে ঢাকায়। আমরা চারজন যেখানে তাদের নিবৃত্ত করলাম, সেখানে খবরটা মন্ত্রীর কাছে দেওয়া হলো আমরা ভাঙচুরে মদদ দিয়েছি। আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ কিংবা গোয়েন্দা সংস্থার কাছ থেকে তথ্য না নিয়েই ২৪ তারিখে বদলির আদেশ জারি করলেন চারজনের। দুজনকে, এহসান ভাই এবং এমরান বিন ইউনুস রাজশাহীতে, আর আমি এবং হাসানুজ্জামান ভূঁইয়া রংপুরে। আমার অতি প্রিয় শিক্ষক অধ্যাপক নূরুল আমিন যখন জানলেন কী কারণে আমাকে বদলি করা হয়েছে। তখন তিনি আমাকে একটা মূল্যবান উপদেশ দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন— ‘তোমার বস যে কাজের সমাধান দিতে পারেনি, সে কাজের সমাধান জানা থাকলেও তা তুমি করতে যেও না’। তার এই বক্তব্য নাকি ব্রিটিশ সংস্কৃতি।
শাস্তিযোগ্য বদলি বা উপহারস্বরূপ বদলি যাই হোক না কেন, সরকারি বদলিযোগ্য চাকরি করি, তাই সিদ্ধান্ত নিলাম অবশ্যই নতুন কর্মস্থলে যাব। আমার সন্তানসম্ভবা স্ত্রী উৎফুল্ল। কেননা শ্বশুরের চাকরির বদলির সুবাদে ওরা অনেক নতুন নতুন জায়গা ঘুরেছে, দেখেছে। বিপত্তি ঘটাল আমার অনুরোধ ছাড়াই স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে সাকা চৌধুরীর এক ঘনিষ্ঠ আত্মীয়, যিনি আমার কাছে ছিলেন শ্রদ্ধেয়, তার মায়ের ক্যান্সারের কারণে আমাকে প্রায়ই দেখতে হতো। তার অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে মন্ত্রীর মন্তব্য ছিল, ‘ইতে ডেডাইয়ার পোয়া চাটগার বেক পইসা কাচাইয়েরে হিন্দুস্থানত লই জারগই’। অর্থাৎ সে হিন্দুর ছেলে, চট্টগ্রামের সব পয়সা রোজগার করে হিন্দুস্থান অর্থাৎ ভারতে পাঠিয়ে দেয়। এ কথাটা আমাকে প্রচণ্ড ব্যথিত করেছিল। স্বাধীনতা সংগ্রামে আমার ত্যাগ। পরিবার ছিন্নভিন্ন। মেঝ কাকা ২৬ মার্চ ভোরেই পাকিদের গুলিতে আহত, ছোট কাকা নিখোঁজ, বাবা ১৩ নভেম্বর, ’৭১-এর স্বাধীনতার ঊষালগ্নে পরকালে। তারপরে এ ধরনের একটি উক্তি আমার হূদয়টা ভেঙে খান খান করে দিল।
সিদ্ধান্ত পাল্টালাম, রংপুরে যাব না। চাকরি ছাড়ব না। পারলে আমার চাকরি খাক। ২৪ মার্চ, ১৯৮৭ তারিখের চিঠি ২৫ মার্চ ১৯৮৭-তে আমার হাতে; ৩০ মার্চ, ১৯৮৭-এর মধ্যে যোগদান করতে হবে। অন্যথায় তাত্ক্ষণিক অব্যাহতি। সরকারি নিয়ম অনুযায়ী যেটুকু ট্রানজিট সময় পাওয়ার কথা তাও দেওয়া হয়নি। আমার স্ত্রী, আমার সিদ্ধান্তে অত্যন্ত নাখোশ হলেও মুখ খুলে কিছু বলেননি। ২৯ মার্চ রাত ১০টার দিকে ঘুমাতে গেলে সহধর্মিণী জিজ্ঞাসা করলেন, একটা কথা বলব? কী বলবে আঁচ করতে পেরে ধমকের স্বরে বললাম, হিন্দু পৌরাণিক কাহিনীতে এ জন্যই বলেছে, ‘স্ত্রীবুদ্ধি প্রলয়ঙ্করী’। ধমকে চুপ হয়ে গেলেন। নিজেই অনুতপ্ত হয়ে একটু পরে জিজ্ঞাসা করলাম, কী বলবে, বল? তখন সে দুটো যুক্তি তুলে ধরল, রংপুরে যোগদানের সপক্ষে— ১. আমার মেধার প্রশংসা এবং এক দিন আমি প্রফেসর হতে পারব। ২. আমাদের একটা মেয়ে আছে, তার বিয়ের আলাপে, ছেলেপক্ষ যদি জানতে চায়, মেয়ের বাবা কে? জবাব ডা. প্রাণ গোপাল আর অধ্যাপক প্রাণ গোপালের মধ্যে কী বিশাল পার্থক্য। আমি কী চাই? প্রথমটা আমি উড়িয়ে দিলাম, দ্বিতীয়টা যেহেতু নিজের মেয়ে তাই চিন্তিত হয়ে পড়লাম। শ্বশুরের মেয়ে নিয়ে, অর্থাৎ স্বামী হিসেবে আমি ডাক্তার না অধ্যাপক, স্ত্রীর এই গর্ব অতটুকু দাগ কাটত না। তাই মেয়েটার কথা চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নিলাম, রংপুর যাব।
রংপুর গেলাম অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে চট্টগ্রামে রেখে। যেদিন তার প্রসববেদনা উঠল সেদিনও আমি রংপুরে, কেননা ছুটি পাচ্ছিলাম না। হয়তোবা মন্ত্রী প্রিন্সিপালকে বলে দিয়েছিলেন, এ পাপীকে যেন ছুটি দেওয়া না হয়। সিজারিয়ান সেকশন করবে কী করবে না, সে নিয়ে চিকিৎসকের দ্বিধাগ্রস্ততার পরিণাম মৃত পুত্রসন্তান। মৃত্যুর কারণ Cord around the neck. হবপশ. এ খবর পেয়ে আমি চট্টগ্রাম চলে এসে স্ত্রীর পাশে সাত দিন থাকার সিদ্ধান্ত নিলাম এবং তাকে নিয়েই রংপুর যাব। এমন অবস্থায় মন্ত্রী স্বউদ্যোগে, অধ্যক্ষ অধ্যাপক আজিজুর রহমানকে নির্দেশ দিলেন, ‘আমি বিনা অনুমতিতে অনুপস্থিত, এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য কাগজপত্র পাঠানোর জন্য’। আমি তা জানতে পারলাম ডিজি অফিসের একজন অফিস সহকারীর কাছ থেকে। সে আরও বলল, ‘স্যার চিন্তা করবেন না, আপনার বিরুদ্ধে যে চিঠি লিখেছে, এটা আমি ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছি’। আমি তাকে বললাম, তুমি ভুল করেছ। তোমার উচিত ছিল চিঠিটা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো। ইতিমধ্যে আমি চট্টগ্রাম থেকে রংপুরে গিয়ে পৌঁছলাম এবং কাজ শুরু করলাম। ক্ষতি যা হওয়ার হয়ে গেছে। কী অপূরণীয় ক্ষতি এটা শুধু আমরা বুঝতে পারি। আমি আমার বাবার অকাল মৃত্যুতেও এত ব্যথিত হইনি, মানসিকভাবে ভেঙে পড়িনি। অনেক দিন সময় লেগেছিল, আমার স্বাভাবিক অবস্থার কাছাকাছি ফিরে আসতে। অধ্যাপক পি.বি. রায়কে বরিশালে বদলি করা হলো। সারা জীবন তিনি সর্বত্র চাকরি করে নিজের জেলা চট্টগ্রামে এলেন। চিকিৎসক হিসেবে শুধু প্রসার নয়, দ্যুতি ছড়ালেন। তাকেও চাকরিচ্যুত করে ছাড়লেন। এমনকি তিনি পেনশন তো দূরের কথা কোনো সার্ভিস বেনিফিট পাননি। কারণ তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়। যেই ভদ্রলোক চট্টগ্রামের লোকদেরসহ পুরো বাংলাদেশে এত সেবা দিয়ে গেলেন, তার হলো এ পরিণতি। তবে নিশ্চয়ই স্রষ্টা সদয় ছিলেন, কারণ তার তিনটা ছেলেমেয়েই বিশেষজ্ঞ ডাক্তার।
আমাদের প্রিয় শিক্ষিকা, অধ্যাপক নূরজাহান আপাকে বদলি করলেন বরিশালে। দম্ভোক্তি করে বললেন, ‘এই কালীরে আই হাঙ্গরের মুখে মুখে রাইক্যুম’ পানিত পড়লেই হাঙ্গরে ওর মাংস খাই উল্লাস করবেই। নূরজাহান আপা অত্যন্ত স্মার্ট ভদ্রমহিলা, শুধু উনার গায়ের রঙের ওপর ব্যঙ্গ করে তাকে কালী বলেছেন। তবে শিক্ষক হিসেবে তিনি আমাদের কাছে মায়ের এবং দেবতার মতো ছিলেন।
আমি চাকরি ছাড়িনি শুধু নূরজাহান আপার স্বামী আমার অতি সম্মানিত ব্যক্তি তার উপদেশে। তিনি বলেছিলেন, ‘চাকরি ছাড়বে কেন? তুমি চেষ্টা করলে কেবল প্রফেসর নও, মন্ত্রীও হতে পারবে। মতিন সাহেব এবং বি. চৌধুরী সাহেব মন্ত্রী হননি! কিন্তু তোমার মন্ত্রী শত চেষ্টা করলেও প্রফেসর হতে পারবে না।’ এ কথাটি আমাকে যথেষ্ট অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল। সবচেয়ে ব্যথিত হয়েছি। আমার প্রিয় এবং ক্রীড়াঙ্গনে আমার বড় ভাই। অত্যন্ত মেধাবী, যার কাছ থেকে অনেক সময় লেখাপড়ার সহায়তা পেয়েছি এবং আমার ধারণা মতে তিনি যদি রেডিওলজিতে চাকরি চালিয়ে যেতেন তাতে শুধু ছাত্ররা লাভবান হতেন না তিনি বিশ্ব মানের একজন সেরা রেডিওলজিস্ট হতেন। জাতি এবং মেডিকেল প্রফেসর এক চিকিৎসকরত্নকে তার প্রতিভার সদ্ব্যবহার করার সুযোগ দেননি।
যুদ্ধাপরাধী হিসেবে সাকা চৌধুরীর যখন বিচার হচ্ছিল, তখন তিনি এবং তার আইনজীবী বার বার বলার চেষ্টা করেছিলেন স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তান এবং ব্রিটিশ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে তিনি দাবড়িয়ে বেড়িয়েছেন। আমার দুজন প্রিয় শিক্ষক, যাদের জন্য আমি আজ এখানে এদের দুজনের মুখে শোনা একটি বাস্তব ঘটনার এখানে উদ্ধৃতি করছি। তারা দুজনেই এখনো জীবিত। দুজনেরই বয়স হলো ৮০-এর কাছাকাছি। একজন অধ্যাপক এম এ মাজেদ অপরজন অধ্যাপক এম এন আমিন। যিনি হাতে ধরে আমাকে কাজ শিখিয়েছেন। তিনি প্রত্যেকটা সিঁড়ি পার হওয়ার জন্য আমাকে সাহায্য করেছেন।
১৯৭১-এর আগস্ট মাসের ঘটনা। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের এমবিবিএস শেষ পর্বের পরীক্ষা। নূরুল আমিন স্যার ইন্টারনাল এবং মাজেদ স্যার এক্সটারনাল। মাজেদ স্যার পরীক্ষার সময়টা নূরুল আমিন স্যারের ১/এ, কাতালগঞ্জের বাসায় ছিলেন। এক দিন রাত সাড়ে ১০টায় গুডস হিল থেকে আমিন স্যারকে টেলিফোনে সাকা চৌধুরী নিজে তাকে তাত্ক্ষণিক একটা রোগী দেখার জন্য গুডস হিলে যাওয়ার অনুরোধ জানালেন। যুদ্ধকালীন সময়ের ব্যাপার বিবেচনায় এনে মাজেদ স্যার আমিন স্যারের সঙ্গী হয়ে ওখানে গেলেন। দেখলেন একটি যুবককে হাত-পা বেঁধে নির্যাতন করা হয়েছে।
সে কোনো কথা বলছে না। ছেলেটি বোবা কিনা, এই সিদ্ধান্ত দেওয়ার জন্যই আমার শিক্ষকদ্বয়ের প্রয়োজন। ছেলেটির প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে আমিন স্যার নির্দেশ দিলেন তাকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে তার অধীনে ভর্তি করে দেওয়ার জন্য। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সব বলবেন। এ কথা বলে তারা গুডস হিল থেকে ফেরার পথে কয়েকটি গুলির আওয়াজ এবং একটি চিৎকার শুনলেন। পরদিন ছেলেটিকে আর হাসপাতালে পাঠাতে হয়নি, হয়তোবা কোনো বধ্যভূমির গণকবরে পৌঁছিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমাদের সবারই জানা উচিত মিথ্যা কখনো জয়ী হয় না, সত্যের জয় সর্বত্র এবং সত্যই প্রকৃত সুন্দর।
লেখক : সাবেক উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।
বিডি-প্রতিদিন/ ০১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬/ রশিদা