ঢাকা, শুক্রবার, ৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

আজকের পত্রিকা

চির নতুন প্রিয় নাট্যজন মমতাজ স্যার
আনোয়ার হক

স্যারকে বলেছিলাম, আপনাকে খুব বেশি জানি না, আমরা যারা মধ্য প্রজন্মের। নতুন প্রজন্মের অনেকেই জানে না বিস্তারিত। আপনাকে পুরোটা জানতে চাই। জানাতে চাই। সব প্রজন্মই জানবে, পুরোপুরি জানবে, একজন মমতাজউদদীন আহমদকে। সবদিক থেকেই। একজন প্রতিথযশা নাট্যকার, একজন অভিনেতা, একজন পরিচালক, একজন নির্দেশক, একজন শিক্ষক কিংবা লেখক হিসেবেই শুধু নয়। নতুন প্রজন্মকে জানতে হবে পূর্ণাঙ্গভাবে। একজন পরিপূর্ণ মমতাজ স্যারকে। আমাদের প্রিয় নাট্যজনকে। নতুনদের জানতে হবে চির নতুন মমতাজউদদীনকে।   চুপ থাকলেন একটুখানি। হয়তো মুহূর্তেই ভাবনার রাজ্যে নিয়ে গেলেন নিজেকে। কিন্তু তা অতি স্বল্প সময়ের জন্য। মাথা ওপরে তুলে চিরচেনা স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে বললেন, ঠিক আছে।

বললাম, পূর্ণাঙ্গ বায়োপিক তৈরি থেকে শুরু করে সব জায়গায় আপনার প্রকাশিত বই, অভিনীত নাটক-সিনেমা থাকার ব্যবস্থা জরুরি। এর কিছুটা দায়িত্ব নিতে চাই আমরা। কিছুটা দ্বিধা থাকলেও সম্মতি জানালেন শেষ পর্যন্ত। তবে সময় চেয়ে নিলেন কয়েকটা দিনের জন্য। আনন্দ ভাগাভাগির দারুণ একটা জ্বলন্ত উদাহরণ আমাদের শ্রদ্ধেয় মমতাজ স্যার। অনেক সিরিয়াস বিষয়কে এতোটা তরল করে দিতে পারেন। বিস্মিত হতে বাধ্য যে কেউই। এতো বড় মাপের মানুষ। অথচ এতো বিনয়, এতোটা বিনম্র। খুব কমই দেখেছি ক্ষুদ্র এ জীবনে।     চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার ভোলাহাট থানার বজরাটেক গ্রামের কলিমউদদীন আহমদ ও সখিনা খাতুনের সুযোগ্য সন্তান মমতাজউদদীন আহমদ (MOMTAZUDDIN AHMED)। পড়াশুনা করেছেন রাজশাহী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এম. এ (অনার্সসহ)। এর বাইরে যুক্তরাষ্ট্রের পিটস্বার্গে কার্নেগী মেলন বিশ্ববিদ্যালয়ে নাট্যতত্ত্ব ও নাট্যকলা বিষয়ে শিক্ষা লাভ, জাপানে এশিয়ান ড্রামা ও পাপেট থিয়েটার বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন।

দীর্ঘ কর্মময় জীবনের উল্লেখযোগ্য হচ্ছে : অষ্ট্রেলিয়ার সিডনিতে বঙ্গবন্ধু পরিষদের সেমিনারে অংশগ্রহণ। ক্যানবেরাতে এশিয়ান সংস্কৃতি উৎসবে বাংলাদেশ সংস্কৃতি দলে সদস্য হিসেবে অংশগ্রহণ, সংস্কৃতি ও নৃত্য বিষয়ে অভিজ্ঞতা। ভারতে বাংলাদেশ নাট্যদলের নেতৃত্ব নিয়ে দিল্লি, জয়পুর, কলকাতায় মীর মশাররফের জমীদার দর্পণ নাটকের প্রদর্শন। বাংলাদেশ সাহিত্য সংস্কৃতি দলে সদস্য হিসেবে দিল্লি, ব্যাঙ্গালোর এবং কলকাতা ভ্রমণ এবং ভারতীয় সাহিত্য ও সংস্কৃতি দলের সঙ্গে মতবিনিময়। হজব্রত পালনের জন্য সৌদি আরব ভ্রমণ এবং মুসলিম ঐতিহ্য বিষয়ে উপলব্ধি, তার সঙ্গে মক্কা ও মদিনাশরীফের অপরূপ অভিজ্ঞতা।

অধ্যাপক মমতাজউদদীন রচিত নাটক ‘কী চাহ শঙ্খচিল’ এবং ‘বিবাহ’ নাটক দুটি পশ্চিমবাংলার রবীন্দ্রভারতী এবং নেতাজী সুভাষ বোস বিশ্বদ্যিালয়ে এম.এ শ্রেণিতে বাংলাদেশের সাহিত্য হিসেবে পাঠ্য তালিকাভুক্ত।

মঞ্চ বেতার এবং চলচ্চিত্রের জন্য শতাধিক নাট্য রচনা ও অভিনয় করেছেন। টেলিভিশনে শ্রেষ্ঠ নাট্যরচনা এবং চলচ্চিত্রে চিত্রনাট্যের এবং অভিনয়ের জন্য পেয়েছেন পুরস্কার।

বাংলাদেশ, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে উল্লেখযোগ্য নাটক; এবারের সংগ্রাম-স্বাধীনতার সংগ্রাম, স্বাধীনতা আমার স্বাধীনতা, বর্ণচোরা, কী চাহ শঙ্খচিল, বিবাহ, এখন মধু মাস, এই সেই কণ্ঠস্বর।

মঞ্চ নাটকের মধ্যে রয়েছে: দুইবোন, রাক্ষুসী, জমিদার দর্পণ, ক্ষতবিক্ষত, ওহে তঞ্চক, খামকাখামকা, বাদশাহী বন্টননামা, অর্ণবের মাতাপিতা, লাবণি আর তার ছেলে এবং সাতঘাটের কানাকড়ি।   অধ্যাপক মমতাজউদদীনের শিক্ষকতায় রয়েছে দীর্ঘ অভিজ্ঞতা। কমার্স কলেজে লেকচারার-৪ বছর, চট্রগ্রাম কলেজে সহকারি অধ্যাপক ৬ বছর, চট্রগ্রাম কলেজে সহযোগী অধ্যাপক ৭ বছর, চট্রগ্রাম কলেজে প্রফেসর ২ বছর ও জগন্নাথ কলেজে ১২ বছর এবং খণ্ডকালিন শিক্ষক ৪ বছর (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নাট্য বিভাগে)।

জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন কমিটি উচ্চতর বিশেষজ্ঞ এবং বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে গবেষণা ও প্রকাশনা পরিচালক হিসেবে বিশেষ দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি।   পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আগ্রহে এবং নির্দেশে কারচারাল মিনিষ্টার হিসেবে নিউইয়র্কে জাতিসংঘে বাংলাদেশ স্থায়ী মিশনে ৪ বছর সুচারুভাবে ও প্রশংসার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন অধ্যাপক মমতাজ।

প্রগতিশীল জাতীয়তাবাদী এবং গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন তিনি। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য : রাজশাহী কলেজের ছাত্র হিসেবে ভাষা আন্দোলন এবং স্বৈরাচারবিরোধী সংগ্রামে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের জন্য একাধিকবার কারাবরণ এবং আত্মগোপনে বাস। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনী প্রচারণায় সরাসরি অংশগ্রহণ এবং দলীয় প্রার্থী নির্বাচনে সফল্য লাভ। ১৯৯৬ সালের গণতন্ত্র উদ্ধারের জন্য অগণতান্ত্রিক বিরোধী শক্তির উচ্ছেদের জন্য সর্বজন পরিচিত ‘জনতার মঞ্চ’ আন্দোলনের সৃজন ও সংগ্রামে অংশগ্রহণ। কারাবাস এড়িয়ে চলার জন্য আত্মগোপন। ফজলুল হক হলে বার্ষিকী সম্পাদক, ঢাকা হলের (ড. শহীদুল্লাহ হল), সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন। ১৯৭১ সালে চট্টগ্রামে স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম প্রধান সংগঠক    হিসেবে সাংস্কৃতিক উৎসবের আয়োজন। তাছাড়া ১৫ ও ২৩ মার্চে এবারের সংগ্রাম এবং স্বাধীনতার সংগ্রাম দুটি লোকনাট্য (যাত্রাপালা) রচনা ও পরিচালনা করে প্রায় ২ লাখ দর্শকের সামনে উপস্থাপন।   নিয়মিত রাজনৈতিক প্রবন্ধ ও কলাম রচনা অব্যাহত রেখেছেন প্রথিতযশা লেখক অধ্যাপক মমতাজ। স্বৈরাচার বিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ক্ষেত্র রচনার জন্য প্রায় দশ বছর নিয়মিত কলাম ও প্রবন্ধ রচনা। তাছাড়া বঙ্গবন্ধুর আদর্শ, সামরিক শাসনবিরোধী এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও সাহিত্য বিষয়ে প্রবন্ধ রচনা। নিউইয়র্কের জাতিসংঘে বাংলাদেশের অবস্থান ও পরিচয় বিষয়ে গ্রন্থ রচনা। মহান অভিনেতা চার্লি চ্যাপলিনকে নিয়ে একটি গ্রন্থ এবং বিশ্বসাহিত্য বিষয়ক আলোচনা গ্রন্থ-অমৃত সাহিত্য।

তাঁর স্বৈরাচারবিরোধী সাহসী নাটক সাতঘাটের কানাকড়ি সম্পর্কে বেগম সুফিয়া কামাল বলেছেন, থিয়েটার অভিনীত মমতাজউদদীনের সাতঘাটের কানাকড়ি নাটক দেখলাম। বাংলা মায়ের আর্তকান্না শুনলাম। আরো দেখলাম সমাজের পরগাছা, দেশ ও জাতির মূর্ত লোভী ভণ্ডের ভণ্ডামি। সে মুখোশ খুলে দিতে সাহসী সংগ্রামী সত্যনিষ্ঠ বাংলার সন্তানদের শপথ ভরা মুখ। থিয়েটারের এ নাট্যকর্ম মানুষ মনে রাখবে।

ড. নীলিমা ইব্রাহিম বলেছেন, যে এক বুক আশা নিয়ে মানবাধিকারের দায়িত্বে ৭১ এ বাঙালিরা রক্ত দিয়েছে তা আজ হতাশায় নিমজ্জিত। সাতঘাটের কানাকড়ি আমাদের পূর্ব জীবনের পথে এগিয়ে যাবার প্রেরণা যুগিয়েছে। মমতাজউদদীন আহমদ ও     থিয়েটার কর্মীদের আলোর ইশারা জ্বলন্ত মশালে জাগরিত হোক, এই আমার কামনা এবং বিশ্বাস।

প্রফেসর শওকত ওসমান বলেছেন, সাতঘাটের কানাকড়ি যে মুদ্রামাণে পূর্ণ, তাতে অভিভূত হওয়া যায়। আমি আশা করব, মুদ্রাস্ফীতির যুগে এ কানাকড়ি বহুকাল এদেশে আপন মূল্যে বিকশিত হবে।

প্রফেসর আহমদ শরীফ বলেছেন, এ নাটক অনন্য, অসামান্য। জীবনের সঙ্গে বুদ্ধির, সাহসের সঙ্গে শক্তির, অঙ্গীকারের সঙ্গে উদ্যোগের ও আয়োজনের এমন সমাবেশ সমাজে রাজনীতি দুষ্টু, দুর্জন, দুর্বৃত্ত, দুষ্কৃতির এমন বাস্তব সামষ্টিক সামাজিক চালচিত্র একাধারে ও যুগপৎ আর কখনো দেখেছি বলে মনে পড়ে না। ধন্য নাট্যকার, ধন্য অভিনেতারা ও প্রযোজক। আমি মুগ্ধ ও কৃতজ্ঞ দেখে ও শুনে।

১৯৯৬ সালের গণআন্দোলনে জনতার মঞ্চের ভূমিকা সম্পর্কে মুক্তিযুদ্ধকালে স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত চরমপত্রের লেখক ও কথক এম.আর আখতার মুকুল লেখেন, বিরোধীদলীয় (সে সময়)নেত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে ঢাকা পৌরসভার মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ১৮ মার্চ (১৯৯৬) জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনের রাস্তায় বিশাল জনতার মঞ্চ নির্মাণের ব্যবস্থা করলেন। সে মঞ্চ পুলিশ ভেঙ্গে দিল। ১৯ শে মার্চ পুনরায় নির্মিত সে মঞ্চে বিকালে ‘জনতার মঞ্চ’ থেকে অনুষ্ঠান পরিচালিত হলো। সার্বিক দায়িত্বে অধ্যাপক মমতাজউদদীন আহমদ। ২৮ মার্চ অপরাহ্ণে বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা বক্তৃতায় এক পর্যায়ে বিএনপি নেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে পদত্যাগের আমন্ত্রণ জানালেন। ৩১ মার্চ কাকরাইলের রাস্তায় আয়োজিত জনসভায় বেগম জিয়া পদত্যাগ ঘোষণা করলেন। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ইতিহাসে “জনতার মঞ্চের” অবদান অবিস্মরণীয় হয়ে রইল। এই জনতার মঞ্চের প্রাণপুরুষ ছিলেন অধ্যাপক মমতাজউদদীন আহমদ। এটা ছিল তার জীবনের তৃতীয় পর্ব। এরপর দেখতে পেলাম অধ্যাপক মমতাজউদদীন আহমদ ঢাকার পত্রিকাগুলোতে চুটিয়ে ‘কলাম' লিখছেন। এ প্রতিবেদনগুলো হচ্ছে সম্পূর্ণভাবে রাজনৈতিক। তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার পর আর এ ধরনের ব্যঙ্গাত্মক কলাম রচিত হয়নি। প্রতিবেদনগুলোর মূল সুর হচ্ছে বাংলাদেশ, বঙ্গবন্ধু ও বাঙ্গালি জাতির বন্দনা এবং মৌলিক আদর্শ হচ্ছে গণতন্ত্র ও ধর্ম নিরপেক্ষতা। মমতাজউদদীন আহমদের সুদৃঢ় চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হলো, আদর্শের বিষয়ে তিনি কখনো কোনো আপোষ করতে রাজী নন।

নীতি-আদর্শে দৃঢ়চেতা, স্বাধীনচেতা, নির্লোভ-নিরহংকার, তারুণ্যভরা চির নতুন, আধুনিক সাহিত্য-সংস্কৃতির অগ্রপথিক এমন ব্যক্তিত্ববান সফল পুরুষ সম্পর্কে জানবার-জানাবার দায়িত্ব নিতে হবে আমাদেরই। খুব কঠিন সময়ের কঠিন কথাগুলো অতি সহজ করে হাস্যরস দিয়ে আনন্দবর্ণনায় সার্বজনীন উপস্থাপনের নিপুণ কারিগরের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা-গভীর ভালোবাসা।  

লেখক: সাংবাদিক ও সংস্কৃতিকর্মী

বিডি-প্রতিদিন/১৮ জানুয়ারি, ২০১৭/মাহবুব



এই পাতার আরো খবর