ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

আজকের পত্রিকা

নিরাপত্তা ও সীমান্ত ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ-ভারত
হাসান ইবনে হামিদ

বাংলাদেশ-ভারতের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের যাত্রা বহু আগে। বিভিন্ন ইস্যুতে এ সম্পর্কে টানপড়েনোর সৃষ্টি হলেও দু’দেশের সম্পর্কের মাঝে বিষফোঁড়া হলো সীমান্ত হত্যা, যা নিয়ে প্রায়ই উত্তপ্ত হয়ে উঠে এদেশের জনগণ। নিরাপত্তা ও সীমান্ত ব্যবস্থাপনায় যা খুব গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হয়ে দাঁড়ায়। কেননা বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ৪,০৯৬ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে, যা পৃথিবীর পঞ্চম বৃহত্তম স্থল সীমান্ত। সীমান্তের মানুষ বিভিন্ন কারণে এই এলাকা ব্যবহার করে। এই বিশাল অঞ্চলকে যদি সঠিকভাবে পরিচালনা না করা যায় তবে জননিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে এবং তা সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হতে বাধ্য। তাই বহু আগে থেকেই এই অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য দু’দেশের পরিকল্পনা ও আলোচনা চলে আসছিলো। সীমান্ত ব্যবস্থাপনা ও জননিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য প্রথমেই ছিটমহল সমস্যা সমাধানের দরকার ছিলো। বিএনপি-জামাত জোটের শাসনামলে এই কাজ কোনভাবেই অগ্রসর হচ্ছিলো না। উল্টো সীমান্তে দশ ট্রাক অস্ত্র চালানের ঘটনা ঘটিয়েছিলো খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত সরকার। ২০০৯ সাল থেকে ছিটমহল সমস্যা সমাধানে শেখ হাসিনা অগ্রসর হয় এবং কংগ্রেস সরকার থাকাকালীন সময় কিছুটা আলাপ আলোচনা শুরু হয়। কিন্তু ছিটমহল সমস্যার চূড়ান্ত সমাধান আসে হাসিনা-মোদির হাত ধরে। ৩১ জুলাই ২০১৫ ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ছিটমহলগুলোর বিনিময় হয় এবং স্ট্রিপ মানচিত্র স্বাক্ষরিত হয়। ৩০ নভেম্বর ২০১৫ ভারতীয় নাগরিকত্ব বজায় রাখতে আগ্রহী পূর্ববর্তী ছিটমহলগুলোর বাসিন্দাগণ ভারতে চূড়ান্তভাবে পাড়ি জমান। 

ছিটমহল সমস্যা সমাধান হলেও হাজার মানুষ নানা কারণে অবৈধভাবে সীমান্ত পারাপার করছে। এছাড়া চোরাচালান ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী এলাকাগুলিতে আইন-শৃঙ্খলার ক্ষেত্রে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই চোরাকারবার ও সীমান্ত পারাপার রুখতে ২০১১ সালেই ভারত-বাংলাদেশ যৌথ সীমান্ত ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা (সিবিএমপি) স্মারক স্বাক্ষরসহ নানা কার্যক্রম হাতে নিয়েছে।  সীমান্তে নিরাপত্তা বাড়ানো ও ব্যবস্থাপনা মানসম্মত করার লক্ষ্যেই এই সিবিএমপি স্বাক্ষরিত হয়। সমন্বিত পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মাধ্যমে সীমান্তে মাদকসহ অন্যান্য অবৈধ দ্রব্যের চোরাচালান, নারী ও শিশু পাচার বন্ধসহ সীমান্ত নিরাপত্তা আরও জোরদার করার ব্যাপারে বেশ কিছু নির্দেশনা ঐ চুক্তিতে উল্লেখ করা হয়। সন্ত্রাসবাদ কোনো দেশের একক সমস্যা নয়, এটি বিশ্বব্যাপী বিরাজমান। এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে মাদক পাচার, চোরাচালান, সংঘবদ্ধ অপরাধ ইত্যাদি। এসব সমস্যা কার্যকরভাবে মোকাবেলার জন্য পারস্পরিক সহযোগিতা অত্যন্ত প্রয়োজন। বাংলাদেশ ও ভারত দ্বিপক্ষীয় ক্ষেত্রে ২০০৬ সাল থেকে নিরাপত্তা বিষয়ক আলোচ্য চুক্তিগুলো সম্পাদনের কার্যক্রম শুরু করে। নিরাপত্তা সংক্রান্ত তিনটি মূল চুক্তি নিয়ে বিস্তারিত জানলে নিরাপত্তা ও সীমান্ত ব্যবস্থাপনা নিয়ে দুই দেশের আন্তরিকতার জায়গাটি স্পষ্ট হয়ে উঠে।

১। অপরাধ দমন বিষয়ক পারস্পরিক আইনগত সহায়তা চুক্তিঃ দুই দেশের সম্পাদিত চুক্তির কাগজপত্র থেকে এই চুক্তি সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যায়। এ চুক্তির আওতায় ফৌজদারি অপরাধ বিষয়ে সহযোগিতা ও পারস্পরিক আইনগত সহায়তার মাধ্যমে সন্ত্রাসী কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পর্কিত অপরাধগুলো অনুসন্ধান, বিচারকার্য এবং অপরাধের মাধ্যমে অর্জিত সম্পদ ও দলিলপত্র শনাক্তকরণ, বাধাদান, জব্দকরণ বা বাজেয়াপ্তকরণের বিধান রাখা হয়েছে। চুক্তিভুক্ত দুটি পক্ষ এ চুক্তির আওতায় একে অপরকে ফৌজদারি অপরাধ বিষয়ে সর্বোচ্চ সহযোগিতা প্রদান করবে। এই চুক্তির আওতায় আদালত বা অপর কোনো সংশ্লিষ্ট বিভাগ কর্তৃক সহায়তা চাওয়া হলে, অনুরূপ পারস্পরিক আইনগত সহযোগিতা প্রদান করা হবে। এ চুক্তি কার্যকর হওয়ার আগে সংঘটিত কোনো ফৌজদারি অপরাধ বিষয়ক অনুরোধের ক্ষেত্রেও এরূপ পারস্পরিক আইনগত সহযোগিতা প্রদান কার্যকর হবে। উভয় দেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ হিসেবে চুক্তির আওতায় পারস্পরিক সহযোগিতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করবে।

২। আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ, সংঘটিত অপরাধ ও অবৈধ মাদক পাচার দমন বিষয়ক দ্বিপক্ষীয় চুক্তিঃ আন্তর্জাতিক সন্ত্রাস ও মাদক পাচার সম্পর্কিত অপরাধসহ সব ধরনের অপরাধ প্রতিরোধ, অনুসন্ধান, বিচারকার্য কার্যকরভাবে সম্পাদনের জন্য গোয়েন্দা ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর পারস্পরিক সহযোগিতা বাড়াতে এ চুক্তিটি সই করা হয়। এ চুক্তির আওতায় চুক্তিভুক্ত উভয় দেশ অভ্যন্তরীণ আইন ও বিধি সাপেক্ষে, আন্তর্জাতিক সন্ত্রাস প্রতিরোধ, মাদকদ্রব্য এবং রাসায়নিক পদার্থসহ সাইকোট্রোপিক দ্রব্যগুলোর অবৈধ পাচার রোধে সহায়তা প্রদান করবে। অপরাধ অনুসন্ধান, বিচারকার্য ও দমনের উদ্দেশ্যে একে অপরকে পারস্পরিক আইনগত সহায়তা প্রদান করবে। উভয় দেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে দেশগুলোর আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত একটি সমন্বয় কমিটির মাধ্যমে সহায়তাদানের কার্যক্রম পরিচালিত হবে। তবে দেশের সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তার স্বার্থ বিঘ্নিত হয় অথবা দেশের প্রচলিত আইন বা বিধি পরিপন্থী কোনো কার্যক্রম এই চুক্তির আওতায় করা যাবে না। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে চুক্তিটির খসড়া অনুমোদনের ব্যাপারে ২০০৬ সাল থেকে বাংলাদেশ সরকার কাজ করছে।

৩। সাজাপ্রাপ্ত আসামিদের বিনিময় বিষয়ক চুক্তিঃ ফৌজদারি অপরাধে সাজাপ্রাপ্ত আসামিরা যাতে নিজ দেশে সাজা ভোগ করতে পারে তার সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে এ চুক্তি প্রণয়ন করা হয়। ছয় মাসের অধিক সাজা ভোগ করা বাকি আছে অথবা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি যার বিরুদ্ধে অন্য কোনো মামলার বিচার বা তদন্ত বাকি নেই এমন ধরনের আসামিরা এই চুক্তির আওতায় বিবেচিত হবেন। তবে যারা কোনো সেনা আইনে সাজাপ্রাপ্ত অথবা যারা মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত অথবা যাদের বিরুদ্ধে অন্য কোনো মামলা বিচারাধীন আছে তাদের ক্ষেত্রে এই চুক্তির বিধান প্রযোজ্য হবে না। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, নিজ দেশে সামাজিকভাবে স্থানান্তরের সুযোগ পাওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট আসামি কর্তৃক নিজে অথবা তার নিয়োজিত ব্যক্তি কর্তৃক লিখিতভাবে অনুরোধ করা ব্যতীত এ চুক্তির কোনো বিধান প্রযোজ্য হবে না। সাজাপ্রাপ্ত বন্দিদের নিজ দেশে স্থানান্তরের বিষয়ে ভারত একই ধরনের চুক্তি যুক্তরাজ্য, মিসর, মরিশাস, কানাডা, সৌদি আরব ও ফ্রান্সসহ প্রায় ১৬টি দেশের সঙ্গে সম্পাদন করেছে। আরও অনেক দেশের সঙ্গে সম্পাদনের অপেক্ষায় আছে। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে চুক্তিটির খসড়ার ওপর ২০০৮ সাল থেকে কার্যক্রম চলছে।

সীমান্ত হত্যা বন্ধে আলাদা চুক্তিও করেছে দু’দেশ। ২০০৮ সালে ভারত সরকার ও বিএসএফ বাংলাদেশের জনগণকে আশ্বস্ত করেছিল যে, সীমান্তে প্রাণঘাতী কোনও অস্ত্র ব্যবহার করা হবে না। পরবর্তীতে ২০১১ সালে বিএসএফ এবং বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) পাচারকারী ও অবৈধপথে সীমান্ত পার হওয়া নাগরিকদের ক্ষেত্রে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার না করার চুক্তিও করে। এদিকে বিএসএফ বলছে, সীমান্তে বেশিরভাগ হত্যার পেছনেই থাকে গরুর চোরাকারবার। আর সে কারণেই যে সব এলাকায় এই সমস্যা বেশি, সেখানে বাড়তি পাহারা চালু করতে তারা বিজিবিকেও রাজি করিয়েছেন। স্থির হয়েছে, দু'পক্ষের ব্যাটেলিয়ন কমান্ডান্টরা কথা বলে যৌথ টহলদারিও চালাবেন, বিশেষ করে রাতে। ভারত সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকেও সীমান্ত হত্যা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনায় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।

সীমান্ত ব্যবস্থাপনায় ও নিরাপত্তার ক্ষেত্রে এই চুক্তিগুলো অনেক অর্থবহ। অন্তত অতীত অভিজ্ঞতা তাই বলে। কেননা সীমান্তে ডিউটিরত ব্যক্তি অসাধু উপায়ে বখরা নেবার জন্য নানা চোরাচালানে জড়িত থাকে। গরু, মাদক চোরাচালানসহ নানা অবৈধ কর্মকাণ্ডে বিএসএফ বিজিবি উভয়েই জড়িত থাকে। এক্ষেত্রে হঠাৎ করেই অন্য বিএসএফ বা ঊর্ধতন কর্মকর্তা চোরাচালানের স্থানে আসলে গুলি চালানো হয়। এই বখরা প্রথা শুধু ভারতে না বাংলাদেশের বিজিবির মধ্যেও দৃশ্যমান। তাই অপরাধ দমনে এই চুক্তি উভয় দেশের সীমান্তরক্ষীদের জন্য এক কঠোর বার্তা।

ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের বাস্তবতাটা বেশ জটিল, এখানে মানুষের আত্মীয়স্বজন ছড়িয়ে আছেন সীমান্তের দুদিকেই। ফলে প্রিয়জনের সঙ্গে দেখা করতে বা ডাক্তার দেখাতে অবৈধ সীমান্ত পারাপারের মতো ঘটনা ঘটে। তাই গুলি করে মানুষ হত্যা কোন সমাধান না তা সীমান্তরক্ষীদের বুঝতে হবে। কোন হত্যাকাণ্ডই কাম্য নয় এবং এই সীমান্ত হত্যা বন্ধে দু’দেশকে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে। উল্লেখ্য যে পূর্বের যেকোন সময়ের চেয়ে বর্তমানে এই সীমান্ত হত্যা অনেক কম তবে শূন্যের কোটায় এই সীমান্ত হত্যা নিয়ে আসতে হবে। তেরঙ্গা-লাল সবুজ সম্পর্ককে আরও সুউচ্চে স্থান দিতে হলে এই সীমান্ত হত্যা বন্ধ করতেই হবে। মনে রাখা দরকার, ‘গণভবন থেকে জনপথ রোড’ এর দূরত্ব বাড়াতে সবসময়ই একটি মহল কাজ করে যাচ্ছে, তাই সে সুযোগ চিরতরে বন্ধ করে দিতে হবে।

লেখক: রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক 

বিডি প্রতিদিন/ফারজানা



এই পাতার আরো খবর