ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

আজকের পত্রিকা

ইতালি থেকে ১৪২ বাংলাদেশির দেশে ফেরা ও বিমানবন্দরের অব্যবস্থাপনা
শ্ওগাত আলী সাগর
শ্ওগাত আলী সাগর

করোনাভাইরাসে হিমসিম খা্ওয়া ইতালি থেকে নিজের দেশে আসা ১৪২ জন বাংলাদেশিকে নিয়ে ঢাকায় একটা অপ্রীতিকর পরিস্থিতির তৈরি হয়েছিল। দিনভর ফেসবুকে অনেকেই ইতালি থেকে আসা প্রবাসীদের তীব্র সমালোচনায় প্রবাসীদের প্রতি ক্ষোভ, ধিক্বার সবই ছিল, কিন্তু কি পরিস্থিতিতে কি ঘটেছে সেই সম্পর্কে কোনো তথ্য ছিল না। পুলিশের সঙ্গে ধাক্কাধাক্তিসহ পরিস্থিতি এমন জায়গায় গেছে যে সেখানে সেনাবাহিনীর সদস্যদেরও যেতে হয়েছে। 

বিমানবন্দর সংলগ্ন হাজি ক্যাম্পে ইতালি ফেরত বাংলাদেশিদের নিয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি চলার সময়েই বাংলাদেশের অনেক বন্ধুই তাদের নিয়ে ফেসবুকে নানা মন্তব্য করেছেন। অনেকেই বলেছেন - ইতালি থেকে আসা প্রবাসীরা সরকারের নেয়া পদক্ষেপের অংশ কোয়ারেন্টাইনে যেতে রাজি হচ্ছেন না। অনেক কঠিন এবং আপত্তিকর শব্দ প্রয়োগ করেও তাদের সমালোচনা করেছেন। যারা এই সমালোচনা করেছেন তারা কেউই ঘটনাস্থলে ছিলেন না। আসলেই কি ইতালি ফেরত বাংলাদেশিরা কোয়ারে্িটাইনে যেতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল? কি এমন ঘটেছিল সেখানে যে সেনা সদস্যদের পর্যন্ত যেতে হয়েছে সেখানে? 

একুশে টেলিভিশনের খবরের একটি ক্লিপ দেখার সুযোগ হয়েছে। সেখানে ফেরত আসা প্রবাসীদের কয়েকজনের বক্তব্য শুনলাম। সেই বক্তব্যে তো তারা স্পষ্টই করে বলেছেন, আমরা সরকারের পরীক্ষর ভেতর দিয়েই যেতে চাই। কিন্তু কোনো ডাক্তারই তো এখন পর্যন্ত আসেননি। তাদের বক্তব্যে অযৌক্তিক কিছু ছিল বলে তো মনে হয়নি। বরং দীর্ঘ বিমান ভ্রমণের পর জন্মভূমিতে পৌঁছে তাদের  অবর্ণনীয় তিক্ততা  এবং হয়রানির মুখোমুখি  হয়েছেন তারা। প্রবাসীদের যারা তীব্র সমালোচনার আগুনে দগ্ধ করেছেন তারা কিন্তু অব্যবস্থাপনা নিয়ে একটি শব্দও ব্যয় করেননি।  

শিশু সন্তানসহ পরিবারের সদস্যদের নিয়ে যে লোকগুলো দীর্ঘ বিমান ভ্রমণের ক্লান্তি নিয়ে ঢাকায় নেমেছেন, তাদের সঙ্গে সরকারি কর্তৃপক্ষের ব্যবহারটা কি ছিল? বিমান থেকে নামার পর কি প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে তাদের যেতে হবে সে ব্যাপারে কি তাদের কোনো ব্রিফ দেয়া হয়েছিল? 

ব্রিফের প্রশ্নটি আসছে কারণ তাদের আলাদাভাবে দেখা হয়েছে। তারা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত একটি দেশ থেকে এক সঙ্গে আসছে বলে তাদের বিশেষ নিরীক্ষা প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যেতে হবে- এই তত্যটি তাদের জানানো দরকার ছিল। এটি কেবল শোভন আচরণই নয়, আন্তর্জাতিক রীতির অংশও। ইতালি থেকে তারা আরেকটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরেই নেমেছেন। সেখানে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নিয়ম-নীতিই তো অনুসরণ করা হবে। 

টেলিভিশনে দেয়া তাদের বক্তব্যে তারা জানিয়েছেন, ইতালি থেকে চিকিৎসা সনদ নিয়েই তারা ফ্লাই করেছেন। মাঝখানে ট্রানজিটেও তাদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা হয়েছে। ঢাকায় আরেক দফা স্বাস্থ্য পরীক্ষায় তাদের কারো আপত্তি থাকার কথা না। 

ইতালি থেকে আসা লোকগুলোর সঙ্গে অনেকগুলো ছোটো ছোটো বাচ্চা ছিল। যে লোকটি সবচেয়ে বেশি উচ্চ বাচ্চ্য করেছে, দেশকে গালি দিয়েছে সেই লোকটি্ও কিন্তু চিৎকার করে বার বার বলছিল আমার বাচ্চাটা ১১ ঘণ্টা ধরে না খেয়ে আছে। ও অসুস্থ হয়ে যাবে। দীর্ঘ বিমান ভ্রমণের ক্লান্তি আর ১১ ঘণ্টা না খেয়ে থাকা একটি শিশুর বাবা হিসেবে নিজেকে কল্পনা করে দেখেন তো। 

কতটা শোভন আচরণ আপনি করতে পারবেন! ওই বাচ্চাটা অসুস্থ ছিল কী না, স্পেশাল নিড কী না- তার কিছুই তো আমরা জানি না! ওই লোকটা ‘মাদারল্যান্ড’কে যে অশ্লিল গালি দিয়েছে- তার জন্য ধিক্কার জানাই। কিন্তু যে বাচ্চাটা ১১ ঘণ্টা না খেয়ে আছে- তার দায় দায়িত্ব কে নেবে? 

ইতালি প্রবাসীদের বক্তব্য অনুযায়ী, তাদের ১ ঘণ্টা বিমানবন্দরে বসিয়ে রাখা হযেছে, হাজি ক্যাম্পে নিয়ে সেখানে বাসে বসিয়ে রাখা হযেছে। এই সময়ে তাদের কোনো খাবারের ব্যবস্থা ছিল না। একজন বললেন, সকাল ১০টায় তাদের এক বোতল করে  পানি দেয়া হয়েছে। এছাড়া কোনো খাবার তাদের জুটেনি। ময়লা দুর্গন্ধময় আর মশা- মাছিতে সয়লাব হাজি ক্যাম্পে তাদের বসিয়ে রাখা হয়েছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। এই পরিস্থিতে ফেসবুকে যারা সমালোচনার ঝড় বইয়ে দিয়েছেন তারা কি করতেন? 

তারা কি শান্ত সুবোধ বালকের মতো বসে থাকতেন। যারা প্রবাসদের অসহিষ্ণুতা  নিয়ে গালি দিচ্ছেন তাদের কেউই নিজ দেশের অবস্থাপনা নিয়ে একটি কথা্ও বলছেন না। 

‘ইতালি থেকে এমিরেটসের একটি ফ্লাইটে ১৪২ জন প্রিবাসী বাংলাদেশের আসছেন’- এই সংবাদটি ইতালির মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়েছিল। ইতালির মিডিয়ার উদ্ধৃতি দিয়ে বাংলাদেশের পত্র-পত্রিকায়ও এই খবর আগেই প্রকাশ পেয়েছে। ফলে এরা যে বাংলাদেশে আসছেন সেটি গোপনীয় কোনো ব্যাপার ছিল না। এমনও নয় যে সংঘবদ্ধ অপরাধীদের একটি দল গোপনে দেশে ঢুকে যাচ্ছে। অতীতেও এভাবে দলবেধে প্রবাসীরা নিজ দেশে ফিরেছেন্ এবারের পরিস্থিতিটা ভিন্ন করোনাভাইরাসের সংক্রমনের আশঙ্কায়। পরিস্থিতিটি ভিন্ন- ইতালি সংক্রমিত একটি দেশ বলে। 

বাংলাদেশ থেকে অনেকেই ফেসবুকে ইতালির মিডিয়ার লিংক দিয়ে সরকারকে সতর্ক করার চেষ্টা করেছেন। সেই সতর্ক করার প্রক্রিয়াটা সবারই যে শোভন ছিল তাও নয়। কারো কারো পোস্ট পড়ে মনে হযেছে এই লোকগুলো দেশে ঢুকলে দেশের  সর্বনাশ হয়ে যাবে! ধারণা করি, করোনাভাইরাস নিয়ে উদ্বেগ উৎকণ্ঠা থেকেই এক সঙ্গে এতজন মানুষের দেশে ফিরা নিয়ে অনেকের মধ্যে বাড়তি প্রতিক্রিয়া হয়েছে। কিন্তু ঢাকার বিমানবন্দরে তাদের ব্যাপারে আগাম প্রস্তুতি কি ছিল না?

ইতালিতে বাংলাদেশ দূতাবাস আছে। সেখানকার মিডিয়ায় খবর প্রকাশিত হবার পর দূতাবাস কি সরকারকে এই তথ্যটি জানিয়েছিল? ঢাকার পত্র-পত্রিকায় এই খবর প্রকাশিত হয়েছে। ফলে দূতাবাস না জানালেও ঢাকার পত্রিকার খবর থেকেই সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের জেনে যাওয়ার কথা। করোনাভাইরাস সংক্রমিত একটি দেশ থেকে আসা ১৪২ জন লোককে নিয়ে কি কি করতে হবে সেই ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা থাকার কথা। তাদের হাজি ক্যাম্পে নেয়া হলে সেখানে আগ থেকেই গুছিয়ে রাখার কথা। তাহলে বিমানবন্দরে ঘণ্টাখানেক বসিয়ে রেখে হাজি ক্যাম্পে নিয়ে তাদের বাসে বসিয়ে রেখে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার কাজ করতে হবে কেন? 

যে ১৪২ জন বাংলাদেশি ইতালি থেকে ফিরেছেন, তারা বাংলাদেশের সন্তান। একটি দুঃসময়ে তারা নিজের মাতৃভূমিতে ফিরেছেন, নিজের স্বজনদের কাছে ফিরেছেন্। দেশের মাটিতেই পা দিয়েই এমন তিক্ততা, এমন বৈরিতা তাদের প্রাপ্য ছিল না। হতে পারে করোনাভাইরাসের বিস্তৃতির অনেক আগেই তাদের এই ভ্রমণ পরিকল্পনা ছিল, হতে পারে করোনাভাইরাসের ভয়াবহতায় তারা নিজের মাতৃভূমিতে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, নিজের মায়ের কোলে ঠাঁই পেতে চেয়েছেন, সেই জন্য তাদের নিগ্রহের মুখে ঠেলে দেয়া সমীচীন হয়নি। বাংলাদেশের বিমানবন্দরের ব্যবস্থাপনা আরও উন্নত হউক, দুর্যাগ ব্যবস্থাপনা মানবিক হউক। 

লেখক: নতুনদেশ ডটকম'র প্রধান সম্পাদক। 

বিডি প্রতিদিন/আরাফাত



এই পাতার আরো খবর