ঢাকা, মঙ্গলবার, ৩০ জুলাই, ২০২৪

আজকের পত্রিকা

আপোষের রাজনীতির প্রেক্ষাপট থেকে মাহবুবুল হককে দেখা : স্মৃতি কথা, শরীফ নুরুল আম্বিয়া
অপু সরোয়ার

শরীফ নুরুল আম্বিয়া ও মাহবুবুল হক মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, পূর্ব-পাকিস্তান ছাত্রলীগের অগ্রগামী চিন্তার ধারক, মুক্তিযুদ্ধে মুজিব বাহিনীর প্রশিক্ষক, স্বাধীনতার পরে দ্বিধাবিভক্ত ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন ১৯৭২-১৯৭৩ সালে। জাসদ মুক্তিযোদ্ধা ও ছাত্র বিপ্লবীদের দল। এই দল গঠনের উভয়ই প্রধান ভূমিকা পালন করেন। শরীফ নুরুল আম্বিয়ার কলমে মাহবুবুল হক উঠে এসেছেন নানা আঙ্গিকে। পোশাকে চলনে প্রথা বিরোধী মাহবুবুবুল হক, সমাজতান্ত্রিক রাজনৈতিক আদর্শের প্রতি অবিচল মাহবুবুল হকের চিত্র। লেখাটি সত্যিকারের অর্থেই ছোট, লেখাটি পাঠ শেষে রবীন্দ্রনাথের ছোট গল্পের ধারণা চোখের সামনে ভেসে আসে।

"নাহি বর্ণনার ছটা ঘটনার ঘনঘটা, নাহি তত্ত্ব নাহি উপদেশ। অন্তরে অতৃপ্তি রবে সাঙ্গ করি মনে হবে শেষ হয়ে হইল না শেষ। জগতের শত শত অসমাপ্ত কথা যত, 

'বর্ষাযাপন' সোনারতরী কাব্যগ্রন্থ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

শরীফ নুরুল আম্বিয়া লিখেছেন, এখনকার ছাত্রনেতাদের মতো তখন আমরা অত ফিটফাট থাকতাম না, থাকতে চাইতাম না। জৌলুসের প্রতি আমাদের কোনো আকর্ষণ ছিল না। ওটা ছিল বিপ্লবের যুগ। বিপ্লবের উপযুক্ত হওয়ার জন্য কম খরচে সাদাসিধে জীবনযাপন করা বিশ্বাসের অংশ ছিল। শ্রেণিচ্যুত হওয়ার একটা তাগিদ ছিল। আদর্শবাদী সংগঠন গড়ে তোলার প্রত্যয় ছিল আমাদের। মাহবুবের মুখে দাড়ি ছিল, মাথায় ঝাঁকড়া চুল ছিল এবং তা কেটে ছেঁটে রাখত না, অনেক সময় লুঙ্গি পরে মধুর ক্যান্টিন ও বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় দলবলসহ চলাচল করত। তার এই বেশভূষা নিয়ে সমালোচনা হতো।" - সাধাসিধে জীবন যাপন ও শ্রেণিচ্যুতির ধারণা নিজ জীবনে প্রয়োগ করেছেন মাহবুবুল হক। যে কোন চিন্তা ও ধারণা বাস্তবে প্রয়োগের দার্শনিক- ও প্রায়োগিক সংকটকে মোকাবেলা করেই মাহবুবুল হককে অগ্রসর হতে হয়েছে। ব্যক্তিগত জীবনে শ্রেণিচ্যুতির ধারণা প্রয়োগে মাহবুবুল হক সফল হয়েছেন কিন্তু রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে হোঁচট খাওয়ার অনেক ঘটনাই রয়েছে। তবে হোঁচট খেয়ে পথ চলা বন্ধ করেননি তিনি, মরা মাছের মত স্রোতের অনুকূলে ভাসেননি। যেমনটা হাঁটছেন বা হেঁটেছেন শরীফ নুরুল আম্বিয়া, হাসানুল হক ইনু , রাশেদ খান মেননরা, ১৯৭২-৭৫ সালে হেঁটেছেন মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বা সিপিবি, ১৯৮৩-১৯৯০ পর্যন্ত আ স ম রব, মির্জা সুলতান রাজা, শাহজাহান সিরাজ। মরা মাছের মত স্রোতের অনুকূলে ভাসা হচ্ছে সমাজতান্ত্রিক আদর্শকে বিকিয়ে দিয়ে ক্ষমতাসীন সরকারের সমর্থক হয়ে যাওয়ার পরেও বিপ্লবী ঘ্রাণ যুক্ত 'তালমিশ্রী' মার্কা রাজনৈতিক বক্তব্য অব্যাহত রাখা।

১৯৯০ সালে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন এর পতন এরপর দুনিয়া ব্যাপী সমাজতন্ত্র ত্যাগের হিড়িক পড়ে। বাংলাদেশে এর ব্যাতিক্রম ছিল। বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী 'চীন পন্থী' কমিউনিস্ট গ্রুপগুলো সোভিয়েত ইউনিয়নকে সামাজিক ‘সাম্রাজ্যবাদ’ হিসেবে চিত্রিত করে নিজেদের 'বিপ্লবী' সত্ত্বাকে জাহির করত। স্তালিন পরবর্তীতে ক্রুশ্চভ এর ক্ষমতা দখল ও স্তালিন বিরোধী কিছু কথাবার্তা মূলত 'চীন ও রুশ' পন্থা বামপন্থার জন্ম দেয়। ক্রুশ্চভ- স্টালিনীয় ধারার বহমানতা ও বিকাশ মাত্র। আমাদের অঞ্চলের দেশগুলোতে এর অন্ধ অনুকরণের হিড়িক পড়ে।

১৯১৭ সালে অক্টোবর বিপ্লবের মধ্য দিয়ে পৃথিবীর প্রথম সমাজতান্ত্রিক দেশ হিসেবে সোভিয়েত ইউনিয়ন এর শুরু। ১৯২৪ সনে লেলিনের মৃত্যু ও পরিবর্তী দশ বছর সোভিয়েত পার্টি নেতাদের বহিস্কার ও খুনের মধ্য দিয়ে স্তালিনের নেতৃত্বে আমলাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। অক্টোবর বিপ্লবের অর্জনগুলো ক্ষয়ে যেতে থাকে। ১৯৯০ সালে অক্টোবর বিপ্লবের যা কিছু অবশিষ্ট ছিল তা মাটি চাপা দিয়ে পুঁজিবাদী অর্থনীতির পথে পা বাড়ায়।

সোভিয়েত পতনের পায়ের আওয়াজ ১৯৮০ এর দশকের মাঝামাঝি থেকেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। এই অস্থিরতায় আমাদের দেশসহ নানান দেশে বামপন্থী দলগুলোর ঐক্যের 'হিড়িক' পড়ে। এই সব ঐক্যের রাজনৈতিক ভিত্তি ছিল দুর্বল এবং গোজামিলে ভরা। বাংলদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি এই গোজামিলের ঐক্যের প্রথম 'ফসল' । 'ঐক্যবদ্ধ' ওয়ার্কার্স পার্টিতে শামিল হয়েছিল বিমল বিশ্বাসের নেতৃত্বে পূর্ব পাকিস্থান কমিউনিস্ট পার্টির অংশ, যারা ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশকে 'পূর্ব পাকিস্তান' মনে করত, টিপু বিশ্বাস-আব্দুল মতিনের পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টির একাংশ, সাম্যবাদী দলের একাংশ যারা জিয়াউর রহমানের সামরিক সামনের মধ্যে 'দেশ প্রেম' খুঁজেছিল, অমল সেনের নেত্বাধীন ওয়ার্কার্স পার্টির একাংশ যারা এরশাদের সামরিক শাসনকে বৈধতা দিতে ১৯৮৬ সালে গণআন্দোলনের মাঝ পথ থেকে সরে দাঁড়িয়েছিল।

জাসদেও এই জাতীয় ঐক্যের বিলম্বিত ঢেউ লাগে। ১৯৯০ সনের এরশাদ পতনের আন্দোলনে জাসদসহ তৎকালীন পাঁচ দল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এই দলগুলোর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার ভিত্তি ভূমি ছিল দেশের স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু ১৯৯১ সনের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বামপন্থীদের ভরাডুবি ঘটে। বামপন্থীরা কোনো আসন পেতে ব্যর্থ হয়। নির্বাচনে চাটখিল-নোয়াখালীতে মাহবুবুল হক ও চৌহালী, সিরাজগঞ্জে আব্দুল মতিন ভোটার ফলাফলের দিক থেকে দ্বিতীয় স্থানে ছিলেন। অন্য সব প্রার্থীর অবস্থা ছিল ভোটার ফলাফলের নিচের দিকে। ১৯৯৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সকল বামপন্থী দলের প্রার্থীরা 'গো' হারা হারেন। ভোটের রাজনীতির এই লেজে গোবরে অবস্থা জাসদকে (ইনু-আরিফ-আম্বিয়া) ওয়ার্কার্স পার্টি ধাঁচের গোজামিলের ঐক্যের পথে হাঁটতে বাধ্য করে। জাসদ(রব)-এরশাদ সামরিক সরকারের সমর্থক আর জাসদ (ইনু-আরিফ-আম্বিয়া) এরশাদ সামরিক সরকার বিরোধী ঐক্যবদ্ধ হয়। এই স্রোতে বাসদ (মাহবুব) এর একাংশ শামিল হয়। প্রসঙ্গত জাসদ ও ওয়ার্কার্স পার্টির 'ঐক্য' বেশি দিন টিকে থাকেনি। যতগুলো খণ্ড এক হয়েছিল, প্রায় ততোধিক খণ্ডে এই দল দুটো ভাগ হয়ে পড়েছে।

এই সময়ের মধ্যে শরীফ নুরুল আম্বিয়া সমাজতন্ত্রকে রাজনৈতিক আদর্শকে ঝেড়ে ফেলেছেন। জাসদ জন্মকালীন প্রতিশ্রুতি থেকে উল্টো পথে হাঁটা শুরু করেছেন। ১৯৯৭ সালে জাসদ একমাত্র সংসদ সদস্য নিয়ে আওমী লীগ নেতৃত্বে 'জাতীয় সরকার ' এ যোগ দেয়। এই সময়কালে শরীফ নুরুল আম্বিয়া 'ঐক্য' জাসদে মাহবুবুল হকে শামিল করার অভিপ্রায়ে বৈঠক করেন। আম্বিয়া এই বৈঠকের অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখেছেন, ‘আমার ধারণা হয়েছিল, ৯০-এ সোভিয়েতের পতনের পর হয়তো তার চিন্তা-ভাবনার পরিবর্তন হতে পারে। কিন্তু তার চিন্তা-ভাবনার কোনো পরিবর্তন না দেখে আমি নিরাশ হয়েছিলাম।’ এখানে দেখা মেলে চির চেনা মাহবুবুল হক' এ তুফান ভারী, দিতে হবে পাড়ি'। জনাব আম্বিয়া ১৯৭২ সনে রাজনৈতিক অবস্থান ছেড়ে অনেক দূরে অবস্থানের পরেও নির্মোহভাবে মাহবুবুল হককে মূল্যায়ন করে লিখেছেন, মেহনতি মানুষের মুক্তির সংগ্রামের ভবিষ্যৎ নিয়ে সে অনেক আস্থাশীল ছিল। আমৃত্যু বিপ্লব ও সমাজতন্ত্র আঁকড়ে পড়েছিল। মাহবুব যা বিশ্বাস করত তা-ই সততার সঙ্গে করার চেষ্টা করেছে, বিশ্বাসের সঙ্গে প্রতারণা বা আপস করেনি।

শরীফ নুরুল আম্বিয়া তৎকালীন সময়ের রাজনীতি নিয়ে লিখতে গিয়ে ১৭ মার্চ ১৯৭৪ সনের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাড়ি ঘেরাও নিয়ে লিখেছেন, ‘১৭ মার্চে আমি ঢাকার বাইরে ছিলাম, যা ঘটেছে তাতে আমার কোনো ভূমিকা ছিল না।’ এ কথা কে সত্য ধরে নিয়েও প্রশ্ন জাগে তিনি ঢাকায় থাকলে যা ঘটেছে, তা কি ঘটতো না? জনশ্রুতি সেই মিছিলে লাখ খানেক লোক ছিল। এই বিপুল জনগোষ্ঠীকে নিয়ন্ত্রণে শরীফ নুরুল আম্বিয়ার শারীরিক উপস্থিতি কতটুকু সফল হতো তা প্রশ্নবোধক। শরীফ নুরুল আম্বিয়া জাসদ উদোক্তাদের একজন। যেমন মাহবুবুল হক ছিলেন। এই বক্তব্যের মধ্যে দিয়ে নিজের রাজনৈতিক দায়দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়াচ্ছেন। ভুল-শুদ্ধ- ঠকারিতা যাই হোক জাসদের সকল রাজনৈতিক ঘটনার দায়দায়িত্ব কেন্দ্রীয় নেতাদের সকলের। আম্বিয়া-মাহবুবুল হক এই দায়িত্ব থেকে মুক্ত নন। নিজের শারীরিক অনুপস্থিতি আম্বিয়াকে দায়দায়িত্ব থেকে মুক্ত করে না। এই ঘটনার দায়দায়িত্ব থেকে আড়াল করার প্রচেষ্টার অপর দিক হচ্ছে এই বিক্ষোভ মিছিলে দলের যে সমস্ত নেতাকর্মী নিহত হয়েছেন তাদের প্রতি অশ্রদ্ধা দেখান। শরীফ নুরুল আম্বিয়া বর্তমান সময়ে আওয়ামী লীগ সরকারের অংশ। যদিও এই দলের কোন জাতীয় সংসদ সদস্য নেই। আওয়ামী লীগকে সন্তুষ্ট রাখার প্রচেষ্টায় এই উল্টো কথন কিনা তা ভেবে দেখার যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে।

শরীফ নুরুল আম্বিয়া লিখছেন. ‘১৭ মার্চ ১৯৭৪ সালে জাসদ রাজনীতির পথ পরিবর্তিত হয়। ঢাকায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলীর বাসভবন ঘেরাও কর্মসূচিতে রক্ষীবাহিনী গুলিবর্ষণ করে অনেক কর্মী মেরে ফেলেছিল। পরের দিন সরকার পক্ষ জাসদ অফিস জ্বালিয়ে দিয়েছিল, পরের এক সপ্তাহ সব জেলায় জাসদ নেতাদের বাড়ি থেকে গ্রেফতার করা হয়। রক্ষীবাহিনী ও অন্যান্য সরকার দলীয় বাহিনীর চাপে জাসদের নেতাকর্মীরা উন্মুক্ত তৎপরতা চালাতে পারছিলেন না। এ ঘটনার পর দলের অধিকাংশ নেতাকর্মী গা ঢাকা দেন। মেজর জলিল, আ স ম আব্দুর রবসহ অসংখ্য নেতাকর্মী সে দিন গ্রেফতার হন ঢাকায়। আমাদের একটা বড় ভুল হয়েছিল ওই দিন। সরকারের মধ্যে যে ষড়যন্ত্রকারীরা পরিস্থিতির অবনতি চাচ্ছিল তারা সফল হয়েছিল, আমরা তাদের পাতা ফাঁদে পা দিয়েছিলাম। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য উচ্চপর্যায়ে কথাবার্তা বলে অফিস খোলা হয়েছিল। শাজাহান সিরাজ ও জিকু ভাই কাজ শুরু করেছিলেন, কিন্তু কিছু দিন পর তারাও গ্রেফতার হয়ে গেলে স্বাভাবিক রাজনৈতিক পরিবেশ চরমভাবে ক্ষুন্ন হয়। স্বাভাবিক রাজনীতিতে ফিরে আসার প্রচেষ্টা আওয়ামী লীগের ষড়যন্ত্রকারীরা ভ-ল করে দেয়। ১৭ মার্চে আমি ঢাকার বাইরে ছিলাম, যা ঘটেছে তাতে আমার কোনো ভূমিকা ছিল না।’ আম্বিয়া ১৭ মার্চ ১৯৭৪ সালের ঘটনার জন্য 'আওয়ামী লীগের ষড়যন্ত্রকারী ' দেরকে দায়ী করেছেন। ঘটনার চার দশক পরে কে বা কাহারা ' ষড়যন্ত্রকারী' তা বলতে অপারগতা রাজনৈতিক মেরুদণ্ডহীনতাকে সামনে নিয়ে আসে। এই জাতীয় 'তালমিশ্রী' মেশানো কথাবার্তা আম্বিয়ার বর্তমান আওয়ামী বন্দনাকে পরিপুষ্ট করবে মাত্র।

পঞ্চম কিস্তি : গ্রন্থ সমালোচনা  যে জীবন জনতার, কমরেড আ ফ ম মাহবুবুল হক (স্মারকগ্রন্থ)

বিডি-প্রতিদিন/শফিক



এই পাতার আরো খবর